ধৃতরাষ্ট্রঃ উবাচ অর্থাৎ ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞাসা করছেন ঃ
‘‘ধর্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ৷
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্বত সঞ্জয়৷৷’’
‘ধর্মক্ষেত্রে’ মানে এই শরীর রূপী ধর্মক্ষেত্রে ‘কুরুক্ষেত্রে’ মানে সংসার রূপী কুরুক্ষেত্রে ‘মামকাঃ’ মানে আমার পক্ষীয়েরা৷ কে বলছেন –– না, ধৃতরাষ্ট্র বলছেন৷ ধৃতরাষ্ট্র কে –– না, অন্ধ মন৷ কাকে বলছেন –– না, সঞ্জয়কে, বিবেককে৷ আমার পক্ষের লোকেরা আর পাণ্ডুপক্ষের লোকেরা ‘সমবেতাঃ’ অর্থাৎ একত্রিতাঃ একত্রীভূতাঃ৷ এক সঙ্গে সমবেত হয়ে৷ কেন সমবেত –– না, ‘যুযুৎসবঃ’৷ যুধ্ ইচ্ছার্থে সন্ উ প্রত্যয় করে ‘যুযুৎসু’ শব্দটা নিষ্পন্ন৷ যুযুৎসু মানে লড়াই করতে, সংগ্রাম করতে যে ইচ্ছুক তাকে সংস্কৃতে বলব ‘যুযুৎসু’৷ সংঘর্ষ বা সংগ্রাম করবার ইচ্ছা অর্থে ‘যুধ্’ ধাতু ইচ্ছার্থে ‘সন্’ প্রত্যয় করে হচ্ছে ‘যুযুৎস’ স্ত্রীলিঙ্গে ‘টা’ ঞ্চ যুযুৎসা, মানে লড়াই করবার ইচ্ছা৷ আর যুযুৎসু মানে যে লড়াই করতে ইচ্ছুক৷ আমার পক্ষীয়েরা আর পাণ্ডুপক্ষীয়রা লড়াই করতে ইচ্ছুক হয়ে একত্রে সমবেত হয়েছে৷ কোথায় – না, শরীর রূপী ধর্মক্ষেত্রে ও সংসার রূপী কুরুক্ষেত্রে৷ এরা কে কী করেছিল, কোন পক্ষ কী করেছিল, হে সঞ্জয়, হে বিবেক, আমাকে বলো৷
এখন ‘‘মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব’’৷ এখন ‘মামকাঃ’ মানে আমার পক্ষের লোকেরা৷ ধৃতরাষ্ট্রের অর্থাৎ মনের পক্ষে আছে কারা –– না, দশটি ইন্দ্রিয় –– পাঁচ কর্মেন্দ্রিয়, পাঁচ জ্ঞানেন্দ্রিয়৷ বাক্–পাণি–পাদ–পায়ু– –– এই পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয় চক্ষু–কর্ণ–নাসিকা–জিহ্বা-ত্বক –– এই পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয়৷ এখন এই যে দশটা ইন্দ্রিয়, এদের কর্তা, এদের মালিক হ’ল মন৷ শাস্ত্রে বলা হয়েছে, ‘‘ইন্দ্রিয়াণাং মনো নাথঃ মনোনাথস্তু মারুতঃ’’৷ ইন্দ্রিয়দের কর্তা, অধিকর্তা, রাজা বা নিয়ন্ত্রক হ’ল মন আর মনকে নিয়ন্ত্রণ করে সাধক, ৰুদ্ধিমান ব্যষ্টি৷ সাধক মনকে নিয়ন্ত্রণ করেন মরুৎকে নিয়ন্ত্রণের দ্বারা অর্থাৎ বায়ুকে নিয়ন্ত্রণের দ্বারা অর্থাৎ প্রাণায়ামের দ্বারা৷ ইন্দ্রিয়সমূহের যে অভিব্যক্তি সেইগুলোকে বলা হয় প্রাণ৷ ‘প্রাণ’ মানেই এনার্জি আর ন্ব্ধ্ত্রপ্ত ন্দ্বুন্দ্বব্জন্ধম্ভ–কে বলা হয় ‘প্রাণাঃ’৷ তোমরা এটা ‘Idea and Ideology’ পুস্তকে নিশ্চয়ই পড়েছ৷ মানুষ যখন প্রাণকে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অভিব্যক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চায় তখন তাকে বায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়৷ আ –– যম্ ঘঞ্ ঞ্চ আয়াম অর্থাৎ যা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে৷ যার দ্বারা প্রাণকে অর্থাৎ ইন্দ্রিয়ের অভিব্যক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে তা হ’ল প্রাণায়াম৷ প্রাণ আয়াম ঞ্চ প্রাণায়াম৷ ‘‘প্রাণান্ যময়ত্যেষ প্রাণায়ামঃ’’ –– যার দ্বারা ইন্দ্রিয়ের অভিব্যক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে আনা হয় তাকে বলা হয় প্রাণায়াম৷ প্রাণায়ামের দ্বারা যে ইন্দ্রিয়েরা নিয়ন্ত্রিত হয় তা–ই নয়, ইন্দ্রিয়দের অধিকর্তা মনও নিয়ন্ত্রিত হয়৷ সুতরাং তখন স্বভাবতই মন ইন্দ্রিয়ের সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে যায় যদিও ইন্দ্রিয়দের সে অধিকর্তা তাই মনকে বলা হয় একাদশ ইন্দ্রিয়৷ অনেক পণ্ডিত মনকে আলাদা সত্তা হিসাবে মানতেই রাজী নন৷ আবার অনেকে বলেন মনও একটা ইন্দ্রিয়৷ যদিও মন ঠিক ইন্দ্রিয় নয় কারণ মনের দু’টো ভূমিকা রয়েছে –– ইন্দ্রিয় হিসেবে তার একটা ভূমিকা রয়েছে, আবার বাকী দশটা ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রক হিসেবেও তার একটা ভূমিকা রয়েছে৷
