দধীচি দিবসের তাৎপর্য

লেখক
আচার্য সত্যশিবানন্দ অবধূ্ত

১৯৬৭ সালের ৫ই মার্চের ঘটনা৷ ওই দিন আনন্দমার্গ প্রচারক সংঘের প্রধান কেন্দ্র আনন্দনগরের ওপর কম্যুনিষ্ট গুণ্ডারা আক্রমণ চালিয়ে ৫ জন সন্ন্যাসীকে নৃশংসভাবে খুন করেছিল৷

তখন সরকার চালাচ্ছিল যুক্তফ্রণ্ঢ৷ জ্যোতি বসু ছিলেন রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী৷ আনন্দনগরের ওপর এই আক্রমণের মূল হোতা ছিল সিপিআই ও সিপিএম৷ সরকার পক্ষ এই নৃশংস আক্রমণকে গণরোষ বলে প্রচার করে’ মামলাটিকে বাতিল করে দেয়৷ পরে কম্যুনিষ্টরা গদীচ্যুত হলে এই মামলাটি পুনরায় চালু করা হয়৷ শেষ পর্যন্ত আদালতের রায়ে আনন্দমার্গের সন্ন্যাসীদের নৃশংসভাবে খুনের দায়ে স্থানীয় বি.ডি.ও অশোক চক্রবর্ত্তী সহ ১৮ জনের বিভিন্ন মেয়াদের কারাদণ্ডাদেশ হয় ও ৮ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়৷ বিচারক তাঁর রায়ে বলেন, এই আক্রমণ ও হত্যাকাণ্ডে শাসক কমিউনিষ্ট দলের মুখ্য ভূমিকা ছিল৷

যে পাঁচজন খুন হয়েছিলেন তাঁরা হলেন আচার্য অভেদানন্দ অবধূত, আচার্য সচ্চিদানন্দ অবধূত, প্রভাস কুমার, ভরত কুমার ও অবোধ কুমার৷

পুরাণের কাহিনী রয়েছে, অসুরদের আক্রমণে দেবতারা স্বর্গরাজ্য থেকে বিতাড়িত হয়ে ব্রহ্মার কাছে অসুর–দমনের উপায়ের সন্ধানে যান৷ তখন ব্রহ্মা বললেন, কেউ যদি স্বেচ্ছায় আত্মদান করেন, তাহলে তাঁর অস্থি দিয়ে নির্মিত বজ্রের সাহায্যেই কেবল দেবরাজ ইন্দ্র অসুররাজ বৃত্রাসুরকে বধ করতে পারবেন ও স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারবেন৷ কিন্তু নিজের অস্থিদান করবেন কে? এগিয়ে এলেন দধীচি মুনী৷ ‘দধীচি ত্যাজিলা তনু দেবের মঙ্গলে৷’ দধীচির অস্থি দিয়ে দেবরাজ ইন্দ্র নির্মাণ করলেন বজ্র৷ আর সেই বজ্রে নিহত হ’ল বৃত্রাসুর৷ স্বর্গরাজ্য পুনরুদ্ধার হ’ল৷ এই পুরাণ কাহিনীতে দধীচি হলেন এক প্রতীকী চরিত্র যিনি অশুভ শক্তির কবল থেকে শুভ শক্তিকে তথা মানবতাকে রক্ষা করতে ‘আত্মদান’ করেন৷

মানবসমাজে সে সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রয়েছেন, যাঁরা সৎ, ধার্মিক ও জগৎকল্যাণ যাঁদের ব্রত  শাস্ত্র–পুরাণে তাঁদেরই বলা হয় দেব বা সুর৷ আর সমাজের মধ্যে যারা অনাচার ও ব্যভিচার চালিয়ে যায়, শোষণ ও অত্যাচার করা যাদের স্বভাব–এই ধরণের মানুষদেরই বলা হয় দানব বা অসুর৷

সমাজে চিরকাল এই দেবাসুরের সংগ্রাম চলছে৷ অসুররা যখন সমাজে প্রাধান্য বিস্তার করে ভাল মানুষদের ওপরে–সৎ–নীতিপরায়ণ মানুষদের ওপরে অত্যাচারের ষ্টীমরোলার চালায় তখন নিপীড়িত মানবতাকে বাঁচাতে সৎ, ত্যাগব্রতী মানুষদের এগিয়ে আসতে হয়৷ প্রয়োজনে চরম আত্মত্যাগের জন্যে প্রস্তুত হতে হয়৷ তাঁদের আত্মত্যাগের মূল্যেই ন্যায়–নীতি–মানবতা রক্ষিত হয়৷

মানবতার কল্যাণে এই অশুভ শক্তির সঙ্গে সংগ্রামে যাঁরা প্রাণত্যাগ করে’ অমর কীর্তি রেখে যান প্রকৃতপক্ষে তাঁদেরই বলা হয় ‘দধীচি’৷ এই দধীচিরা যুগে যুগে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভশক্তির সংগ্রামের প্রেরণার উৎস৷ তাঁরা মানব সমাজে চিরনমস্য৷

সারা বিশ্বে আনন্দমার্গ তথা প্রাউটের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারে আজ সমাজের যারা অসুর বৃত্তির মানুষ তাদের হৃৎকম্পন শুরু হয়েছে৷ তাই তারা শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী ও তাঁর অনুগামীদের ওপর বার বার আক্রমণ করছে, যাতে এই আদর্শকে বাস্তবায়িত করতে কেউ না এগিয়ে আসে৷ কিন্তু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজীর অনুগামীরা শত বাধা বিপত্তি, বার বার পাপশক্তির আক্রমণ সত্ত্বেও অকুতোভয়ে এগিয়ে চলেছে ও এগিয়ে চলবে৷

আনন্দমার্গ শোষণমুক্ত বিশ্ব গড়বেই গড়বে৷ পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি নেই যা তাদের গতি রুদ্ধ করতে পারে৷ কারণ, তাঁদের হৃদয়ে রয়েছে জগতের সামূহিক কল্যাণের মহান সংকল্প ও তার সঙ্গে রয়েছে বিশ্বপিতার আশীর্বাদ৷