‘‘যে কোনো সমাজে বা সমাজ সংরচনায় সদস্যদের মধ্যে একতা একান্ত অপরিহার্য৷ তা না হলে সামাজিক সংরচনা বিপর্যস্ত হতে বাধ্য৷ সমাজ সদস্যদের অত্যধিক বৈয়ষ্টিক স্বার্থকেন্দ্রিকতার ফলে একতার অভাব অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভিত্তিক দল সৃষ্টি, অন্যের কার্যধারা বোঝার মত মানসিক উদারতার অভাব --- এগুলো শুধু কোন সমাজের অধঃপতনেরই সূচনা করে না, এগুলো ওই সমাজকে ধরা পৃষ্ঠ থেকে একেবারে নিশ্চিহ্ণ করে দেয়৷ এই পৃথিবীর ইতিহাসে বহুদল ও সাম্রাজ্যের অবলুপ্তির দৃষ্টান্ত বিরল নয়৷’’ (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) তাই সুষ্ঠু সমাজ বা সমাজ ব্যবস্থার জন্য সদস্যদের একতা অপরিহার্য৷ বর্ত্তমানে আমাদের বাঙলায় এই একতার অভাব৷ এইভাবে চলতে দিতে গেলে ভবিষ্যতে বাঙলার অস্তিত্ব বিপর্যস্ত হবে৷
ভারত তথা সারাবিশ্বের ঐক্যও আনতে হবে তবে তা ধাপে ধাপে আর সে পরের কথা৷ সর্ব প্রথম আমাদের বাঙলার ঐক্য আনা৷ বাঙলায় ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক ভাবাবেগকে, জাত-পাত ভাবাবেগকে,রাজনৈতিক দলীয় ভাবাবেগকে বা অত্যধিক স্বার্থকেন্দ্রিক ভাবাবেগকে প্রাধান্য দেওয়ার ফলে আর আদর্শহীন অর্থনৈতিক দল সৃষ্টি হওয়ার ফলে বাঙলার শান্তি বিঘ্নিইত হচ্ছে, বাংলায় আজ অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে৷ বাঙলা ও বাঙালীর ঐক্যের জন্য সর্বপ্রথম চাই সকলের সাধারণ ভাবাবেগ--- আর তা হলো একমাত্র বাঙালী ভাবাবেগ৷
বাঙলার প্রতিটি মানুষের চাই নিরাপত্তার ব্যবস্থা, সুবিচারের ব্যবস্থা ও শৃঙ্খলা, কু-সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসহীন মনোভাব৷ কু-সংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস মানব মনের শান্তি বিঘ্নিত করে৷
বাঙলার ক্ষেত্রে বাঙালী ভাবাবেগ হলো প্রকৃতি প্রদত্ত ভাবাবেগ আবার অন্যদিকে সম্প্রদায়গত ভাবাবেগ, রাজনৈতিক দলভিত্তিক ভাবাবেগ সেগুলি হলো মানুষের কাছে আরোপিত ভাবাবেগ, যা অস্থায়ী ভাবাবেগ যে কোন মুহুর্ত্তে মানুষ তা বদলাতে পারে৷ আর বদল হয়ে চলছেও৷ সম্প্রদায়গত ভাবাবেগ হিসাবে বাংলার মানুষ এককালে শৈব ভাবাপন্ন ছিল৷ তারপর সেই মানুষগুলো বৌদ্ধ ও জৈন হয়ে গেল৷ পরবর্ত্তীকালে বাঙলার বৌদ্ধ ও জৈন মতাবলম্বীর মানুষেরা শঙ্করাচার্যের পৌরাণিক মতবাদ গ্রহণ করল আর বাকী মানুষ ইস্লাম মতবাদ গ্রহণ করল৷ এর পরবর্ত্তীকালে বাঙলার কিছু মানুষ শ্রীচৈতন্য দেবের বৈষ্ণব মত গ্রহণ করল আর ব্রিটিশ শাসনকালে কিছু মানুষ খ্রিষ্টান মত গ্রহণ করে৷ আর রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তো দেখছি কায়েমী স্বার্থবাদী ও সুবিধাবাদী মনোভাব--- আজ এক পার্টিতো কিছুদিন পরে