দেশভাগের বিনিময়ে  স্বাধীনতাপ্রাপ্তি নামক  বিষবৃক্ষের একটি বিষাক্ত ফল এন.আর.সি.

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিন্হা

ভারতের স্বাধীনতা লাভের সাতদশক পরেও  সুপ্রাচীন বাঙালী জনগোষ্ঠীর ভাগ্যাকাশে নোতুন ক’রে কালো মেঘের ঘনঘটা,  আবার একবার  উদ্বাস্তু হওয়ার অশনি সংকেত--- যার প্রেক্ষাপট রচনা করেছে অসমের ‘‘জাতীয় নাগরিকপঞ্জী’’ বা এন.আর.সি৷ ভারতের স্বাধীনতার ৭১তম  বর্ষপূর্ত্তির প্রাক্কালে ৩০শে জুলাই ২০১৮  প্রকাশিত হল অসমের  চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জী  বা এন.আর.সি-র খসড়া যেখানে বাদ পড়েছে ৪০,০৭,৭০৭ জনের নাম  যার বৃহদংশই বাঙালী৷  সরকারী আমলা শ্রীযুক্ত প্রতীক  হাজেলার নেতৃত্বাধীন  এন.আর.সি কর্তৃপক্ষের  বয়ান অনুযায়ী---পূর্র্ণঙ্গ নাগরিকপঞ্জী আগামী ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৮ এর মধ্যে  প্রকাশিত হবে ও  তার আগে বাদ যাওয়া নামগুলি অন্তর্ভূক্তির জন্যে  ৩০শে অগাষ্ট থেকে  ২৮শে সেপ্ঢেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত  নির্দিষ্ট ফর্মে আবেদন করা যাবে৷ এই আবেদনপত্র ৭ই অগাষ্ট ২০১৮ থেকে এন.আর.সি সেবাকেন্দ্রে বা অনলাইনে পাওয়া যাবে৷  এমতাবস্থায়  জনসাধারণের প্রশ্ণ--- ১) এত দিন যে প্রামাণ্য নথির সাহায্যে তালিকায় নাম উঠলো না, পরবর্তী ৩০ দিনের মধ্যে আর কী কী নথি সংগ্রহ করতে পারা যাবে বা  আর কি উপায়ে নাম তোলা যাবে? ২) যদি চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জীতে নাম না থাকে তবে সেই লক্ষ লক্ষ তালিকাছুট মানুষজনের  ভবিষ্যৎ কী? তাঁরা কি ডিটেনশন ক্যাম্পে যেতে বাধ্য থাকবেন  নাকি  ছিন্নমূল হয়ে দেশ থেকে বহিষৃকত হবেন? বিপুল সংখ্যক মানুষ আজ এই ধরণের  নানা প্রশ্ণের ও অনিশ্চিত ভবিতব্যের সম্মুখীন৷  এই প্রশ্ণগুলিকে সামনে রেখেই বর্তমানে সারা দেশ আলোড়িত, সংসদও উত্তাল৷ বিরোধীদলগুলির প্রশ্ণের মুখে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ  জানান- সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশ ও  প্রত্যক্ষ তদারকিতে এন.আর.সি-র খসড়া তৈরী হয়েছে৷ এই বিষয়ে কেন্দ্র বা রাজ্যের বিজেপি সরকারের কোনো ভূমিকা নেই৷  যদিও ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে বিরোধী দলগুলি তথা দেশের সাধারণ জনগণ পুরোপুরি একমত হতে পারেননি৷ সুপ্রিমকোর্ট নাগরিকপঞ্জীর নবীকরণের নির্দেশ দিলেও  কোন্ বিশেষ পন্থা পদ্ধতিতে এই কাজ করতে হবে তা জানায় নি৷ স্বাভাবিকভাবেই  একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি  এই সংবেদনশীল বিষয়টির  সমাধান কল্পে  অতীব আবশ্যকীয় শর্ত৷  ঠিক এই জায়গাটিতেই  সুবিবেচনা ও সহমর্মিতার অভাব আর শাসকগোষ্ঠীর  বাঙালী-বিদ্বেষ প্রসূত মনোভাবের প্রতিই ভুক্তভোগীদের  দৃষ্টি নিবদ্ধ৷  অবশ্য এই বিদ্বেষপূর্ণ  মনোভাব  বা আচরণ  কোন নোতুন ব্যাপার নয়---  প্রাকস্বাধীনতা  পর্ব থেকেই বাঙালী জনগোষ্ঠীর এর সঙ্গে  সম্যক পরিচিতির  অভিজ্ঞতা রয়েছে৷

