যোগারূঢ়ার্থে ‘গঙ্গাক্ষেত্র’ বলতে সেই স্থানকে বোঝায় যে স্থান থেকে পদব্রজে এক অহোরাত্রের মধ্যে গঙ্গাতীরে পৌঁছানো যায়৷ বৌদ্ধোত্তর যুগে ভারতে যখন গঙ্গামহিমা প্রবল, অন্যান্য দেব–দেবীর মত গঙ্গাও একটি প্রতিপত্তিশালিনী দেবী, সেই সময় মানুষের গঙ্গাক্ষেত্রে বসবাস করাকে শ্লাঘার জিনিস বলে মনে করত৷ তাদের মনে একটা নিশ্চিততা থাকত যে মৃত্যুর পরে তাদের চিতাভস্ম গঙ্গানীরে একীভূত হয়ে থাকবে৷ সেই সময় একটা অলিখিত নিয়ম তৈরী হয়েছিল যে যারা গঙ্গাক্ষেত্রের অধিবাসী তাদের মধ্যে যারা সঙ্গতিসম্পন্ন তাদের দাহক্রিয়া গঙ্গাতীরে হবে ও তাদের চিতাভস্ম কলসোৎক্রান্ত জলে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেওয়া হবে৷ অস্থি হরিদ্বারে, প্রয়াগ সঙ্গমে বা গঙ্গাসাগরে বিসর্জন দিতে হবে৷ যাঁরা গঙ্গাক্ষেত্রের বাইরে থাকতেন তাঁদের ক্ষেত্রে দাহক্রিয়া যে কোন জলাশয়ে করা যেতে পারে কিন্তু তৎপূর্বে মন্ত্রদ্বারা সেই জলাশয়ের জলকে গঙ্গা অথবা গোদাবরীর (দক্ষিণ গঙ্গা) জলের মত পবিত্র করে নেওয়া হবে ও দাহান্তে অস্থি প্রয়াগ বা হরিদ্বার বা গঙ্গাসাগরে বিসর্জন করা হবে৷ কখনও কখনও এমনও দেখা যেত যে কিঞ্চিৎ অবস্থাপন্ন মানুষেরা বার্দ্ধক্যে উপনীত হবার আগেই নিজের বাস্তুভিটা ত্যাগ করে অথবা বাস্তুভিটার দায়িত্ব পুত্রাদির হস্তে সমর্পণ করে নিজেরা গঙ্গাতীরে এসে বসবাস করতেন৷ যেমন বসবাস করেছিলেন ডাকার অ্যারিয়ল খাঁ থেকে আসা বনমালী ওঝা নদীয়ায় ফুলিয়ার গঙ্গার তীরে৷ এই বনমালী ওঝার পুত্র ছিলেন নামজাদা কবি কৃত্তিবাস ওঝা (মুখোপাধ্যায়) যিনি বাংলা রামায়ণ লিখেছিলেন৷ শ্রীহট্ট জেলার হবিগঞ্জ মহকুমার ডাকা–দক্ষিণগ্রাম থেকে নবদ্বীপে এসে বসবাস শুরু করেন জগন্নাথ মিশ্র৷ তাঁর পুত্র বিশ্বম্ভর মিশ্র পরবর্ত্তীকালে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব নামে বিশ্ববিখ্যাত হয়েছিলেন৷ তোমরা লক্ষ্য করবে তুলনামূলক বিচারে বাংলার অন্যান্য জায়গার চেয়ে হাওড়া–হুগলী–বর্দ্ধম্ ও মুর্শিদাবাদের গঙ্গার তীরগুলোতে শিক্ষিত ব্রাহ্মণ–কায়স্থের বাস বেশী৷ তার কারণও ওই একটাই৷ চব্বিশ পরগণা জেলার দক্ষিণাংশে এই ধরণের সারস্বত মণ্ডলী সেকালে দেখা যায় নি৷ তার কারণ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায় চলেছিল তখনও গঙ্গা বদ্বীপে ভাঙ্গনের লীলাখেলা৷
তোমরা নিশ্চয়ই নজর দিয়েছ এইভাবে গড়ে উঠেছিল বালি, বেলুড়, উত্তরপাড়া, কোন্নগর, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটী, ভদ্রেশ্বর, চন্দননগর, চুচঁড়ো, বাঁশবেড়ে, জীরাট, গুপ্তিপাড়া, কালনা, পূর্বস্থলী, নবদ্বীপ, অগ্রদ্বীপ, দাঁইহাট, কাটোয়া, উদ্ধরণপুর, গঙ্গাটিকরী, ঝামটপুর প্রভৃতি বর্দ্ধিষ্ণু সারস্বত স্থানগুলো৷ ভাঙ্গনের প্রাচুর্য্য থাকায় পূর্বদিকে নামজাদা কয়েকটি স্থান ভাটপাড়া, নবহট্ট (নৈহাটী), কাঞ্চনপল্লী, (কাঁচড়াপাড়া), গৌরীপুর (গরফে), কুমারহট্ট (হালিশহর) বাদে তেমন কোন বড় শহর গড়ে ওঠেনি৷ তাই মানুষের মুখে মুখে কথা উঠেছিল–রাঢ়ের গঙ্গাতীর কাশীর সমান৷ ‘‘গঙ্গার পশ্চিমকূল