অন্য পার্টিতে সামিল হওয়ার হিড়িক৷ স্বাধীনতার পরবর্ত্তীকালে বাংলার বেশীর ভাগ জনগণ ছিল কংগ্রেস পার্টির পরবর্ত্তীতে বামফ্রন্টে আর পরে তৃণমূল পার্টিতে আর আজ তৃণ ছেড়ে বিজেপিতে যাচ্ছে ও দিল্লীর তাবেদার হয়েছে৷ কিন্তু বাংলার ওই সব মানুষ সব সময় রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানে, ভাষা ও সংসৃকতিতে বাঙালী থেকে গেছে ও থেকে যাবে৷ অর্থাৎ বাঙালী ভাবাবেগ হল স্থায়ী ভাবাবেগ যা প্রকৃতিসৃষ্ট ভাবাবেগ৷ আর সাম্প্রদায়িক ও রাজনৈতিক দলীয় ভাবাবেগ অস্থায়ী ভাবাবেগ আজ আছে তো কাল নেই৷ এর সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলো বাংলাদেশ ঘটিত হওয়া৷ বৃটিশ সরকার ভারতীয়দের হাতে শাসন ক্ষমতা হস্তান্তরিত করার সময় ধর্মের ভিত্তিতে দ্বি-জাতি তত্ত্ব -উত্থাপন করে ও ভারতের হিন্দু ও মুসলমান যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে থেকে সহ অবস্থান করছিল তা নষ্ট করে পরস্পরকে শত্রুভাবাপন্ন করে তোলে৷ ফলে মুসলমানদের জন্য ভারতের মধ্যে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ স্থানকে নিয়ে পাকিস্তান নামে নোতুন রাষ্ট্র তৈরী হয়৷ ভারতের পশ্চিমে অবস্থিত পাকিস্তানের নাম হয় পশ্চিম পাকিস্তান আর পূর্বের পাকিস্তানের নাম পূর্ব পাকিস্তান যা বর্তমানে হলো বাংলাদেশ৷
তথাকথিত পূর্ব-পাকিস্থানের মানুষ উর্দুভাষাকে তাদের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মেনে না নেওয়ার প্রতিবাদ করে ও বাংলা ভাষার দাবীতে আন্দোলন করে৷ এই আন্দোলনে তৎকালীন পাকিস্থানের প্রেসিডেন্ট ইহাহিয়া খান সরকারের পুলিশের গুলিতে ১৯৫২ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারী রফিক, বরকত, আব্দুল জাফর, সালাউদ্দিন ও আতাউর রহমান এই পাঁচ তরুণ ছাত্রের প্রাণ যায়৷ এঁরা মাতৃভাষা বাংলা রক্ষার্থে প্রাণ বিসর্জন করেন৷ এর পরবর্তীকালে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরীর জন্য তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ‘মুক্তি যুদ্ধ’ করেন ও স্বাধীন বাঙলা দেশ নামে এক নোতুন রাষ্ট্র তৈরী করেন’ আজ সে দেশের জাতীয় সংগীত বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ---‘‘আমার সোনার বাংলা---’’ ওই বাংলাদেশের কয়েকজন যুবকেরা ওই ২১শে ফেব্রুয়ারী’’ দিনটিকে জাতি সংঘে ভাষা দিবস হিসাবে মান্যতা প্রাপ্ত করিয়েছেন৷ আজ বিশ্বের সকল ভাষাভাষীর মানুষ এই ২১শে ফেব্রুয়ারী দিনটিকে তাদের ভাষা দিবস হিসাবে উদ্যাপন করে চলেছে৷ এই থেকে আমরা এই শিক্ষা পাই যে মুসলমান ধর্মের ভাবাবেগ, যে ভাবাবেগের জন্য পূর্ব পাকিস্তান ঘটিত হয়েছিল৷ তার থেকে বড় কথা হলো বাঙলা ভাষা ও সংসৃকতির