সাধনায় কুলকুণ্ডলিনীকে ঊর্ধ্বগতি করতে না পারলে মন্ত্র জপ একেবারেই অর্থহীন হয়ে পড়ে৷ কুলকুণ্ডলিনীকে ঊধের্ব নিয়ে যাবার প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘পুরশ্চরণ প্রক্রিয়া’, আর মন্ত্রচৈতন্য বলতে অবশ্য আসলে ৰোঝায় সঠিকভাবে মন্ত্রের ভাব গ্রহণ করা৷ অর্থ ৰুঝে মন্ত্র জপ করলে মন্ত্রচৈতন্য বিধি সহজে নিষ্পন্ন হতে পারে৷ অর্থ না ৰুঝে জপক্রিয়া করা মানে সময়ের অপব্যবহার ছাড়া আর কিছুই নয়৷
এর পর আসছে ‘পাপক্ষয়ং’৷ তোমরা জান পাপ জিনিসটা কী? পাপ হ’ল ঋণাত্মক সংস্কার৷ যে কর্মই কর না কেন, তার প্রতিকর্ম থাকবেই৷ আর সেই প্রতিকর্মের ভোগ পূর্ণ না হলে তা প্রসুপ্তই থেকে যায়৷ সংবেগ থেকে যায়৷ কিন্তু তার অভিপ্রকাশ ঘটেনা৷ আবার কর্মের ধনাত্মক দিকটাও আছে৷ সমাজশাস্ত্রে এই ধনাত্মক কর্মকে বলা হয় পুণ্য৷ আর যখন জনস্বার্থবিরোধী কোনো কর্ম কর যা মূলতঃ ঋণাত্মক কর্ম, সেটাকে বলা হয় পাপ৷ দীক্ষার মাধ্যমে সাধকের পাপক্ষয় হয়ে থাকে৷ আর এই ক্ষয়টা হয় কীভাবে? কর্মের দ্বারা, সংস্কারমূলক কর্মের দ্বারা৷ এই যে সংস্কারমূলক কর্ম ক্ষয়, এটা ভৌতিক স্তরেও হতে পারে, আবার মানসিক স্তরেও হতে পারে৷ দীক্ষা মানুষকে শিক্ষা দেয় কীভাবে মানসিক স্তরে সেই সংস্কারমূলক কর্মের ভোগটা পুরো হয়ে থাকে৷ এইভাবে মানুষ পাপের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়৷ পাপের হাত থেকে অব্যাহতি পাবার অর্থাৎ প্রতিকর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত হবার যে পথ তা দু’টি পর্যায়ে বিভক্ত৷ পর্যায় দু’টি হ’ল–মন্ত্রাঘাত ও মন্ত্রচৈতন্য৷
তোমাদের এর আগেই বলেছি, প্রতিটি মন্ত্রের পেছনে কোন–না–কোন ৰীজমন্ত্রের সমর্থন আছে আর যখন সেই ৰীজমন্ত্রের ধ্বনি কুলকুণ্ডলিনীকে আঘাত করে, তখন কুলকুণ্ডলিনী জেগে ওঠে৷ এই প্রক্রিয়ার নাম মন্ত্রাঘাত৷ অতঃপর সেই জাগ্রত কুণ্ডলিনী মন্ত্রের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি পেয়ে, বল পেয়ে চরম ধনাত্মিকতার দিকে চলতে শুরু করে৷ এই যে কুণ্ডলিনীর পুরশ্চরণ, একেই বলা হয় মন্ত্রচৈতন্য৷ এই মন্ত্রাঘাত ও মন্ত্রচৈতন্যের মাধ্যমেই অধ্যাত্মসাধক যাবতীয় বন্ধন থেকে মুক্তিলাভ করে–ভৌতিক ও মানসিক উভয় স্তরেই৷ যেমন অন্ধকার ঘরে কোনো বহুমূল্য বস্তু থাকলেও আমরা তা দেখতে পাই না৷ তেমনি যিনি সদ্গুরু কর্ত্তৃক মূল্যবান মন্ত্র পেয়েছেন তিনিও দীপনী অর্থাৎ প্রদীপের সাহায্য ব্যতিরেকে তাকে ঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারেন না৷...
