সংস্কৃত ‘নার’ শব্দের কয়েকটিই মানে হয়৷ একটা মানে হ’ল ‘জল’ আরেকটা মানে হ’ল ‘পরমাপ্রকৃতি’–সৃষ্টির আদি মাতৃকা অপর অর্থ হ’ল ‘ভক্তি’৷
সাধক মাত্রেরই মুখ্য তথা চরম লক্ষ্য থাকে এই যে, সে নিজেই যে ভক্তিসুধা পান করবে তা নয়, বরং অন্যেও যাতে সেই ভক্তিরসামৃতের অংশ পায় সে দিকেও তাঁর বেশী আগ্রহ থাকে৷ সাধক নিজে যে আনন্দ উপভোগ করছে সেটা সে অন্যের সঙ্গেও ভাগ–বাঁটোয়ারা করতে চায়৷
প্রাচীনকালে এমনই এক ঈশ্বরনিষ্ঠ সাধক ছিলেন–নারদ৷ স্থান থেকে স্থানান্তরে ঘুরে ঘুরে মানুষের মধ্যে ভক্তিরস বিতরণ করে বেড়াতেন৷ একদিন তিনি নারায়ণকে জিজ্ঞেস করলেন–‘‘হে প্রভু, অনেক জ্ঞানী–গুণী–দার্শনিক বলে থাকেন, আপনি তো সর্বব্যাপী সর্বগ সর্বানুস্যূত সত্তা৷ তবে মানুষ সর্বত্র আপনার উপস্থিতি অনুভব করে না কেন? তাহলে আপনার সবচেয়ে পছন্দসই স্থান কোন্টি যেখানে আপনার উপস্থিতি বেশী করে অনুভব করা যায়? কোন্ স্থানটি আপনার সবচেয়ে প্রিয়?’’
উত্তরে নারায়ণ জানালেন, ‘‘হে নারদ, এটা ঠিক যে আমি সর্বব্যাপ্ত৷ এমন কোন কাজ নেই, এমন কোন মানবীয় চিন্তা বা অনুভূতি নেই যাতে আমি নিবিড়ভাবে মিলেমিশে নেই৷ আমার জ্ঞাতসারেই সব কর্ম অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে অর্থাত্ কর্ম বলতে যা কিছু তা সবই আমার মনের ভেতরে৷ আমার বাইরে বা আমাকে লুকিয়ে কোন কাজ নেই, কোন ভাবনা নেই৷ আমি কোন দূর বিমানে বা সপ্তম আশমানে থাকি না৷ আমার অধিষ্ঠান সেই সব জীবের হৃদয়ে যা কোন প্রকার সঙ্কীর্ণ গোঁড়ামি, অযৌক্তিক মতবাদ বা কোন ক্ষুদ্রত্বের বন্ধনে আবদ্ধ নয়৷ উদার অকুণ্ঠ ভক্তিমান মানুষের মনই আমার সবচেয়ে প্রিয় অধিষ্ঠানস্থল৷
‘যোগ’ শব্দের আসল অর্থ হ’ল একাত্ম হওয়া, to unify, যারা শুধু আসন–ন্যাস–প্রাণায়াম্ অনুশীলন করে কিন্তু হৃদয়ে ভক্তি নেই, তারা আসলে উর্বর সমভূমির পরিবর্তে শুষ্ক্ মরুভূমিতে ফসল ফলাবার বৃথা চেষ্টা করছে৷ সেখানে ভক্তিবারি সিঞ্চন না করে ফসল তোলার চেষ্টা পণ্ডশ্রম মাত্র৷ এই সব তথাকথিত যোগীর নীরস হৃদয়েও আমি অবস্থান করি না৷
