ভারতের গণতন্ত্রের প্রহসন

লেখক
কৃষ্ণমোহন দেব

১৯৪৭সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করেতবে দেশ দু’ভাগ হয়ে’৷ স্বাধীনতা লাভের আগে থেকেই সংবিধান রচনা শুরু হয়৷ ১৯৪৬ সালে গণপরিষদ নামে সংস্থার ওপর ভারতের সংবিধান রচনার দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়৷ গণপরিষদে ৩৮৯ জন সদস্য ছিল যার মধ্যে ২৯২ জন নির্বাচিত হয় বিভিন্ন প্রাদেশিক আইনসভাগুলির সদস্য দ্বারা আর বাকী ৯৭ জন সদস্য মনোনয়নের ভিত্তিতে দেশীয়  রাজ্যগুলি থেকে প্রেরিত হয়৷ ভারতীয় গণপরিষদ সার্বভৌম পরিষদে পরিণত হয়৷ গণপরিষদের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন পণ্ডিত জহরললাল নেহেরু, ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ, মৌলানা আজাদ, ডাঃ রাধাকৃষ্ণন, আইয়ার, আয়েঙ্গার, কৃষ্ণমাচারী, ডাঃ আম্বেদর প্রভৃতি সমসাময়িক ভারতের স্বনামধন্য ব্যক্তিগণ প্রায় তিনবছর ধরে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক ইত্যাদির পর গণপরিষদ কর্ত্তৃক রচিত ভারতীয় সংবিধান ১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর গৃহীত হয় আর ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী থেকে কার্যকর করা হয়৷  আকারগত দিক দিয়ে ভারতের সংবিধান হলো বৃহত্তর সংবিধান৷ ভারতের সংবিধানের মত বিশ্বের অন্য কোনদেশে এত বেশী ধারা, উপধারা, তফ্‌সিল প্রভৃতি নেই৷ মূল সংবিধানে একটা প্রস্তাবনা ছাড়া ৩৯৫টি ধারা (Article) বহু উপধারা (Clause) ও আটটি তফ্‌ সিল Schedule) ছিল৷ পরবর্তীকালে বারবার সংবিধান সংশোধন হওয়ার ফলে বিভিন্ন অংশ Part),ধারা, উপধারা  ও তফ্‌সিল যেমন সংবিধানের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে তেমনি কিছু ধারা উপধারা বিলোপ করা হয়েছে৷ বর্তমানে ভারতীয় সংবিধানে প্রায় কার্যত ৪৫০ এর মত ধারা, বহু উপধারা ও ১২টি তফ্‌শিল রয়েছে৷ প্রকৃতগতভাবে ভারতের সংবিধান বহু জটিল৷ আর মূল সংবিধানের প্রস্তাবনায় ভারতকে একটি  সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সাধারণ তন্ত্র (Sovereign Socialist) বলে ঘোষনা করা হয়েছে৷ ভারত আভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক উভয়ক্ষেত্রেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী৷

রাজতন্ত্রের শোষণের ফলশ্রুতি হিসাবে গণতন্ত্রের জন্ম অথবা রাজতন্ত্রের আড়ালে পুরোহিত বা অভিজাতদের শোষণের ফলশ্রুতি হল গণতন্ত্র৷ এই গণতন্ত্র সম্বন্ধে বিভিন্ন চিন্তাবিদ্‌ বিভিন্ন ধরণের মত প্রকাশ করেছেন৷ গণতন্ত্রের আবার দু’টিরূপ---(১) সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র (২) ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র৷ সংকীর্ণ অর্থে গণতন্ত্র হলো বিশেষ ধরণের শাসন ব্যবস্থা আর ব্যাপক অর্থে গণতন্ত্র হলো একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্য বিরাজ করবে৷ আবার লাক্সি বলেছেন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র  ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র অর্থহীন৷ মার্ক্সবাদ বলেছেন প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে তখনই যখন সমাজের বৈষম্য থাকে না৷ আবার  রাজতন্ত্রে চতুর্দশ লুই নিজেকে গণতন্ত্রের প্রতিনিধি বলে মনে করতেন৷

আবার স্বৈরতান্ত্রিক মুসোলিনী স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেই গণতন্ত্রের সত্যিকারের রূপায়ণ হতে পারে বলে বিশ্বাস করতেন৷ আব্রাহিম লিঙ্কন গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দিয়েছেন যে---জনগণের জন্য, জনগণের  দ্বারা, জনগণের শাসন (Goverment of the people, by the people and for the people) রুশো  বলেছেন--- সাধারণের ইচ্ছা দ্বারা পরিচালিত যে-কোন রাষ্ট্রকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বলে অভিহিত করা যায়৷

