সমাজে মানবিক প্রয়াস যেমন চারটে স্তরে বিন্যস্ত হয়ে রয়েছে –– কাম, অর্থ, ধর্ম, মোক্ষ৷ এই চতুর্ধাবিন্যস্ত মানুষের কর্মৈষণা তথা কর্মতৎপরতাকে আমরা বলি ‘চতুর্বর্গ’৷ এই চতুর্বর্গের মিলিত প্রয়াসেই সমাজের সামূহিক কল্যাণ, সামূহিক পরিণতি৷ কোনোটা সম্পূর্ণ ভাবে জাগতিক তথা পাঞ্চভৌতিক ক্ষেত্রে, কোনোটা পাঞ্চভৌতিক ক্ষেত্রের সঙ্গে মানসিক ক্ষেত্রকে সংযুক্ত করেছে, কোনোটা কেবল মানসিক আর কোনোটা মানসিক ক্ষেত্র ছেড়ে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে, এই ভাবে বিভক্ত হয়ে রয়েছে৷ মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসগৃহ –– এই যে পাঞ্চভৌতিক প্রয়োজনগুলো, এগুলো হ’ল কাম৷ তার পরেই হ’ল অর্থ – যা মানুষ বিভিন্ন ধরনের চিন্তার ভেতর দিয়ে যে সার জিনিসকে খুঁজে পাচ্ছে, চিন্তাক্ষেত্রে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছুচ্ছে, যা নিয়ে গবেষণা করছে –– সাহিত্য, শিল্প ইত্যাদি এ সমস্তই অর্থের মধ্যে আসে৷ আমি এর আগে বলেওছি যে অর্থ মানে হ’ল যার দ্বারা অভাব দূর হয়, যার দ্বারা দুঃখ দূর হয়৷ যেমন, কেউ খেতে পাচ্ছে না৷ যে জিনিসের সাহায্যে সে খেতে পেলো, সেটা হ’ল অর্থ –– কারণ অভাব দূর হয়ে গেল৷ এই অর্থে অর্থ মানে টাকা পয়সা৷ আবার মনে প্রশ্ণ জেগেছে, প্রশ্ণের উত্তরটা পাচ্ছি না৷ খুঁজতে খুঁজতে উত্তরটা পেয়ে গেলাম৷ এই অর্থ মনের অভাব দূর করল, সুতরাং এটাও অর্থ৷ এই অর্থে বাংলায় এটাকে বলা হয় ‘মানে’৷ এই জিনিসটার মানে কি, তাকে বলি এই জিনিসটার অর্থ কি? কারণ মানসিক অভাব সেখানে দূর হচ্ছে –– এই হ’ল অর্থ৷
আর তৃতীয় হ’ল কী? ধর্ম৷ মানুষকে একটা বিশেষ নিয়ম মেনে চলতে হবে জীবনের সর্বক্ষেত্রে৷ এমন কোনো ক্ষেত্র নেই, যেখানে নিয়মের বাইরে গিয়ে পার পাবো, উপায় নেই, সব ছকে বাঁধা ও সেই নিয়মটা অনুশীলন করলেই মানুষের কল্যাণ হবে৷ কারণ সেই নিয়ম মেনে চলার যা পরিণতি নির্দিষ্ট রয়েছে, নিয়ম মেনে চললে সেখানে পৌঁছে যাবে৷ এইটাই হ’ল ধর্ম৷ জল একটা ধর্ম মেনে চলে, আগুন ধর্ম মেনে চলে, গোরু ধর্ম মেনে চলে, মোষ ধর্ম মেনে চলে৷ এই বিশেষ বিশেষ জীবের যে অস্তিত্ব নির্ধারক ধর্ম এটা জানা থাকলে তারও লাভ, অন্যেরও লাভ৷ যে মোষ পুষেছে, মোষের স্বভাব জানলে সে ঠিক ভাবে মোষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে৷ আগুনের স্বভাব জানে যে বিজ্ঞানী, সে জানে যে আগুন এই ভাবে চলে, আগুনের থেকে সে নানা রকমের কাজ আদায় করে নিতে পারবে৷ তেমনি মানুষও একটা বিশেষ ধর্ম মেনে চলে৷ সেই ধর্মটা হ’ল ভাগবত ধর্ম৷ সে ধর্ম সবাইকেই মেনে চলতে হবে –– পণ্ডিত–মূর্খ, কালো–ফর্সার বিচার সেখানে নেই৷ অর্থাৎ সব মানুষের এক ধর্ম৷ একথাটা আমি বারবার বলে এসেছি৷ ধর্ম মানে হিন্দু ধর্ম, মুসলমান ধর্ম নয় ওগুলো ধর্ম নয়, ওগুলো উপধর্ম৷ ধর্ম যা, তা মানুষমাত্রেরই এক ও সেটা মেনে চলতে হবে৷ না মানলে তারও বিপদ, সমাজেরও বিপদ৷ এটা হ’ল তৃতীয় বর্গ৷ আর চতুর্থ বর্গ হচ্ছে মোক্ষ৷ সমস্ত চলার পথে যে শেষ বিশ্রান্তি, যা পরমা সম্প্রাপ্তি, সেইটাই হ’ল মোক্ষ৷ এই ভাবে ও এই কথাগুলো বুঝে মানুষকে চলতে হয়, চলতে হবে৷ একেই বলি ‘চতুর্বর্গ’৷