এখন ‘মামকাঃ’ বলতে কী দাঁড়াচ্ছে তাহলে –– না, দশটা ইন্দ্রিয় হ’ল মনের পক্ষের লোক৷ ওদের নিয়েই না মনের কাজকারবার, মনের শাসন, মনের প্রতাপ যা কিছু৷ ইন্দ্রিয়গুলো যদি মনের অধীনে না থাকত তাহলে মনের কোন দাম থাকত না, কোন গুরুত্ব থাকত না, তার অস্তিত্বই নিরর্থক হয়ে যেত৷ মন চাইছে, তাই চোখ দেখছে মন চাইছে, তাই কাণ শুণছে মন চাইছে, তাই নাক আঘ্রাণ নিচ্ছে৷ মন না চাইলে এরা কেউ কিছু করতে পারে না৷ মনে কর, তুমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছ৷ আর তোমার মন তখন ঘুরে বেড়াচ্ছে ঢ়াকা শহরে, আর তুমি চলছ কলকাতার রাস্তা দিয়ে৷ তোমার সামনে দিয়ে একজন পরিচিত লোক এসে গেল, কিন্তু তোমার মন রয়েছে ঢ়াকায়৷ তাই পরিচিত লোকটিকে সামনে দেখেও তুমি তাকে দেখতে পাবে না কারণ, মন দেখবার কাজে তোমার চোখকে সেখানে নিয়োজিত করেনি৷ পরে যখন সেই লোকটি বললে, আপনার সঙ্গে দেখা হ’ল, কই আপনি তো আমার দিকে তাকালেন না, কথাও বললেন না৷ তখন তুমি বলবে, আমি তখন অন্য চিন্তায় ছিলুম, মানে মন অন্য কাজে নিয়োজিত ছিল৷ তাই মনের সমর্থন না থাকলে চোখ থাকতেও দেখবে না, কাণ থাকতেও শুণবে না৷ এই হচ্ছে ব্যাপারটা৷ তুমি গভীরভাবে কিছু চিন্তা করছ৷ এমন সময় একজন হয়তো একটা কথা দু’বার/তিন বার বললে৷ তারপর তুমি তখনো উত্তর দিচ্ছ না দেখে সে বললে –– আপনি শুণছেন না৷ তখন বললে –– হ্যাঁ–হ্যাঁ, আমি অন্য চিন্তায় ছিলুম৷ এই রকমই হয়ে থাকে৷
মনের যা কিছু গুরুত্ব, যা কিছু প্রভুত্ব, সেই দশটা ইন্দ্রিয়ের সে অধিকর্তা এই হিসাবে৷ এর অতিরিক্ত আমি বললুম যে আমি মনকে ঠিক একটা ইন্দ্রিয় বলে স্বীকার করি না যদিও অনেকে আবার মনকে ইন্দ্রিয়ও বলে৷ এই কারণে বলি না যে মনের মননক্রিয়ার একটা বিশেষত্ব রয়েছে৷ এই মনন ক্রিয়াটা কী মনন ক্রিয়া আছে বলেই তাকে ‘মন’ বলা হয়৷ ‘মন্’ ধাতুর মানে কী ভাবা, চিন্তা করা৷ স্বাভাবিক নিয়মে মনোবৈজ্ঞানিক বিচারে মনের দু’টো কাজ৷ একটা হ’ল চিন্তা করা, আরেকটা হ’ল স্মরণ রাখা৷ স্মরণ রাখার ব্যাপারে মানুষের আবার কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, চিন্তা করার ব্যাপারেও বৈশিষ্ট্য আছে –– সেগুলোও শিখে রাখো৷ চিন্তা করবার ব্যাপারে মানুষ ঘন ঘন যে বস্তুর সংস্পর্শে আসে সে চিন্তা করার সময় সেই জিনিসটার বেশী চিন্তা করে৷ অন্য কিছু চিন্তা করতে গেলেও ঘুরে ফিরে সেই জিনিসগুলোই বারবার ছুটে আসে৷ মনন করা মনের স্বভাব আর মননটা এই পরিবেশের ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল৷ যে চাষী চাষ করছে, বৃষ্টি হয়নি, সে অন্য চিন্তা করছে আর মাঝে মাঝে তার চিন্তা হচ্ছে, ‘আজকে কি বৃষ্টি হবে’ তার চিন্তাধারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে ওই ধানের কথায়, বর্ষার কথায়, কারণ ওই ধান আর বৃষ্টিকে নিয়ে খুব বেশী ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে৷ (ক্রমশঃ)