ভাবাবেগ৷ এই ভাবাবেগ বাংলা মাটির সঙ্গে বাংলার মানুষের সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত৷ তাই বলছি বাংলার পরিবেশে, বাংলার মাটিতে ভাষা ও সংসৃকতির ভাবাবেগটা হলো স্থায়ী ভাবাবেগ৷ আর ওপর থেকে গৃহীত যে সকল ভাবাবেগ তা সম্প্রদায়গত বা মতবাদগত হোক বা রাজনৈতিক দলগত ভাবাবেগ হোক, ওসবের থেকে বাঙলাভাষা, বাংলার সংসৃকতি আদিকে সর্র্বেপরি মান্যতা বাঙালীমাত্র কে দিতে হবে৷ এর ফলে বাঙালী জাতির মধ্যে একতা আসবে ও তখনই বাঙলার বিকাশ ও প্রগতি হবে তখনই আমরা উন্নত বাঙলা তৈরী করতে পারব৷ রাজনৈতিক পার্টিগত বিভেদ রেখে ও কায়েমী স্বার্থবাদী হয়ে বাংলার বিকাশ কোনদিনই হবে না, বাংলাতে শান্তি ও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না৷ তাই বলি বাংলার মাটিতে বাংলার জলবায়ুতে, বাংলার পরিবেশে যারা লালিত পালিত হচ্ছেন-তারা হিন্দু হলেও বাঙালী, মুসলমান হলেও বাঙালী, কোন রাজনৈতিক দলের লোক হলেও বাঙলা, বিহার-রাজস্থান, গুজরাট, দক্ষিণ ভারত, উত্তর ভারত থেকে এসে যারা বাঙলায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছে তারাও বাঙালী৷ তাই বাঙলার মাটি ও জল হাওয়ায় যারা রয়েছি-আমরা সকলেই বাঙালী৷ তাই সমস্বরে বলুন---‘আমরা বাঙালী’ ‘আমরা সবাই বাঙালী’ আমরা হিন্দু মুসলমান- না বলে বলব আমরা বাঙালী আমরা খ্রীষ্টান-বৌদ্ধ-জৈন না বলে, বলব ‘আমরা বাঙালী’৷ আমরা বিহারী-মাড়োয়ারী-গুজরাটী, দক্ষিণের ভারতীয়-উত্তর ভারতীয় না বলে বলব ‘‘আমরা বাঙালী’’৷ প্রথমেই বলেছি একতা না হলে কোন সমাজে শান্তি শৃঙ্খলা থাকবে না৷ তাই আমাদের সুখ-সম্মৃদ্ধি ও শান্তির জন্যে চাই একতা৷ আর এই একতার জন্য চাই এক ভাবাবেগ ‘আমরা বাঙালী’৷ খাব দাব-পরব বাঙলার সম্পদ থেকে৷ লালিত-পালিত হব বাংলার মাটি ও আবহাওয়াতে আর বলব---আমি হিন্দু বা মুসলমান, আমি বিহারী,আমি মাড়োয়ারী, আমি রাশিয়ান পন্থী, আমি চীন পন্থী, আমি দিল্লীপন্থী---এসব বললে তবে তা হবে বিভেদ সৃষ্টি করা৷ যারা ভেদ-বিভেদ সৃষ্টি করে তারা তা করে থাকে মানুষকে শোষণ করার জন্য৷ কায়েমী স্বার্থপূরণ করার জন্যে৷ এরাই মানবতার শত্রু৷ এরাই বাংলার শত্রু৷ এদের ভালভাবে চিহ্ণিত করে নিতে হবে৷ আর পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান ভাইদের বলব বাংলাদেশের মুসলমান ভাইদের মত বাংলা ভাষা ও সংসৃকতিকে সাম্প্রদায়িক মতামত থেকে উধের্ব যেন স্থান দেয় যাতে পূর্বের মত হিন্দু মুসলমান সম্প্রীতি বজায় থাকে ও বাঙলার ঐক্য এনে পরস্পর যেন সুখে-শান্তিতে বাঁচতে পারি৷ আর বাঙলার বাঙালী হিন্দু ও অ-হিন্দুদের মনে রাখতে হবে তাদের কাছে হিন্দুত্বের থেকে বাঙালী ভাবধারাটাই সবচেয়ে বড় কথা৷
- Log in to post comments