এখন দেখা যাক, এই নাগরিকপঞ্জী বা এন.আর.সি-র সূত্রপাত কোথায়?  অসমে প্রথম জাতীয় নাগরিকপঞ্জী তৈরী হয়  ১৯৫১ সালে৷ ২০০৯ সালের ২৭ শে জুলাই  অসমে বিদেশী অনুপ্রবেশকারীদের  সমস্যার বিষয়ে  সুপ্রিমকোর্টে প্রথম জনস্বার্থ মামলা হয় --- মামলাটি করেন জনৈক প্রদীপ কুমার ভঁুইঞা ও তাঁর স্ত্রী বন্তি ভঁুইঞা ৷ সেই মামলায় পরবর্তীকালে যুক্ত হয় ‘‘ অসম পাবলিক ওয়ার্কস’’নামে একটি সংঘটন  যার নেতৃত্বে ছিলেন শ্রী অভিজিৎ শর্র্ম৷  এই মামলার  সুবাদে  সুপ্রিমকোর্ট অসমে ১৯৫১ সালের নাগরিকপঞ্জী নবীকরণের নির্দেশ দেন৷ এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৭১ সালের ২৪মার্চের মধ্যরাত পর্যন্ত অসমে বসবাসকারী  ও  তাঁদের বংশধরেরাই নাগরিকপঞ্জীতে নথিভুক্ত হতে পারবেন৷ ২০১৩ সালে  তৎকালীন কংগ্রেস সরকার  শ্রী প্রতীক হাজেলাকে অসমের  এন.আর.সি-র সমন্বয় কারী হিসেবে নিয়োগ করে ও ১৯৫১ সালের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী নবীকরণের কাজ শুরু হয় ৷  ইতোমধ্যে কেন্দ্রে ও রাজ্যে সরকার  পরিবর্তন হয়ে গেছে৷ বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের পর  ৩০শে জুলাই ২০১৮  এই নাগরিকপঞ্জীর চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয়েছে৷ এন.আর.সি তালিকাভুক্ত হওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন ৩,২৯,৯১,৩৮৪ জন, তালিকাভুক্ত হয়েছেন ২, ৮৯,৮৩,৬৭৭ জন  ও  খসড়া তালিকার বাইরে রয়েছে ৪০,০৭,৭০৭ জন ৷  এছাড়াও অসমে  ডি-ভোটার  (ডাউটফুল ভোটার) বা সন্দেহজনক ভোটারের সংখ্যা হচ্ছে  ১,২৫,৩৩৩ জন আর এই ডি-ভোটার ও  তাঁদের বংশের লোকেদের নাম  এন.আর.সিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি গৌহাটি হাইকোর্টের নির্দেশে৷ শুধু তাই নয় অসমের এন.আর.সির পর  উৎসাহিত হয়ে  ত্রিপুরা, মেঘালয়,  ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ ইত্যাদি রাজ্যেও নাগরিক পঞ্জী বা এন.আর.সি তৈরীর দাবী উঠেছে৷ ইতোমধ্যেই মণিপুরের বিধানসভায় ‘‘মণিপুর পিপলস্ প্রোটেকশন বিল, ২০১৮’’ পাশ হয়েছে৷  ওই বিলের মাধ্যমে মণিপুরে ইনার লাইন পারমিট চালু করা যাবে৷  এরফলে  ১৯৫১ সালের আগে যারা মণিপুরে এসেছেন তারাই শুধু থাকতে পারবেন ও  বাকীরা  বহিরাগতরূপে তালিকাবদ্ধ হবেন৷ সঙ্গত কারণেই বহু অমণিপুরী, বিশেষতঃ বাঙলা ভাষাভাষীরা  আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন৷ এমনকি উৎসাহের আতিশয্যে বিজেপি ও তাদের সহযোগী কয়েকটি সংঘটন  পশ্চিমবঙ্গেও  এন.আর.সির মাধ্যমে  বাঙলাদেশী অনুপ্রবেশকারী চিহ্ণিতকরণ প্রক্রিয়া শুরু করার দাবী জানাচ্ছে৷