বারাণসী সমতুল’’৷ স্বামী বিবেকানন্দও সেইজন্যে রাঢ়েতেই তাঁর প্রধান কেন্দ্র স্থাপন করতে চেয়ে ছিলেন৷ সেকালে গঙ্গাক্ষেত্রে বসবাস করার জন্যে মানুষ রাঢ়ের গঙ্গাতীর (ভাগীরথী তীর) বাছত তো বটেই, যাঁরা একটু অবস্থাপন্ন তাঁরা বার্দ্ধক্যে পুত্র–পুত্রবধূর হাতে সংসারের ভার দিয়ে কাশীতে চলে যেতেন৷ অর্থাৎ তাঁরা গঙ্গাক্ষেত্রে বসবাসের জন্যে কাশীবাস করতেন৷ এই ভাবে গত প্রায় দেড় হাজার বছর ধরেই বাঙলার অনেক ব্রাহ্মণ ও কায়স্থ পরিবার কাশীতে গিয়ে বসবাস করে এসেছেন ও আজও করছেন৷ ভাষা ও সংসৃক্তিতে তাঁরা বাঙলার সকল প্রথাকেই মেনে চললেও ভূমিগত দূরত্বের জন্যে যোগাযোগ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছল৷ এজন্যে তাঁরা একটা কাশীয়াল ব্রাহ্মণ সমাজ গড়ে নিয়েছিলেন৷ এতে রাঢ়ী–বারেন্দ্র বৈদিক সব শ্রেণীর ব্রাহ্মণরাই ছিলেন৷ এই কাশীয়াল ব্রাহ্মণরা আজ ছিন্ন–বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন৷ এখন তাঁদের সামাজিক আদান–প্রদান বাঙলার ব্রাহ্মণের সঙ্গেই হয়৷
আমার এক পরিচিত মানুষ ছিলেন৷ নাম কৃষ্ণগোপাল সান্ন্যাল৷ মেয়ের বিয়ের জন্যে তিনি তখন ছুটোছুটি করে বেড়াচ্ছেন৷ একদিন বাজারে বেল কিনতে গিয়ে দেখি পাশেই দাঁড়িয়ে সান্ন্যাল মশাই ..... তিনিও বেলের খরিদ্দার৷
পরের দিন শিবচতুর্দ্দশী কি না সান্ন্যাল মশায় আমাকে বললেন–অণিমার এবার একটা হিল্লে হ’ল৷ অনেক খঁুজে পেতে একটা পাত্র পেয়েছি৷ ছেলের বাড়ী কাশীতে৷ লক্ষ্ণৌয়ের ইঞ্জিনিয়ার৷
আমি বললুম–খুব ভাল কথা, খুব ভাল কথা৷
সান্ন্যাল মশায় বললেন–আসছে রবিবার দিন স্থির হয়েছে৷
পরের দিন সকালে আকন্দ ফুলের দোকানে আবার সান্ন্যাল মশাইয়ের সঙ্গে দেখা৷ তাঁর তখন ম্লান মুখ বিষাদে বিরস৷
আমি বললুম–এ কী হ’ল৷ কালকের পূর্ণিমার পর রাত কাটতে না কাটতে অমাবস্যা একেবারে দিনের বেলায় অমাবস্যা৷ হলটা কী
সান্ন্যাল মশায় বললেন–বিয়ে কেঁচে গেল৷
আমি বললুম–সে কী কথা পাত্রপক্ষের কি খাঁই বেড়ে গেছে, না কোন দুষ্ট মানুষ ভাংচি দিয়েছে?
সান্ন্যাল মশায় বললেন–খাঁইও বাড়েনি, ভাঁঙচিও দেয়নি৷ পাকা দেখা মানে আশীর্বাদ তো হয়েই গেছল৷
আমি বললুম–তবে?
সান্ন্যাল মশায় বললেন–ওরা কেশেল বামুণ, ওদের ঘরে মেয়ে দি কী করে
সান্ন্যাল মশায়ের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল তার পনের বছর পরে একটা দাঁত বাঁধানোর দোকানে৷ দেখলুম সান্ন্যাল মশায় ও তাঁর সঙ্গে বসে আছে অণিমা৷
আমি বললুম–কী ব্যাপার
সান্ন্যাল মশায় বললেন–অণিমার সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে৷ না বাঁধালে চলে না৷ পাত্রপক্ষ দেখলেই বলবে–পাত্রী থুরথুরী বুড়ি আমাদের পাত্রের দিদিমা৷
আমি বললুম–দাঁত তো বাঁধাতেই হবে তবে অণিমার বয়স আর কতই বা হ’ল৷
সান্ন্যাল মশায় বললেন–এমন কিছু নয়৷ এই সবে পঁয়ত্রিশে পা দিয়েছে৷
যাই হোক আমাদের সামাজিক কুসংস্কার আর সেকালের কেশেল ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধে নদীয়ার ব্রাহ্মণদের অনীহার গল্প শুণলে তো এই ফলটা কী ভাল হয়েছিল?
(শব্দ চয়নিকা, ১য়/১০৫)