‘ভক্তি’ শব্দের আসল অর্থ হ’ল পরমপুরুষের প্রতি আত্যন্তিক আকর্ষণ৷ খণ্ড ক্ষুদ্র বস্তুর প্রতি যে আকর্ষণ তাকে বলি ‘আসক্তি’ আর অখণ্ড পরমপুরুষের প্রতি যে আকর্ষণ তাকে বলে ‘ভক্তি’৷ আসক্তি ও ভক্তির মধ্যে কোন মিল নেই, কোন অভিন্ন মিলনবিন্দু নেই৷ আপেক্ষিক বস্তুর প্রতি আকর্ষণ এক ধরনের মনস্তত্ত্ব আর বৃহতের প্রতি আকর্ষণ আরেক ধরনের মনস্তত্ত্ব৷ আসক্তির পেছনে মনোভাবটা হ’ল আমাকে অমুক অমুক বস্তুকে কুক্ষিগত করতে হবে আমারই ভোগ–সুখের প্রয়োজনে, ভক্তির ক্ষেত্রে মনোভাবটা হ’ল–আমার সম্পূর্ণ সত্তাকে, এমনকি আমার শরীর–মন–আত্মাকেও নিজ সুখের বিনিময়ে পরমপুরুষে নিবেদন করতে হবে৷ যে মনে হৃদয়ে কিছুমাত্র বাসনা–কামনা নেই সেখানেই পরমপুরুষের অধিষ্ঠান৷ ঈশ্বর ও জাগতিক কামনা–বাসনা কখনও পাশাপাশি বা একত্র বাস করতে পারে না যেমন একই আকাশে রবি ও রজনীর সহাবস্থান সম্ভব নয়৷
ভক্তের কাছে ঈশ্বরানুভূতি ব্যাতিরেকে আর সব কিছুই বিস্বাদ৷ লবণবর্জিত আহার্য বস্তু যেমন উপাদেয় হয় না, ঈশ্বরবর্জিত জীবনও তেমনি বিস্বাদ৷ তাই নারায়ণের বক্তব্য ঃ আমার ভক্তরা যেখানে আমার গুণগান করে, ভক্তিভরে আমার কীর্ত্তন করে, আমি সেখানেই যাই, সেখানেই থাকি, সেখানে না গিয়ে থাকতে পারি না৷
এখন, কেউ হয়তো খুব পড়াশোনা করে জ্ঞানী হয়েছে৷ কেউ হয়তো টাকা–পয়সা উপার্জন করে খুব ধনী হয়েছে৷ এই জ্ঞানী বা ধনীরা ভক্ত নাও হতে পারে৷ ভক্তের যেটা মূল প্রয়োজন সেটা হ’ল ভগবানের প্রতি শুদ্ধা ভক্তি৷ যখন অন্তরের আকুতি–অনুভূতি, আকর্ষণ–আসক্তি সব কিছু পরমপুরুষের দিকে চালিয়ে দেওয়া হয় তাকেই বলে ভক্তি৷ ভক্তের একমাত্র যোগ্যতা হ’ল তাঁর হৃদয়ে শ্রদ্ধা–ভক্তি–আন্তরিক্ পূর্ণমাত্রায় থাকতে হবে৷ যদি হৃদয়টা নির্মল হ’ল তো ব্যস্, আর কিছুরই প্রয়োজন নেই৷
তথাকথিত জ্ঞানী হয়ে কোন লাভ নেই৷ যতদিন না হৃদয়ে ভক্তি জাগছে ততদিনই জ্ঞানের প্রয়োজন৷ জ্ঞান জিনিসটা কেমন?–না, ধর, তুমি অনেক চব্য–চূষ্য–লেহ্য–পে খাবার খাবে৷ এখন ওই খাবারগুলো যে কাগজটার ওপর বিছিয়ে রাখলে ওই কাগজটা হ’ল জ্ঞান৷ আহার্য্য বস্তুগুলো হ’ল কর্ম, আর ওই অতি উপাদেয় খাবারগুলো যে সুন্দর স্বাদ সেটা হ’ল ভক্তি৷ যখন খাবারগুলো উদরস্থ করলে আর তাদের স্বাদ বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলে তখন সেই নোংরা কাগজগুলোর মূল্য আর কতটুকু সেগুলো তখন মানুষ আস্তাকুঁড়েই ফেলে দেয়৷ এটাই হ’ল যথার্থ বুদ্ধিমত্তা৷ তোমরা বুদ্ধিমান হও৷