বস্তুতঃ  বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও  নৃতাত্ত্বিক তথ্য অনুযায়ী অসমসহ উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির বিস্তীর্ণ অংশে  প্রায় দেড়হাজার বছর আগেও বাঙালী জনগোষ্ঠীর বসবাসের নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে৷ আর  মায়ানমারের ইউনান প্রদেশের  ‘তাই’ জনগোষ্ঠীর অহোমজাতিভুক্ত প্রায় আট-নয় হাজার মানুষ ত্রয়োদশ শতাব্দিতে  অসমে এসে বসবাস শুরু করে৷  সুতরাং যে অসমকে অহমীয়ারা নিজেদের স্বভূমি হিসেবে দাবী করছে তা মূলতঃ বাঙালী জনগোষ্ঠীরই অধিকারভুক্ত৷ কিন্তু অহমীয়াদের  অস্তিত্ব রক্ষার ভীতি প্রসূত গা-জোয়ারি, উগ্র সন্ত্রাসের দ্বারা  অতিষ্ঠ হয়ে বিভিন্ন পার্বত্য উপজাতি জনগোষ্ঠী নিজেদের  স্বার্থরক্ষার তাগিদে মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যাণ্ড, অরুণাচল প্রদেশ ইত্যাদি পৃথক রাজ্যে র সৃষ্টি করেছে৷ অন্যদিকে অসমের বাঙালীরা  অহমীয়াদের অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়ে দিনাতিপাত করে চলেছে৷  কালের প্রবাহে  সময় যত গড়িয়েছে, অহমীয়ারা তাদের আগ্রাসন ক্রমাগত বাড়িয়ে গিয়েছে ও  মাঝে মাঝে ‘‘বাঙালী খেদাও’’ আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালী বিতাড়নের প্রক্রিয়া চালু রেখেছে৷ অহমীয়াদের বাঙালী বিদ্বেষকে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অংশ থেকেও  প্রোৎসাহিত করা হয়েছে৷ ধন-ধান্যে-পুষ্পে ভরা সুজলা- সুফলা বাঙলার উর্বর মাটি,  প্রভূত খনিজ-বনজ সম্পদ,  অতি সহজে চাষযোগ্য কৃষিভূমির প্রতি লোভ দেশী বিদেশী সকলের৷ বিভিন্ন প্রশাসক বিভিন্ন সময়ে এই বঙ্গদেশ শাসন করেছেন৷  কেউ এখানকার ধন সম্পদ লুঠ করে নিয়ে গেছে--- আবার অনেকে বাঙলার মানুষের  অমায়িক ব্যবহার সাদাসিধে সরল জীবপযাপন , আত্মীয়তার মধুর আপ্যায়ন, লোকাচার- সংস্কৃতি- ঐতিহ্যের টানে এদেশেই বসতি স্থাপন করে থেকে গেছে৷  বাঙলার মানুষও তাদের আপন করে নিয়েছে৷  এই ভালবাসা, প্রেম,প্রীতির ঐতিহ্যের জন্যেই  বাঙালী এত অত্যাচার, এত নিপীড়ন সহ্য করেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্বমহিমায় ও স্বগরিমায়৷

বাঙালী জনগোষ্ঠীর চারিত্রিক উদারতাকে কোন কোন শাসকসম্প্রদায়, বিশেষতঃ ইংরেজ শাসক শ্রেণী দুর্বলতা ভেবে  বাঙালী জাতিসত্তাকে ধবংস করে ইংরেজীয়ানা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল৷  এই উদ্দেশ্যেই তারা বাংলাকে ভাঙার চক্রান্তে লিপ্ত হয়৷ ব্রিটিশদের ক্রিয়াকলাপ তৎকালীন বাঙালী জনমানসে  এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে ও সহ্যের সীমা অতিক্রান্ত হওয়ায়  শুরু হয় ‘বঙ্গ-ভঙ্গ রদ আন্দোলন’৷  এই আন্দোলনের পর থেকে বাঙালীদের মধ্যে  স্বাধীনতা সংগ্রামের তীব্রতা পরিলক্ষিত হয়৷ মাতৃভূমির পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচনে  দেশপ্রেমের ভাবনায়  আপামর বাঙালী উদ্বুদ্ধ হতে থাকে৷  একদিকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, শরৎচন্দ্র  বসু প্রমুখ দের  নেতৃত্বে  কংগ্রেসের আন্দোলন --- অপরদিকে রাসবিহারী বসু,  সূর্যসেন প্রমুখদের নেতৃত্বে যুব সম্প্রদায়ের দেশভক্তির বৈপ্লবিক চেতনা  ও