ভারতবর্ষকে বলা হয় বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক তথা প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র৷ আমাদের দেশের নেতানেত্রীগণ উঠতে-বসতে কথায় কথায় ভারতীয় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কথা, গণতন্ত্রের মান মর্যাদার কথা বলেন৷ কিন্তু কোন নেতা বা নেত্রী বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে তাঁর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রতি সত্যিকারের সম্মান রয়েছে কিংবা তিনি গণতান্ত্রিক প্রথা পদ্ধতিকে আন্তরিকভাবে মেনে চলতে সদা তৎপর! গণতন্ত্র বলতে সাধারণ নাগরিক হিসেবে বুঝি--- Of the people, For the people, By the people অর্থাৎ এমন একটা শাসনব্যবস্থা যার সবটুকুই জনগণকে নিয়ে---জনগণের দ্বারা নির্বাচিত জনগণের জন্যে, জনগণের সরকার৷ কবির ভাষায়, ‘‘আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজত্বে’’৷ কথাগুলি শুণতে বা ভাবতে খুব সুন্দর কিন্তু বাস্তবের রুক্ষ মাটিতে গণতন্ত্রের যে চেহারা আমাদের চোখের সামনে প্রতিনিয়ত ফুটে ওঠে তা কোন অর্থেই সুখকর নয়--- সাধারণ নাগরিক পদে-পদে লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, পদদলিত৷ পাঁচ বছর পর পর কখনো পঞ্চায়েত, কখনো বিধানসভা কখনো লোকসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়--- রাজনৈতিক নেতানেত্রীগণ করজোড়ে বোট (ভোট) প্রার্থী হন, মিষ্টি মধুর ভাষায় আশ্বাস-প্রতিশ্রুতির কথা শোণান৷ তখন জনগণ যেন সত্যিই ভগবান৷ কিন্তু তার পিছনেই থাকে চেলা চামুণ্ডাদের রক্তচক্ষুর শাসানি কিংবা প্রলোভনের হাতছানি, কোনরকম বেচাল হলেই ঠ্যাঙানি বা অন্য কোন ব্যবস্থা৷ আর নির্বাচনী বৈতরণী একবার পেরোতে পারলে নেতা-নেত্রীদের পায় কে! তখন তাঁরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে, বহুবিধ ব্যস্ততার ফাঁকে জনগণের জন্যে সময় বার করাটাই তাঁদের পক্ষে কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে ওঠে৷
গণতন্ত্রের কাঠামোকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে কয়েকটি সাংবিধানিক স্তম্ভ রয়েছে---১) আইনসভা (লোকসভা ও বিধানসভা), ২) বিচার ব্যবস্থা,৩) নির্বাচন কমিশন, ৪) প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানসমূহ৷ আইনসভার কাজ হলো সমগ্র দেশের শাসনব্যবস্থাকে সুচারুরূপে সম্পাদন করা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আইনপ্রণয়ন ও বিশেষ প্রয়োজনে সংবিধানের কোন কোন ধারার সময়োপযোগী সংশোধন, সংযোজন ইত্যাদি কার্যকর করা৷ প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান সমূহের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের জনগণের কাছে সংবিধান প্রদত্ত অধিকার ও সুবিধাগুলিকে পৌঁছে দেওয়া, আর দেশের উন্নয়ণ, সুরক্ষা, শান্তি-শৃঙ্খলা ইত্যাদি সুনিশ্চিত করা৷
দেশের বিচার ব্যবস্থার দায়িত্ব হলো দেশের অভ্যন্তরে প্রতিটি মানুষের কাছে সুবিচার পৌঁছে দেওয়া যাতে কেউ সংবিধান প্রদত্ত অধিকারগুলি থেকে বঞ্চিত না হয়৷ কোনো সরকারী প্রতিষ্ঠান, কোনো ব্যষ্টি বা দল যদি অন্যায় ও দুর্নীতির দ্বারা অপর কোন ব্যষ্টি,প্রতিষ্ঠান বা দলকে ন্যায্য প্রাপ্য ও অধিকার থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করে তবে যথাযথ বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুবিচার প্রদান করাই হচ্ছে বিচার বিভাগের মুখ্য দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য৷ ভারতের নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব হল নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করে নির্দিষ্ট সময় অন্তর আইন সভার প্রতিনিধিগণকে নির্বাচিত করা৷ প্রথমে সংবিধান প্রদত্ত বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী উপযুক্ত প্রার্থীগণকে বাছাই করা ও পরবর্তী পর্যায়ে যথাযথ নির্বাচনী বিধি পালনের দ্বারা অবাধ ও ন্যায়সঙ্গত নির্বাচন প্রক্রিয়া সুসম্পন্ন করাই হল নির্বাচন কমিশনের মূল দায়িত্ব৷ নির্বাচন পরিচালনার সময়ে কমিশনকে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে ভয়ডরহীন ও শান্তিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন পর্ব অনুষ্ঠিত হয়৷ কোনরকম নির্বাচনী বিধিভঙ্গের ঘটনা (তা যেকোনো স্তরের রাজনৈতিক নেতা, কর্মী বা ব্যষ্টির দ্বারা সংঘটিত হোক না কেন) অত্যন্ত নিরপেক্ষতা, দূরদর্শিতা ও কঠোরতার সাহায্যে দ্রুত মোকাবিলা করা বিশেষ প্রয়োজন--- নতুবা কোন ছোট খাটো অনিয়ম হয়তো অনেক বড় বিপর্যয়ের কারণ হয়ে উঠতে পারে৷
বর্তমানে ২০১৯ সালের লোকসভার নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে৷ বিভিন্ন দলের নেতানেত্রীরা তাদের দলীয় প্রার্থীদের সমর্থনে সভা, মিছিল,সমাবেশ ইত্যাদি করে চলেছেন--- বিরোধীপক্ষের প্রার্থী, নেতা কর্মীর বিরুদ্ধে অকথা-কুকথার ফোয়ারা ছোটাচ্ছেন, ধর্মমত-জাত-পাতের নামে বোট (ভোট) ভিক্ষা করছেন যা নির্র্বচনী বিধিভঙ্গের পর্যায়ভুক্ত৷ এবারের নির্বাচনী প্রচারে আরেকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, তা হলো ---সেনাবাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ে বাগাড়ম্বর৷ দেশের সুরক্ষা ও প্রতিরক্ষার জন্যে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ও কর্ত্তব্য সুনির্দিষ্ট রয়েছে, আর দেশের প্রয়োজনে সেনাবাহিনী যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন৷ কিন্তু তাদের সাফল্য বা অসাফল্যকে ভোটের বাজারে পণ্য করাটা একেবারেই গর্হিত কাজ --- নির্বাচনী বিধির দিক থেকেও, আবার নৈতিকতার দিক থেকেও৷ এছাড়াও দেখা যায়,অন্যান্য সময় বছরের পর বছর চুপচাপ থাকলেও ঠিক নির্বাচনের আগে থেকে শুরু করে নির্বাচন চলাকালীন সময়েও রাজ্যে বা কেন্দ্রে আসীন সরকার পক্ষের (যখন যে দল সরকারে থাকেন সেই দলমত নির্বিশেষে) অঙ্গুলি হেলনে বিরোধীপক্ষের নেতানেত্রীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারী প্রতিষ্ঠান (যেমন--- আয়কর, সিবিআই,ইডি, সি আই ডি ইত্যাদি) তদন্তের নামে অত্যন্ত সক্রিয় হয় ওঠে যাতে বিরোধীপক্ষের লোকেরা বিব্রত ও অসুবিধার সম্মুখীন হয়৷ ভারতবর্ষের রাজনীতিকে ধর্মমত-জাত-পাতের বিভাজন, হিংসা-সন্ত্রাস-ভয়,সাংঘাতিকভাবে কলুষিত করে চলেছে যা অবাধ, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে অন্তরায় স্বরূপ৷ নির্বাচন কমিশনকেও তাদের কাজে কর্মে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতার ছাপ রাখতে হবে৷ নচেৎ এর দায়ভার তাদেরকেও বহন করতে হবে ও হচ্ছে৷ কয়েকদিন আগেই সুপ্রিমকোর্টে ধর্মমত ভিত্তিক প্রচারে নির্র্বচনী বিধিভঙ্গের ব্যাপারে একটি মামলায় নির্বাচন কমিশনের আইনজীবীর পক্ষ থেকে জানানো হয় ‘‘নির্বাচন কমিশন নখদন্তহীন’’ ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বিভিন্ন নিয়মের কারণে তাদের স্বাভাবিকভাবেই দেরী হয়ে যায়৷ এই বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের কঠোর মনোভাব লক্ষ্য করে অতিশীঘ্রই নির্বাচন কমিশন শ্রীমতী মায়াবতী ও শ্রীযোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৪৮ ঘন্টা ও ৭২ ঘন্টার সমস্ত রকম প্রচারের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে৷ সুতরাং ইচ্ছা থাকলে যে এই অনিয়মগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় সেটা প্রমাণিত৷ এছাড়া প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার শ্রীযুক্ত টি.