২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বিপুল জয়, বিশেষ করে পশ্চিম বাঙলায় বিজেপি’র দ্রুত বিপুল উত্থানের পর সম্প্রতি এ রাজ্যের ৩টি উপনির্বাচনেই বিজেপি’র চিৎপাত হয়ে উল্টে পড়ার দশা দেখে অনেকেই কিছুটা বিস্মিত হয়েছেন৷
হঠাৎ কী এমন হ’ল যে বিজেপি’র এভাবে ‘পপাত ধরণীতলে’ দশাপ্রাপ্তি? গত লোকসভা নির্বাচনে তূণমূল যেখানে আশা করেছিল ৪২-এর ৪২টা আসন, অন্ততঃ ২/৪টি বাদ দিয়ে সমস্ত আসন কিন্তু কার্যতঃ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর দেখা গেল বিজেপি’র আশাতীতভাবে দ্রুত উত্থান হয়েছে৷ এক লাফে ১৮ টি আসন লাভ৷ ২৩টি জেলার মধ্যে ১৩টিজেলায় বিজেপি তৃণমূলের চেয়ে বেশি বোট পেয়েছে৷
নির্বাচনে ফলাফল ঘোষণার পর তৃণমূল, বাম ও কংগ্রেস সব দল থেকেই একে একে কর্মী, জন প্রতিনিধি বিজেপি’তে ভিড়তে শুরু করে ছিল বা প্রয়াস চালিয়ে যেতে লাগল৷ একের পর এক পুরসভা বিজেপি’র দখলে এসে গেল৷ বিজেপি’র নেতৃবর্গ দাবী করলেন একশতের বেশি তৃণমূলের বিধায়ক বিজেপিতে যোগদানের সম্ভাবনা রয়েছে৷ ভেতরে ভেতরে হয়তো সেরকম কথাবার্র্ত চলছিল৷
তারপর কশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ, তিন তালাক বিল পাশ, সুপ্রির্ম কোর্টে রামমন্দিরের পক্ষে রায় বিজেপির ভাবমূর্ত্তিকে আরও বাড়িয়ে তুলল৷ যদিও সারা দেশ জুড়ে জিডিপি’র অবনতি, বেকার সমস্যার বৃদ্ধির সরকারী তথ্য সামনে আসার মত ঘটল ঘটনা, তবু সাধারণ মানুষের কাছে এর বিশেষ কোনো প্রভাব পড়েছে বলে মনে হল না৷
তবে পশ্চিমবাঙলায় কিসের জন্যে বিজেপির বিরুদ্ধে এত জনরোষ আছড়ে পড়ল যে, একটাও আসনে জয় লাভ করতে পারল না৷ এমনকি খড়্গপুরের আসনটি, যেখানে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ আগে বিধানসভার বিধায়ক ছিলেন, পরে এখানে লোকসভা আসনেও জিতেছেন সেখানে তাঁর নিজের বিধানসভা আসনটিও তৃণমূল কংগ্রেসের হাতে চলে গেল৷ কালিয়াগঞ্জে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে এগিয়ে ছিল, সেখানেও বিধানসভা আসনে বিজেপি’কে জনসাধারণ ছুঁড়ে ফেলে দিল৷ নদীয়ার করিমপুরেও বিজেপি’র হার হ’ল৷
কিন্তু কেন? তার প্রধান কারণটি হ’ল এন.আর.সি’র বিরুদ্ধে বাঙালীর সংঘবদ্ধ প্রবল বিক্ষোভ৷ অসমে ১৯ লক্ষ বাঙালী এন.আর.সি’র ফলে আজ রাষ্ট্রহীন নাগরিকহীন হতে চলেছে৷ তাদের চাকরি-বাকরি, ব্যবসা বানিজ্য সমস্ত বিপন্ন, জীবনও বিপন্ন হতে চলেছে৷ চরম আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে৷ অনেকে হতাশায় আত্মহত্যা করেছেন৷ যদিও বিজেপি সরকার থেকে আবার আবেদনের সুযোগ দানের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু তাতে কিছু কাজ হবে--- এ আশা কেউ করছে না৷ কারণ এর আগে অনেক দৌড়ঝাঁপ করে’ অনেক নথিপত্র দাখিল করেও ফল হয়নি৷ ওখানকার, বিজেপি’র জনপ্রতিনিধিরাই এখন এন.আর.সির সমালোচনা করছেন৷