এখন মানুষ অনাদিকাল থেকেই চলে চলেছে, ও তাকে তার এই যে জীবনের চারটে বর্গ, এটাকে মনে রেখে চলতে হবে ও এই মনে রাখাটা মানুষকে প্রতিপদে প্রতি পদ–বিক্ষেপে মনে রেখে চলতে হবে৷ তাহলে জীবনে তাকে কখনও হতাশাগ্রস্ত হতে হবে না৷ সবচেয়ে বড় কথা হ’ল, মানুষ পৃথিবীতে এসেছে খুব কম দিনের জন্যে, খুব কম সময়ের জন্যে ও এর মধ্যে তাকে সব কাজ সারতে হবে৷ যেমন যে বুদ্ধিমান মেয়ে সে সকাল বেলায় কী করে? প্রথমে উনুনে আগুন দিয়ে রাখল, তার পরে তার কয়েকটা কাজ সেরে রাখল এমন ভাবে সারে যে বাড়ীর পুরুষেরা বা ছেলেমেয়েরা কর্মক্ষেত্রে বা সুক্ল কলেজে যাওয়ার আগে রান্নাটা হয়ে যায়৷ কাজ সাজিয়ে রাখে সে, যদি সাজিয়ে রাখাতে গলদ থেকে যায়, গোলমাল থেকে যায় তাহলেই সব নষ্ট হয়ে যাবে৷ ঠিক তেমনি এটা যে কেবল সকাল বেলায়, বেলা দশ–এগারটা পর্যন্ত কাজ সাজিয়ে রাখা তা নয়, গোটা জীবনটাতেই কাজ সাজিয়ে রাখতে হবে৷ এই সাজানোর ত্রুটি হলেই শেষ পর্যায়ে গিয়ে বিপর্যয় দেখা দেবে৷ আর সাজানোর ত্রুটি না থাকলে গোটা জীবনটায় আনন্দে হাসতে হাসতে দিন কাটবে, এই হচ্ছে নিয়ম৷ বাংলায় একটা প্রচলিত কথা আছে, ‘যে রাঁধে সে কি চুল বাঁধে না’? সব কিছু তাকে সারতে হচ্ছে বাঁধা সময়ের ভেতরে, পেছিয়ে থাকলে চলবে না৷
অনেকে বলে, কম বয়সে কেবল লেখাপড়াই শিখবে৷ দ্বিতীয় স্তরের বয়সটায় অর্থ উপার্জন করবে, তৃতীয় স্তরের জীবনটায় সামাজিক প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করবে আর চতুর্থ স্তরে কেবল ধম–কর্ম করবে –– জিনিসটা একেবারেই ভুল৷ ধর্ম তো স্তরবিন্যস্ত হয়ে রয়েছে৷ প্রতিটি দিনের ব্যাপার সেটা, বার্ধ্যক্যের জন্যে রেখে দেওয়া তো চলে না তাকে৷ অর্থাৎ কম বয়সে কী করবে? লেখাপড়াও করবে, ধর্মও করবে অর্থাৎ চতুর্বর্গের কাজটিও সারবে৷ আবার দ্বিতীয় স্তরেতে অর্থোপার্জন করবে, কেউ চাকরি করবে, কেউ চাষ করবে, কেউ ব্যবসা করবে৷ সব কাজই সমান মহৎ, সব কাজই সমান বড়৷ একটা রাস্তা তাকে নিতে হচ্ছে, নেবে ও তার সঙ্গে ধর্ম সাধনা করবে, চতুর্বর্গের সাধনা করবে৷ তৃতীয় স্তরে সামাজিক প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করছে, ও তার সঙ্গে সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিচ্ছে, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছে, বাড়ী করছে –– এই সমস্তগুলো সামাজিক প্রতিষ্ঠার কাজ ও তার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মও করছে৷ চতুর্থস্তরে গিয়ে জাগতিক আর কোন বড় দায়িত্ব থাকছে না৷ তাই পুরোপুরি সময়টাই ধর্ম সাধনার দিয়ে দিচ্ছে৷ এইটাকেই লোকে ভুল করে ভাবে যে, বুড়ো বয়সটাই বুঝি ধর্ম সাধানার জন্যে৷ ধর্মসাধনা করতে গেলে স্নায়ুকোষ মজবুত রাখতে হয়, মন মজবুত রাখতে হয়৷ বুড়ো বয়সে সেগুলো সে কি পারে? আজ পেট খারাপ হচ্ছে, কাল পিঠব্যথা হচ্ছে, পরশু মাথা ব্যথা করছে, তরশু অম্বল হচ্ছে –– এই চলছে তো৷ কম বয়সে যে কাজগুলো করেছিল, বেশী