একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর চবিবশের গণ অভ্যুত্থান -- এ দুইয়ের পার্থক্য কোথায়?

লেখক
সুকুমার সরকার

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর চবিবশের গণ অভ্যত্থানকে আন্দোলনকারীরা সমার্থক বললেও, এ দুইয়ের মধ্যে অনেক ফারাক আছে৷ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালিদের সঙ্গে অবাঙালি শাসক-শোষকের লড়াই৷ চবিবশের গণ অভ্যত্থান বাঙালি শাসকের সঙ্গে বাঙালি বিক্ষোভকারীদের লড়াই৷ লড়াই একজন উন্নয়নকামী সরকার প্রধানের সঙ্গে উন্নয়ন বিরোধীদের লড়াই৷ চবিবশের গণ অভ্যত্থান যাঁর বিরুদ্ধে তিনি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্থপতি মুক্তিযুদ্ধের হোতা শেখ মুজিবর রহমানের কন্যা, যিনি নিজেও অসাম্প্রদায়িক উন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে ছিলেন আপোষহীন৷ তার সুফলও ফলেছে বাংলাদেশে৷ রাস্তাঘাট, সেতু, শিক্ষা, চাকরি সবেতেই গণতান্ত্রিক উন্নয়নের ছাপ পড়েছে৷ অন্যদিকে চবিবশের গণ অভ্যত্থানের হোতারা ছাত্র আন্দোলনের নাম করে পথে নামলেও তাদের শ্লোগানে ছিল স্বাধীনতা বিরোধী ’’রাজাকার’’ শব্দ আর ভারতবিরোধী কথাবার্তা৷ এতেই স্পষ্ট ছিল তাদের আসল উদ্দেশ্য কী ? ফলে ছাত্রদের দাবী আদালত কর্তৃক পূরণ হলেও আন্দোলন কিন্তু থামলো না৷ আসলে আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল অসাম্প্রদায়িক এই সরকারকে উৎখাত করে সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঘটানো৷ এবং শেষ পর্যন্ত সেটাই হয়েছে৷ এব্যাপারে বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের ভূমিকাও ওই লুটেরা মৌলবাদীদের পক্ষেই ছিল৷ নইলে শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে সই করিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়ে সেনাবাহিনীকে কেন কোনো নির্দেশ দিলেন না আন্দোলন থামাতে? প্রায় আটচল্লিশ ঘন্টা নীরবই থাকলেন৷ আর এই ফাঁকে লুটেরা জনগণ দেশের সংসদ পর্যন্ত লুট করলো৷ হাসিনা সরকারের সময়ে সরকারি নির্দেশ পালনকারী পুলিশবাহিনীকেও সেনাবাহিনী জনরোষের হাত থেকে রক্ষা করলেন না৷ এ থেকে একথা স্পষ্ট, সেনাবাহিনী দেশের বিক্ষোভকারীদের পক্ষে৷ হাসিনা সরকারের নির্দেশ পালনকারী পুলিশ এখনো হুমকির মুখে৷ অথচ পুলিশের কাজই সরকারের নির্দেশ পালনকরা৷ সেটা করে তাঁরা কী অপরাধ করেছেন ? হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার পরেও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকা বাংলাদেশে কেন এত হত্যা এবং লুটতারাজ হলো ? এত স্থাপত্য ভাঙা হলো ?

 একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণ৷ আর চবিবশের গণ অভ্যত্থান ইসলামী মৌলবাদের উত্থান৷ মূর্তি যাদের শত্রু৷ এটাই এ দুইয়ের বড় পার্থক্য৷ এই অভ্যাত্থানে চির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের বাংলাদেশ আগামী কয়েক দশক কঠোরভাবে ইসলামী অনুশাসনের দিকে ধাবিত হবে৷ শিক্ষা সংস্কৃতিতে ইসলামী মৌলবাদ বাড়বে৷ তবে আশার কথা এই, যেহেতু বাংলাদেশ চির অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের, সেইহেতু বাঙালির ভেতরের বাঙালি জাতিসত্তা মৌলবাদী ফতোয়া বেশিদিন মানতে পারবে না৷ কালো বোরখায় বেশিদিন নিজেদের ঢেকে রাখতে পারবে না৷ তখন তাঁরা বাংলাদেশের মুক্ত বাতাস নিতে বেরিয়ে আসতে চাইবেন৷ আর এই চাওয়া নোতুন আরেক বিক্ষোভের সূচনা করবে৷ সেটা যদি ‘প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’-এর মতো কোনো উন্নত দর্শনের আলোকে হয় তাহলেই ভালো৷ আমার বিশ্বাস মৌলবাদে অতিষ্ট বাংলাদেশের মানুষ সে পথেই এগোবেন৷