কিছু মানুষ আছে যাদের মধ্যে এষণা আছে৷ কিন্তু তারা ঠিক পথ–নির্দেশনা পায়নি৷ তারা জানে যে, পরমপুরুষ তাদের জীবনের লক্ষ্য হওয়া উচিত, কিন্তু ঠিক ঠিক রাস্তা জানে না, সঠিক পথনির্দেশনা পায়নি৷ বই পড়ে সাধনা করা উচিত নয়, সাধনার জন্যে গুরু প্রয়োজন৷ বই পড়ে বা কারুর কাছে শুণে সাধনা করা বিপজ্জনকও কারণ এতে লক্ষ্য সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট ধারণা তৈরী হয় না৷ কোন্ দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে ৰুঝতে পারে না৷ নৌকা চলছে, কিন্তু নৌকার যে চালক সে জানে না কোথায় যেতে হবে৷ তাহলে কী হবে? অযথা হয়রানি হবে৷ সে দুর্ঘটনারও শিকার হতে পারে৷
এক্ষেত্রে কী হয়? যখন মানুষটির মৃত্যু হয়, মন বিদেহী হয়ে যায়, তারপরে সে ‘বিদেহলীনে’ পরিণত হয়৷ ‘বিদেহলীন’ মানে তার ঠিক কোনো ভৌতিক অস্তিত্ব থাকছে না, কিন্তু তার যে ভাবনা ছিল, মনে যে এষণা ছিল, ওই ভাবজগতে সে থেকে যায় এক অমূর্ত্ত অস্তিত্বরূপে৷ এ অবস্থা জড় সমাধির মতই বিপজ্জনক৷ কিন্তু জড়সমাধি আর এই অবস্থার মধ্যে পার্থক্য কী? জড়সমাধির ক্ষেত্রে তার কিছু গোপন ইচ্ছা ছিল, যার জন্যে সে অপরাধীও, কিন্তু বিদেহীলীন অবস্থায় তা নয়, সে প্রকৃত রাস্তা পায়নি–পথভ্রান্ত, তাই এইরকম হয়ে গেছে৷ তাই সমস্ত মানুষের এটা ৰোঝা উচিত, ঠিক পথ–নির্দেশনা ছাড়া বিশেষ কিছু করা উচিত নয়৷ প্রকৃত পথ–নির্দেশনা নিয়েই কিছু করা শ্রেয়৷ যেমন সমাজে দেখবে কিছু মানুষ ‘ইন ক্লাব জিন্দাবাদ’, ‘বিপ্লব....বিপ্লব’ বলে চিৎকার করে৷ বিপ্লব মানে বাস জ্বালানো, ট্রাম জ্বালানো নয়, রেল লাইন ওপড়ানো নয়৷ তাতে কী হয়? জনসাধারণের ক্ষতি হয়, সরকারের ক্ষতি হয়, সরকার তো তোমাদেরই৷ তুমি যে এসব জ্বালিয়ে নষ্ট করলে এতে কাদের ক্ষতি হচ্ছে? তোমাদেরই ক্ষতি হচ্ছে৷ এসব কী? এসব তো আত্মঘাতী কাজ৷ মনে এই সব ধ্বংসাত্মক ভাবনা কেন আসে? প্রকৃত জ্ঞানের অভাবে৷
সাধনামার্গে কী করা উচিত, কী না করা উচিত জানা না থাকার জন্যে মানুষ উল্টোপাল্টা কাজ করে’ ফেলে৷ যার ফলে তারও ক্ষতি হয়, সমাজেরও ক্ষতি হয়৷
এইভাবেই মানুষ মৃত্যুর পরে বিদেহলীন অবস্থাপ্রাপ্ত হয়৷ পরমাত্মার প্রতি প্রেম না থাকার জন্যেই মানুষের এই অবস্থা হয়৷ কিন্তু প্রকৃতিলীন অন্য প্রকারের৷ যেখানে পরমাত্মার প্রেম আছে, অর্থাৎ মানুষটি ভক্ত, কর্ম–জ্ঞানও শিখেছে, কর্মের কৌশল জেনেছে, জনসেবাও করছে, এসব ঠিক আছে, কিন্তু দ্বৈতভাব থেকে গেছে, আমি ও আমার ভগবান–দুই ভাব থেকে যাচ্ছে৷ এক্ষেত্রে কী হয়? সে কর্ম করছে, জনসেবা করছে, জগতের হিত করছে, সাধনাও করছে–এ সবকিছুই করছে৷ কিন্তু যদি দ্বৈতভাব থেকে গেল, তাহলে কী হবে?