এমনি পরিস্থিতিতে পশ্চিমবাঙলাতেও এন.আর.সি’ লাগু করা হবে বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্টমন্ত্রী বার বার বলে যাচ্ছেন, যতই এন.আর.সির ব্যাপারে জনগণ আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে, অনেকে আত্মহত্যা করছেন, চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠছে৷ তবুও অমিত শাহ হুঙ্কার দিয়ে ঘোষণা করছেন এন.আর.সি হবেই৷
বাঙালী জনসাধারণের আতঙ্কগ্রস্ত মানসিক অবস্থাটাও বোঝাবার মত বুদ্ধিও বিজেপি নেতৃবর্গের হ’ল না৷ জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খা, ব্যথা বেদনা বোঝবার ক্ষমতা বা মানসিকতা যে নেতৃবর্গের নেই তারা কি করে জনসাধারণের সমর্থন আশা করেন? কেবল ওপর ওয়ালার আদেশ তামিল করে নিজেদের পদ বাঁচানোর মানসিকতা থাকলে আর যাই হোক জননেতা বা জননেত্রী হতে পারবেন না৷ কেন্দ্রে নেতৃবর্গেরও বোঝা উচিত ছিল জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভাব অভিযোগ বুঝে জনগণের সেবার জন্যেই জনপ্রতিনিধি৷ তা না হয়ে কেবল ডিক্টেটরী মেজাজ নিয়ে চললে এ যুগে চলবে না৷
তাছাড়া, সরকার বা জনপ্রতিনিধিদের উচিত দেশের সমস্ত মানুষের প্রতি সমদৃষ্টি নিয়ে সবার উন্নয়ণের মানসিকতা রাখা ‘ডিভাইড এ্যাণ্ড রুল’--- এই কুট কৌশলের দ্বারা কিছুদিনের জন্যে মানুষকে বিভ্রান্ত করে রাখা যায়, কিন্তু বেশি দিন নয়৷ জাত-পাত সম্প্রদায়ের বিভাজন নীতি নিয়ে যারাই বর্তমানে দেশ শাসনে নাববেন , তারা কখনই সফল হবেন না৷
তাছাড়া, সারা ভারতের মধ্যে রেণেসাঁ বা নবজাগরণের সূত্রপাত বাঙলায় ও বাঙালীদের মধ্যে হয়েছিল সেই বাঙালীরা ব্রিটিশ সিংহকে নাস্তানাবুদ খাইয়ে সমুদ্র পার করে ছাড়ল, সেই বীর বিপ্লবী ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকি, বাঘাযতীন, সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্রের বাঙালী জাতিকেই ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে’ দুর্বল করে এখানে আধিপত্য বিস্তার করার আশা দিবাস্বপ্ণ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, বাইরের থেকে বা ভেতর থেকে কিছু কিছু ষড়যন্ত্র -ঘাত -প্রতিঘাতের ফলে বাঙালী জাতির গোষ্ঠীগত বা সাম্প্রদায়িক বিভেদ -বিচ্ছেদ থাকলেও , বাঙালী জাতিসত্তার অভ্যন্তরে ফল্গুর, স্রোতের মত এক সুদূঢ় ভাষা-ভাষা- সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যগত ঐক্যের স্রোত বয়ে চলেছে , এই ঐক্যকে ভেঙ্গে যারা নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ কায়েম করতে চায়--- তাদের ব্যর্থ হতেই হবে৷
- Log in to post comments