সর্বস্ব পণ করে  দেশ স্বাধীন করার  সংগ্রাম  ইংরেজ শাসককুলকে  বিব্রত ও অতিষ্ঠ করে তোলে ৷ পরবর্তী পর্যায়ে মহাত্মাগান্ধী, জওহরলাল নেহেরু,  সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বে  কংগ্রেসের বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচি সারাদেশে বিস্তার লাভ করতে থাকে৷ ইংরেজ শাসকেরা এই আন্দোলনকে  পর্যুদস্ত করার চেষ্টা করেও সফল হতে পারে নি৷ শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে  হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের দ্বিজাতিতত্ত্বের  ভিত্তিতে ফাটল ধরাতে সক্ষম হয় ব্রিটিশ শাসকবর্গ৷  ইতোপূর্বে পূর্ণ স্বরাজের দাবী করা সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে  কংগ্রেসের অন্যান্য অবাঙালী নেতৃবৃন্দের মতভেদ প্রকাশ্যে আসে ও চক্রান্তের শিকার হয়ে  সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস ত্যাগ করতে বাধ্য হন৷  এরপর সুভাষচন্দ্র নোতুন দল ‘‘ফরওয়ার্ড ব্লক’’ঘটন করেন ও  স্বাধীনতা সংগ্রামের আগুনকে চতুর্দিকে ছড়িয়ে দিতে থাকেন৷ বিপদ বুঝে ইংরেজ সরকার  তাঁকে গৃহবন্দি করে৷ কিন্তু সুযোগ সন্ধানী সুভাষ একদিন ছদ্মবেশে  ইংরেজদের শ্যেন চক্ষুকে  ফাঁকি দিয়ে দেশত্যাগ করে যুদ্ধের রসদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে  বিদেশে পাড়ি দেন৷  এদিকে বাঙলার ঘরে ঘরে  বিদ্রোহের অনলশিখা  দাউ দাউ করে জ্বলছে৷  মাতৃমুক্তির মন্ত্রে দীক্ষিত দামাল বাঙালী ছাত্রযুবকেরা  বুকের রক্ত ঢেলে অত্যাচারী  ইংরেজ তাড়াতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ৷  অন্যদিকে সুভাষচন্দ্র বসু  ‘‘আজাদহিন্দ বাহিনী’’-র  নেতাজী বা সর্বাধিনায়ক রূপে বিশাল সৈন্যদল নিয়ে দিল্লীর পথে এগিয়ে আসেন ও ভারতের মাটিতে জাতীয় পতাকা ওড়াতে সক্ষম হন৷

ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন’ ও সশস্ত্রবিপ্লবীদের মরণপণ লড়াই আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী  আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির জন্যে  ব্রিটিশ শাসকদের পক্ষে ভারত  ত্যাগ করা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল৷  কিন্তু ধূর্ত শয়তান ব্রিটিশ ভারত ছাড়ার আগে  মরণ কামড় দিয়ে ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন  মিলন ও মৈত্রীর ভিতকে চিরদিনের মতো নষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পনা করে যা ভারতবর্ষের তৎকালীন নেতৃবৃন্দ অনুধাবন করতে পারেননি বা চাননি ৷  একদিকে নেহেরু-প্যাটেল প্রমুখ কংগ্রেস নেতৃত্ব ও অপরদিকে জিন্না-ভুট্টো প্রমুখ  মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে গদির টোপ দিয়ে দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে অখণ্ড ভারতবর্ষকে হিন্দুস্তান ও পাকিস্তান নামে  দুটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন৷ প্রধানমন্ত্রীত্ব ও ক্ষমতার