এন.শেষণ প্রমাণ করে দিয়েছিলেন যে--- সদিচ্ছা থাকলে স্বচ্ছ ও অবাধ নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব৷ ইতোপূর্বে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন অফিসারগণ নির্বাচনী প্রচারে সেনাবাহিনীর কৃতকর্মের উল্লেখ সম্পর্কে বিভিন্নভাবে তাঁদের অসন্তোষ ও বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেছেন৷ শুধু তাই নয় এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও যে বা যারা বিধি লঙ্ঘন করছেন তাদের পদমর্র্যদা বা রাজনৈতিক ক্ষমতা না দেখে নিরপেক্ষভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ অবশ্যই কাম্য৷ নচেৎ নির্বাচন ও গণতন্ত্র প্রহসনের নামান্তর হয়ে উঠবে৷
রাজনৈতিক নেতানেত্রী বা বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান যা প্রশাসন ও গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ---তাদের কাজকর্ম পরিচালিত হয় ব্যষ্টিগণের দ্বারা, আর এই ব্যষ্টিগণ নৈতিকতার দিক দিয়ে উন্নত না হলে অন্যায়, অনিয়ম, দুর্নীতির প্রাদুর্ভাব ঘটবেই৷ সেই কারণে, রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিকের নৈতিকতার মান উন্নত হলে সেই রাষ্ট্রের পরিচালন ব্যবস্থাও উন্নত হতে বাধ্য৷ অন্যথায় সমাজে বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়াটাই স্বাভাবিক৷ প্রকৃতপক্ষে একটি শোষণহীন সুন্দর সমাজব্যবস্থা সংরচনা করাই হলো সচেতন ও শুভবুদ্ধি সম্পন্ন নাগরিকগণের দায়িত্ব ও কর্তব্য৷ কিন্তু সেই সমাজের নেতৃত্ব যদি কোন স্বার্থপর, দাম্ভিক, দুর্নীতি পরায়ণ, সুযোগসন্ধানী ব্যষ্টির করায়ত্ত থাকে৷ তবে সেই সমাজ বা রাষ্ট্র কোনভাবেই দুর্নীতিমুক্ত হতে পারে না৷ তথাকথিত গণতন্ত্রের ধবজাধারীরা বাগাড়ম্বরপূর্ণ ধাপ্পাবাজি ও দুর্নীতির দ্বারা সমাজ ও মানুষকে শোষণের যাঁতা কলে পিষ্ট করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির অপচেষ্টা চালিয়ে যাবে৷ তাই গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে, প্রতিটি মানুষের নূ্যনতম প্রয়োজন (অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা) এর নিশ্চিততা প্রদান করতে হলে প্রতিটি মানুষকে সচেতনভাবে নৈতিকতার শিক্ষা গ্রহণ করতেই হবে৷ সকলের সঙ্গে সমতাভাব না এলে নৈতিকতার ফুল ফুটবে না৷ আর এর জন্যে চাই আধ্যাত্মিক চেতনা ও শিক্ষা৷ আধ্যাত্মিক অনুশীলনের মাধ্যমে নৈতিক চরিত্রকেও উন্নত করতে হবে৷ এইসকল দৃঢ় নৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট, আধ্যাত্মিকতায় সমুন্নত, আপোষহীন সংগ্রামী মানুষেরাই জনগণকে নিঃস্বার্থ সেবাদানে শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে পারবে৷ একমাত্র তখনই গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্য সাধিত হবে, নতুবা শুধু অস্ত্রের ঝংকার, হিংসা ও সন্ত্রাসের হুঙ্কার, অকথা কুকথার বিস্ফোরণ ও আত্মপ্রচারের ঢক্কানিনাদই সার হবে--- আর গণতন্ত্রের মৃত্যুশয্যার পাশে নিপীড়িত, লাঞ্ছিত, বঞ্চিত মানুষের অশ্রুসিক্ত হাহাকারে দিগ্বিদিক বিষাদ বাষ্পে ব্যাপ্ত হবে৷
- Log in to post comments