মহান দার্শনিক তাঁর প্রাউট দর্শনে গণতন্ত্র শব্দের  বুৎপত্তিপত্তিগত অর্থ বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে--- ‘‘গ+তন+ডৈ = গণতন্ত্র৷ তন্ত্র শব্দের অর্থ হলো নিয়ন্ত্রিতভাবে বা বিধিবদ্ধ পদ্ধতিতে with Brober accelaration-এ) কোন কিছুকে বাড়িয়ে দেওয়া৷ আবার তন+ ডৈ করে ‘‘তন্ত্র’’৷ এখানে তন্ত্র শব্দের অর্থ হচ্ছে জড়তার থেকে মুক্ত করা৷ ‘ত’ মানে জড়তা৷ গণতন্ত্র মানে গণতার সাহায্যে মানুষকে জড়তা থেকে মুক্ত করা অথবা বিধিবদ্ধভাবে তাদের জন্যে ত্রাণের রাস্তা তৈরী করে দেওয়া৷ গণতন্ত্র শব্দটি Democracy’-এর যথার্থ প্রতিভু না হলেও মোটামুটি অর্থে চলতে  পারে’’৷ (কণিকায় প্রাউট ১৪শ খণ্ড)

রাষ্ট্র বিজ্ঞানের জনক হিসাবে খ্যাত আরিষ্টটল গণতন্ত্রকে বিকৃত সরকার হিসাবে অভিহিত করেছেন৷ ‘‘অ্যারিষ্টটল সরকারকে  ‘স্বাভাবিক’ ও ‘বিকৃত’ এই দুইভাগে ভাগ করেছেন ঃ সমাজের মঙ্গলের স্বার্থে যে শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেটি হ’ল স্বাভাবিক’ আর সমাজের মঙ্গলের পরিবর্তে শাসক গোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা হ’ল ‘বিকৃত’ শাসন ব্যবস্থা৷ শাসকশ্রেণীর সংখ্যার দিক থেকে অ্যারিষ্টটল সরকারকে তিনভাগে ভাগ করেছেন ---১) একজনের শাসন, (২) কয়েক জনের শাসন (৩) বহুজনের শাসন৷ অ্যারিষ্টটলের মতে  সার্বভৌম ক্ষমতা যখন একজনের হাতে ন্যস্ত থাকে ও শাসক জনগণের স্বার্থে দেশ শাসন করেন তাকে বলা হয় রাজতন্ত্র (Monarchy)৷ কিছুসংখ্যক ব্যষ্টিদের হাতে সার্বভৌম ক্ষমতা ন্যস্ত থাকলে ও সমাজের স্বার্থে শাসন পরিচালিত হলে  তাকে বলা হয় অভিজাত তন্ত্র (Aristacracy) আর বহুজনের হাতে শাসনব্যবস্থা ন্যস্ত  থাকলে  ও সকলের স্বার্থে তার পরিচালিত হলে তাকে বলা হবে নিয়মতন্ত্র (Policy)৷  কিন্তু শাসনব্যবস্থা যখন সমাজের স্বার্থের পরিবর্তে শাসকের বা শাসকগোষ্ঠীর স্বার্থে পরিচালিত হয় তখন রাজতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রে (Tyranny) অভিজাত তন্ত্র ধনিকতন্ত্রে (Oligarchy) তে ও নিয়মতন্ত্র গণতন্ত্রে (Democracy) তে পরিণত হয়৷ অ্যারিষ্টলের  মতে এই ছয় প্রকার সরকারের মধ্যে উৎকৃষ্টত্তম হ’ল রাজতন্ত্র ও নিকৃষ্টতম হ’ল গণতন্ত্র৷’’ মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারও বলেছেন ‘‘দ্বন্দাত্মক ভৌতিকবাদ ও গণতন্ত্রের দ্বারা সমাজের কল্যাণ সাধন কোনটির দ্বারাই সম্ভব নয়৷ একমাত্র জ্ঞানদীপ্ত প্রজাহিতৈষী একনায়কতন্ত্র অথবা নৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনাদীপ্ত একনায়ক তন্ত্রই সমাজের কল্যাণ সাধনের এক মাত্র পথ৷

(পরবর্তী সংখ্যা ২রা এপ্রিল ২০২১)