লোভে ভারতবাসীর এতদিনের সংগ্রাম, বিপ্লবীদের  আত্মত্যাগ ও নেতাজী সুভাষচন্দ্রের সম্পূর্ণ স্বরাজের স্বপ্ণকে চূর্ণ করে  নেহেরু-প্যাটেল-জিন্না-ভুট্টোর দল দেশ ভাগে সম্মত হন৷ ফলশ্রুতি হিসাবে আসে  ১৯৪৭ সালের ১৪ই অগাষ্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা  ও ১৫ই অগাষ্টে ভারতের স্বাধীনতা৷ আর এর সঙ্গেই শুরু হয়ে যায় ভারতবর্ষের পূর্ব ও পশ্চিমপ্রান্তে  ভ্রাতা-ভগিনীর রক্তে  পরস্পরের হোলি খেলা৷ একদিকে পঞ্জাব অন্যদিকে বাঙলার বুকে  লক্ষ লক্ষ হিন্দু-মুসলমান (যারা এতদিন নিজেদের ভ্রাতৃসম মনে করত) রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে  জড়িয়ে পড়ে--- ভারতের মাটি ভারতবাসীর রক্তে হয় লালে লাল৷ শুরু হল বাঙলা ও পঞ্জাবের  হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের লোক বিনিময়৷  লক্ষ লক্ষ মানুষ  ভূমিহীন, গৃহহীন, সহায় সম্বলহীন হয়ে  অজানা ভবিষ্যতের অন্ধকারে হলেন নিক্ষিপ্ত৷  তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার   পশ্চিমপাকিস্তান থেকে আগত পঞ্জাবী উদ্বাস্তু ও পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত  বাঙালী উদ্বাস্তুদের  যথাযথ পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷  কিন্তু কোন এক অজ্ঞাত কারণে পঞ্জাবে উদ্বাস্তুদের স্থায়ী পূনর্বাসন সম্ভব হলেও  বাঙালী উদ্বাস্তুদের জন্যে রয়ে গেল উপেক্ষা ও অনিশ্চিত ভবিতব্য৷  বিভিন্ন উদ্বাস্তু  শিবিরে তাঁদের দিন কাটতে লাগল নির্যাতন,নিপীড়ন ও অমানবিক পরিবেশে৷  তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস শাসকবর্গের  ভূমিকাও  খুব একটা সদর্থক ছিল না বলেই  হয়তো কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতৃত্ব ও শাসক বৃন্দ বাঙালী উদ্বাস্তু সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে বিশেষ উদ্যোগী হন নি৷  বাঙালী শাসকেরা নিজেদের গদি,  দলের পদমর্যাদা ও ক্ষমতার লোভকে  হয়তো ছিন্নমূল লক্ষলক্ষ বাঙালীর স্বার্থের উপরে স্থান দিয়েছিলেন৷ হায় রে বাঙালী!  ব্রিটিশ বেনিয়া শাসকেরা বাঙালীকে যেভাবে পদানত করে রাখার চেষ্টা করেছিল, একইভাবে তাঁদেরই  ব্যাটন হাতে তুলে নিয়ে হিন্দি সাম্রাজ্যবাদীরা  বাঙালীর জন্য  বরাদ্দ করেছে উপেক্ষা আর অবহেলা৷  স্বাধীনতা সংগ্রামে যে বাঙালী জাতি  সর্বাপেক্ষা অধিক আত্মত্যাগ করেছে, বুকের রক্ত ঝরিয়েছে, গুলি- ফাঁসিতে মৃত্যুবরণ করেছে---তাঁরাই স্বাধীনতার পর  একদিকে ভারতের হিন্দিসাম্রাজ্যবাদীদের্ দ্বারা ও অপরদিকে  পাকিস্তানের উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা হয়েছেন  উৎপীড়িত, নির্যাতিত, শোষিত ও নিজভূমে পরবাসী৷ শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে বহু বাঙালী উদ্বাস্তু বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে অমানুষিক পরিবেশ থেকে বেরিয়ে দেশের বিভিন্ন অংশে  ভাগ্যান্বেষণে ছড়িয়ে পড়েছেন ও ছিটমহল, সুন্দরবন অঞ্চল, অসমসহ অন্যান্য বাঙালী অধ্যুষিত স্থানে বসবাস শুরু করেছেন৷