মনে যখন ঈশ্বরভাবের আধিক্য হয়, সে সময় ভিতরে খুব আনন্দ হয়৷ আর ভিতরে খুব আনন্দ হওয়ার ফলে ওই সময় দুঃখৰোধ থাকে না৷ অর্থাৎ হঠাৎ আনন্দ এসে যাওয়ার জন্যে দুঃখবোধের সাময়িক বিলুপ্তি হয়৷ এই যে বিশেষ আনন্দের অবস্থা একে বলে ভাব সমাধি৷ ভাবসমাধি যার হয় সেও ভক্ত৷ কিন্তু দ্বৈতভাব, দ্বৈতৰুদ্ধি–’আমি ও আমার ইষ্ট’–এইভাব থেকে যায়৷ পরমপুরুষ থেকে সমস্ত সত্তার উৎপত্তি৷ তাহলে আমি আর পরমপুরুষ–দু’টো সত্তা কীভাবে থাকতে পারে ভাবসমাধিতে এর ওপরে মানুষ উঠতে পারে না৷ আর যখন ভাবসমাধি হয়, তখন সে আনন্দে থাকছে, কিন্তু অন্য সময়, সে সাধারণ মানুষ৷
যে ভক্ত এই অবস্থা থেকে আরও কিছুটা এগিয়ে যায়, যে ৰোঝে না–আমি আর আমার ইষ্ট এক–কিন্তু আবার পরমাত্মার প্রতি যতটা প্রেম, তার চেয়ে বেশী তাঁর গুণের কথা ভাবতে থাকে, এই অবস্থায় তার মধ্যে পরমাত্মার অনেক গুণ এসে যায়৷ কিন্তু পরমাত্মার সঙ্গে স্থায়ী মিলন, স্থায়ী সমাধি কখনও হয় না৷ একে বলা হয় গুণাত্মক সমাধি৷ গুণাত্মক সমাধিতে হয় কি? সাধকের মধ্যে গুণভাব অধিক হয়ে যায় আর দ্বিতীয় কথা, তার মনের ইচ্ছা থাকে, আমি এই যে পৃথিবীতে এসেছি, এখানে এমন কিছু করে যাব, যাতে আমার এই যে শরীর, এই যে মন, এই আত্মা সার্থক হয়৷
তাহলে কী ধরনের ভাবনা থাকা উচিত? পরমাত্মার কৃপায় আমার শরীর, মন ও আত্মা প্রাপ্ত হয়েছে, আমার মধ্যে যে শক্তি, সাহস ও গুণ আছে, এ সবই পরমপুরুষের লীলা৷ তাই আমার যা কিছু শক্তি, সাহস ও গুণ–সবকিছুকে পরমপুরুষের এই সৃষ্ট জগতের সেবায় লাগিয়ে দোব৷ তাহলে হবে কী? আমার পরমপুরুষ আনন্দ পাবেন৷ এ ধরনের ভক্তকে বলা হয় ‘গোপ’৷ ‘‘গোপায়তে যঃ সঃ গোপঃ৷’’ ‘গোপায়তে’ মানে পরমপুরুষকে আনন্দ দেওয়া৷ আর যে পরমপুরুষকে আনন্দ দেয় সে হচ্ছে ‘গোপ’৷ অর্থাৎ পরমপুরুষকে আনন্দ দেওয়া যার স্বভাব তাকে বলা হয় ‘গোপ’৷ গোপ মানে যে গোপালন করে–তা নয়৷ এই উচ্চ স্তরের ভক্তেরা গুণাত্মক সমাধিও চাইবে না৷ পরমপুরুষের গুণের দিকে তাদের মন থাকবে না৷ তাদের একমাত্র ধ্যান–জ্ঞান হবে, এই যে শরীর, এই যে মন, এই যে আত্মা আমি পরমপুরুষের কৃপায় পেয়েছি৷ আমার এই যে শক্তি, এই যে সামর্থ্য, এই যেটুকু গুণ–এ সব আমি জগতের সেবায় লাগিয়ে দোব, কারণ এ জগৎ পরমাত্মারই৷ জগতের সমস্ত মানুষ বা যা কিছু–‘আব্রহ্মস্তম্ব’ অর্থাৎ ঈশ্বর থেকে শুরু করে সাধারণ স্তম্ব অর্থাৎ ঘাসের পাতা–এ সমস্তই পরমাত্মার বিকাশ৷ আমি কী করব? আমি আমার সামর্থ্য অনুসারে এই সবের সেবা করব৷ কেন সেবা করব? কারণ, সেবা করলে আমার ইষ্ট–আমার ভগবান সন্তুষ্ট হবেন৷ তিনি আনন্দ পাবেন৷ আমি এইজন্যেই সেবা করব৷ এইটাই হচ্ছে গোপীভাব৷ পরমাত্মার তুষ্টিবিধানের জন্যে যে নিজের সবকিছু উৎসর্গ করে দেয়, নিজের ষোল আনা জগতের সেবায় নিয়োজিত করে, সে–ই প্রকৃত ভক্ত৷ অন্য তথাকথিত ভক্তরা প্রকৃত ভক্ত নয়৷