বয়সে সে কাজগুলো থাকছে না, ধর্মেরও অভ্যাস রাখে নি৷ তার ফলে কখনো রান্নাঘরে ঢুকে বলবে –– ‘বড় বউমা? আজকে কিসের ডাল রাঁধছো৷’ বড় বউমার সেটা ভাল লাগবে না৷ এখন অনধিকার চর্চা করতে বসে কারণ ধর্মের সাধনা সে করেনি, বুড়ো বয়সে ওইটা নিয়ে আর থাকে কী করে? পাঁচজনে মিলে বসলো, ‘তা আমাদের সময়ে অমুক সাহেব এরকম ছিল, অমুক অফিসার এরকম ছিল’ –– এই সব চর্চা করছে৷ কারণ অভ্যাস করে নি বাংলায় বলে না, মরণকালে হরির নাম আসে না, চির জীবন ধরে অভ্যাস করতে হয়৷
শৈশবে, কম বয়সে –– শুধু শৈশবে নয়, বাইশ, চব্বিশ পঁচিশ এমনি বয়স পর্যন্ত – লেখাপড়ার চর্চা তার সঙ্গে ধর্মচর্চা, ধর্মচর্চাটা একটা কমন (Common) জিনিস রইল৷ ধর্মচর্চা মানে এখানে চতুর্বর্গের অঙ্গীভূত জিনিস৷ তারপরে অর্থোপার্জন কর, নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী কেউ কৃষিতে যাও, কেউ শিল্পে যাও, কেউ বাণিজ্যে যাও, কেউ চাকরিতে যাও, কেউ অধ্যাপনায় যাও, কোনটাই ছোট কাজ নয় বা কোনটাই বড় কাজ নয়৷ ওটা একটা রাস্তা, নিতেই হয়৷ তৃতীয় স্তরেতে ঠিক তেমনি প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা কর, ঠিক তেমনি ধর্মচর্চাটি ঠিক রাখ৷ এখন শেষে গিয়ে তুমি আগেকার তিনটে স্তরে ধর্মচর্চ্চা করে ঘুরে এসেছ, এখন অফুরন্ত অবকাশ পাচ্ছ৷ প্রাণভরে ধর্মসাধনা কর, অন্য কর্তব্য বড় একটা থাকছে না৷ এইটাই বুদ্ধিমানের কাজ৷ তা নইলে একটু আগেই বললাম, বুড়ো বয়সে অপ্রিয় হতে হবে, অবাঞ্ছিত হতে হবে৷ বুড়ি শ্বাশুড়ি পুত্রবধূর কাজে কেবল নাক গলাচ্ছে, আর তখন পাড়ার লোকেরা বলছে, আর কেন, এবার কাশীবাস করগে যাও৷ কিন্তু সে কাশী যেতে চাইবে না, কারণ মনকে সে সেভাবে তৈরী করেনি৷ একটা গল্প আছে না, একজন বৃদ্ধা মারা যাচ্ছেন, আর মারা যাচ্ছেন তখন ছেলেরা সবাই তাকে ঘিরে ধরেছে, যাতে বুড়ি শান্তিতে মারা যেতে পারে৷ বুড়ি তখন বলছে –– ‘বড় বউমা, হাঁড়ি চড়িয়েছ কি না? মেজ বউমা, কাপড় কাচা হয়েছে কি না, খেঁদি তুই জলখাবার খেয়েছিস কিনা – এই সমস্ত চলছে৷ তখন ছেলেরা বলছে, ‘মা ওসব তো চিরদিনই করেছ, বড় বউমা হাঁড়িও চড়াবে, আর মেজ বউমা কাপড়ও কাচবে আর খেঁদিও জলখাবর খাবে, ওসব এখন না ভেবে এখন হরি বল, হরি বল৷ বল, ‘হরি, হরি’৷ বুড়ি তখন বিরক্ত হয়ে উঠল, কারণ গোটা জীবন তো ওসব অভ্যাস করেনি, সুতরাং বলছে, ‘আমি মরণকালে অত বড় কথা বলতে পারছি নারে বাবা৷’ –– এটা বলতে পারলো কিন্তু হরি বলতে পারলো না৷ মানুষকে এই বুঝে, মাপ করে, এই স্তর বিন্যস্ত ভাবে এগিয়ে চলতে হবে৷ এইখানে গোলমাল হলেই সব কিছু গোলমাল হয়ে যাবে৷ এই কথাটা ছোট বড় নির্বিশেষে, স্ত্রী–পুরুষ নির্বিশেষে, বিদ্বান– মূর্খ নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে প্রতিটি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে৷ এই মনে না রাখলেই কেবল ব্যষ্টিগত জীবনে বা পারিবারিক জীবনেই বিপর্যয় আসবে তা নয় সামূহিক জীবনে, সমাজ জীবনেও বিপর্যয় হতে বাধ্য৷ একথা তোমরা সবসময়ে মনে রেখো৷
২৫ ডিসেম্বর ১৯৭৯, সকালবেলা, কলিকাতা