পূর্বপাকিস্তানের বাঙালীরা উর্দু সাম্রাজ্যবাদীদের  উর্দুআগ্রাসন ,উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদে ও বাঙলা ভাষার প্রতি অন্যায় অবদমনের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে৷ মাতৃভাষা বাঙলা ভাষার বঞ্চনার বিরুদ্ধে সংগ্রামকে  ওপার বাঙলার বাঙালীরা জাতিসত্তা রক্ষার সংগ্রামে পরিণত করে ১৯৭১ সালে  দেশের মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত করে ফেলে৷ তাদের এই সংগ্রামে ভারতের প্রধানমন্ত্রী  শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী  ও পশ্চিমবঙ্গের  জনসাধারণের সক্রিয় সহযোগিতায় পূর্বপাকিস্তানের অস্তিত্ব লোপ পেয়ে নোতুন রাষ্ট্র ‘‘বাংলাদেশ’’ জন্ম নেয়৷ ১৯৭১ সনের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে পূর্বপাকিস্তানের বহু বাঙালী ভারতবর্ষের  অভ্যন্তরে পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে  বসবাস করতে শুরু করেন৷  পরবর্তীকালে তাদের কিয়দংশ  বাংলাদেশে ফিরে গেলেও  বাকীরা এই দেশেই থেকে যান৷ 

অপরদিকে ভারতবর্ষের বুকে বাঙলা ভাষী মানুষেরাও হিন্দি আগ্রাসনবাদীদের হাতে অনবরত লাঞ্ছিত ও পর্যুদস্ত হতে থাকলেন৷  বাঙালীদের জ্ঞান -গরিমা, শিক্ষা-দীক্ষা, ত্যাগ-তিতিক্ষা, বৈপ্লবিক সংগ্রামী চেতনা সর্বজনবিদিত৷ তাই ইংরেজ শাসককুল  বাঙালীদের একতাকে বিভিন্নভাবে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছে,  স্বাধীনতার পর  একইভাবে হিন্দিওয়ালারাও বাঙলা ভাষা ও বাঙালী জাতিসত্তাকে অবদমিত করার  চক্রান্তে সামিল হয়েছে৷ প্রথমত বাঙলা ভাষাভাষীদের বিস্তৃত ভূমিকে খণ্ড-বিখণ্ড করে  বিহার, ওড়িষা, অসম,ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, অধুনা ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত করে ও সেই সমস্ত রাজ্যের ভাষা, সংসৃকতি, আচার, ব্যবহারের সঙ্গে সমঝোতা করতে বাঙালীদের বাধ্য করেছে৷  অপরদিকে ছোট হয়ে যাওয়া খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের বুকে অনবরত চলেছে  হিন্দি আগ্রাসন  ও বঞ্চনার ষ্টীমরোলার চালিয়ে বাঙলা ও বাঙালীকে দুর্বল করে দেওয়ার সুগভীর চক্রান্ত৷  এরসঙ্গে যোগ হয়েছে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে  নানা অজুহাতে  বাঙালী বিতাড়ন বা বাঙালী খেদাও অভিযান৷  ঝাড়খণ্ড, অসম  ইত্যাদি রাজ্যে বাঙলা ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়ে বাঙালীর মুখের ভাষা, বাঙালীর সংসৃকতিকে ধবংস করার এক পরিকল্পিত প্রয়াস সমানে চলেছে৷ এই প্রচেষ্টার অঙ্গ হিসেবে  ১৯৭৯ সালে অসমে ‘‘আসু’’-র নেতৃত্বে  বাঙালী বিতাড়ন যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয় আর  আসু-র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে  ১৯৮৫ সালে ‘‘অসম চুক্তি’’ স্বাক্ষরিত হয় কেন্দ্রীয় সরকার, অসম সরকার ও আসু-র চক্রান্তে যার  একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাঙালীকে আর এক বার উদ্বাস্তু করে  রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন, ভাসমান জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা৷  এসবেরই চূড়ান্ত রূপ সাম্প্রতিক এই নাগরিকপঞ্জী বা  এন.