সাধনার তাৎপর্য হ’ল মায়ার বিরুদ্ধে জবরদস্ত সংগ্রাম ও শেষ পর্যন্ত এই মায়া শক্তিকে পরাভূত করে পরমতত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া৷ কিন্তু মায়ার সঙ্গে সংগ্রামে অবতীর্ণ হওয়ার আগে তাই সাধককে উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে সাধন–সমরকৌশল ভালভাবে আয়ত্ত করে নিতে হবে৷ গুরু কে?– না, যিনি জীবনে অন্ধকার থেকে আলোকের দিকে নিয়ে যান৷ তাই একমাত্র ব্রহ্মই জীবের গুরু হতে পারেন, অন্য কেউ নয়৷ এই ধরনের গুরুর সাক্ষাৎ কখন মেলে? ‘‘মুক্তাকাঙক্ষয়া সদ্গুরুপ্রাপ্তিঃ৷’’ মানবমন যখন মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তির জন্যে ব্যাকুল হয়ে ওঠে তখন পরমব্রহ্ম সদ্গুরুরূপে তাঁর কাছে আবির্ভূত হন ও দীক্ষাদানের মাধ্যমে সাধকের আধ্যাত্মিক প্রগতিতে সাহায্য করেন৷ তাই সাধনার ক্ষেত্রে সদ্গুরুর মাহাত্ম্য ও দীক্ষার তাৎপর্য সম্বন্ধে সাধককে বিশেষভাবে অবহিত হতে হবে৷ আগেই বলা হয়েছে ‘দীক্ষা’ কি?
‘‘দীপজ্ঞানং যতো দদ্যাৎ কুর্য্যাৎ পাপক্ষয়ং ততঃ৷
তস্মাৎ দীক্ষেতি সা প্রোক্তা সর্বতন্ত্রস্য সম্মতা৷৷’’
অর্থাৎ যার দ্বারা সাধকের দীপজ্ঞান ও পূর্বার্জিত সংস্কারের ক্ষয় হয় তার নাম দীক্ষা৷ সাধারণভাবে লোকে দীক্ষা দুই প্রকারের বলে থাকে–বৈদিকী দীক্ষা ও তান্ত্রিকী দীক্ষা৷ মানুষকে প্রকৃত ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার পথে পরমাত্মার প্রতি আকর্ষণোন্মুখ করার পথ নির্দেশনার নাম বৈদিক দীক্ষা৷ উপনিষদ প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থের বহু শ্লোক এই বৈদিকী দীক্ষায় সহায়তা করে৷ উপযুক্ত ধার্মিক শিক্ষা পেলে মানুষের মনে ‘ৰোধ’ জেগে ওঠে৷ তাই সে সেই পথের সন্ধান চায় যা পেলে সে পাবে তার পরম ইষ্টকে৷ উপযুক্ত আচার্য তখন তাকে দেবেন সেই পথের নির্দেশনা৷ এই পথনির্দেশনার নাম তান্ত্রিকী দীক্ষা৷ ‘তন্ জ্যাড্যাৎ তারয়েৎ যস্তু সঃ তন্ত্রঃ পরিকীর্ত্তিতঃ’ অর্থাৎ যে বৈবহারিক বিজ্ঞানের অনুশীলনের ফলে মানুষ জড়তার বন্ধন থেকে মুক্তি পায় তার নাম তন্ত্র৷ যে দীক্ষা তন্ত্রবিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত তাই তান্ত্রিকী দীক্ষা৷ সাধকের মতে বৈদিকী দীক্ষা দীক্ষাই নয়, একে বড়জোর সংস্কার বলা চলে, কেবল তান্ত্রিকী দীক্ষাই ‘দীক্ষা’ নামে অভিহিত হবার যোগ্য কারণ এতে দীক্ষার প্রয়োজনীয় আঙ্গিকসমূহ, যেমন–দীপনী, মন্ত্রচৈতন্য, অভিষেক সব কিছুরই বিধান রয়েছে৷ উপযুক্ত গুরুর কাছ থেকে যথোপযুক্ত সাধন–সংকেত শিখে নিয়ে নিষ্ঠা ও ভক্তিসহকারে তা নিয়মিত অভ্যাস করলে সাধক অবশ্যই অবিচলিত পদক্ষেপে অভীষ্ট পরমপুরুষের দিকে এগিয়ে চলতে থাকবেন৷ তার সমস্ত অন্তঃকরণ সত্যের শুভ্র আলোতে, প্রজ্ঞার দিব্য জ্যোতিতে ঝলসিত হয়ে উঠবে৷ এ অবস্থায় সাধক আর মায়াধীন নন, মায়াধীশ৷