আর.সি৷ বিভিন্ন সময়ে দেশ বাসীর মধ্যে  কখনো ভাষাগত, কখনো গোষ্ঠীগত, কখনো সম্প্রদায়গত বিভাজন সৃষ্টি করে কেন্দ্র ও রাজ্যসরকার গুলির নেতৃবৃন্দ নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থচরিতার্থ করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে যার বলি হয়েছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ-বিশেষতঃ  বাঙালী জনগোষ্ঠী৷ এত বেশী লাঞ্ছনা,নিপীড়ন, নির্যাতন আর বোধহয় অন্য কোন ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে সহ্য করতে হয়নি৷ এন.আর.সির নামে  আবার বাঙালীকে  রাষ্ট্রহীন, নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের সমগোত্রীয় করে ফেলার ব্যবস্থা প্রায় সম্পূর্ণ ৷ এসব ক্রিয়াকলাপের মূলে রয়েছে সেই ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার বিনিময়ে দেশ ভাগের বিষবৃক্ষ রোপন যার বিষময় ফল  আরও বিষাক্ত হয়ে এন.আর.সি রূপে দেশবাসী তথা বাঙালীর সামনে এসে উপস্থিত৷ তাই আজ বাঙালীকে নিজের জাতিসত্তা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি রক্ষার জন্যে বৈপ্লবিক চেতনা ও ঐক্য সংহতির ঐতিহ্যকে উপলদ্ধি করে  নোতুন সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে হবে৷  শ্রীচৈতন্য, শ্রীরামকৃষ্ণ,অরবিন্দ, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দের বাঙলা যেমন ধর্ম-ভক্তি-প্রেম-ত্যাগ-সেবায় অগ্রগণ্য, ঠিক তেমনি  নেতাজী সুভাষ, রাসবিহারী বসু, সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম বসু ,  প্রফুল্ল চাকী , বিনয়-বাদল- দীনেশ-এর বাঙলা প্রকৃত দেশ প্রেম ও বিপ্লবী চেতনায় সমৃদ্ধ৷ এহেন বাঙালীকে আজ নিজের অধিকার নিজেই বুঝে নিতে হবে৷ বিশ্বের সমস্ত বাঙালী-অধ্যুষিত স্থানের বাঙালীদের একত্রে আরও একবার  মরণপণ সংগ্রামের পথে অগ্রসর হয়ে  নিজেদের স্বস্থান, স্বভূমি স্বয়ংসম্পূর্ণ ‘‘বাঙ্গালীস্তান’’ গড়ে দেশ ভাগের বিষবৃক্ষকে  সমূলে উৎপাটিত করে ফেলতে হবে৷ সাম্প্রতিকালের এন.আর.সি  বা  নাগরিকপঞ্জীর কর্মকাণ্ড সেদিকেই দিগ্নির্দেশ করছে৷ তাই আর কালক্ষেপ না করে সর্বস্তরের বাঙালীকে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে জাতিসত্তার নবজাগরণের মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য নিজেই গড়ে তোলার অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে বীর-বিক্রমে সদর্থক পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে৷

 জয় বাংলা, জয় বাঙালী, জয় বাঙ্গালীস্তান---

এই হোক আজকের বাঙালীর একমাত্র শ্লোগান৷