বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্ণিযুগের অগ্ণিবীণার অমোঘ উদাত্তবাণী ‘‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার ’’ আজও সমভাবে প্রাসঙ্গিক ও প্রযোজ্য৷ আজও দুর্গম গিরি কাণ্ডার মরু দুস্তর পরাবারকে লঙ্ঘিতে হবে রাত্রী নিশিতে৷ তাই প্রতিটি মুক্তি মোক্ষকামী পদযাত্রী অমৃতের সেন্তানকেই, প্রতিটি আলোর পথের দিশারীকে, জীবনের স্বর্ণ বালুবেলার অভিসারী সকলকেই আজ হুঁশিয়ারী কাণ্ডারীর মত কঠোর কঠিনহস্তে জীবন তরণীর দাঁড় বাইতে হবে অতি সন্তর্পণে৷ এটা ব্যষ্টিজীবনের ক্ষেত্রে যেমন প্রযোজ্য, গোষ্ঠী, সমষ্টিসহ সব মানবজাতির ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য৷ আজ একবিংশ শতাব্দীর উষালগ্ণে সর্বত্রই--- যথা সমাজ, সংস্কৃতিতে, শিক্ষায়, অর্থনীতি রাজনীতি ও তথাকথিত ধর্মনীতিতে তমসাঘন কালো মেঘপুঞ্জ--- যেকোন মুহূর্তে বিধবংসী ঝড়, ঘুর্ণিঝড়, দুর্নিবার ঝঞ্ঝা, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস,নিদারুণ আঘাতে ধরিত্রীর বুকে ওলট-পালট করে দেবে৷ এ বিষয়ে আর সন্দেহের বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই৷ তাই তো দেখি--- দুলিতেছে তরী, ফুলিতেছে জল, ভুলিতেছে মাঝিপথ৷ এমতাবস্থায় বজ্রনিনাদে, বিদ্যুতের অশনিসংকেতে মহাসমুদ্রের ওপার হতে উদাত্ত আহ্বানবাণী ভেসে আসে ওই--- ‘‘কে আছ জোয়ান, হও আগুয়ান, হাঁকিছে ভবিষ্যৎ৷’’ আর সেই সঙ্গে অবণীর শেষ সীমা হাতছানি দেয়, মিষ্টিমধুর সুরে কী যে কয়ে যায়৷’’ তাই সেই ডাকে সাড়া দাও এগিয়ে চলো, কাল ঘুম ত্যাগ করে জাগো, জাগো৷’’
হ্যাঁ, আজ সেই মহালগ্ণ, মহেন্দ্রক্ষণ সমাগত৷ তাই মাভৈঃ মন্ত্রে জাগতে তো হবেই৷ মহাকালের ডাকে, কাল পুরুষের নটরাজের সঞ্জীবনী ঐকতানে তাল মিলিয়ে, ছন্দে ছন্দ মিলিয়ে এগিয়ে চলতেই তো হবে৷ চরৈবেতি চরৈবেতি ভিন্ন অন্যকোন বিকল্প নেই৷ কালবৈশাখীর অবসানে একবিংশ শতকের মধ্যাহ্ণের উজ্জ্বল জ্যোতিতে শান্ত, স্নিগ্দ, সুরভিত, মনোরম আলোকজ্জ্বল পরিবেশ প্রতিষ্ঠিত হবেই৷
এহেন পরিস্থিতিতে প্রকোষ্ঠীকরণ (পোলারাইসশন) অবশ্যম্ভাবী৷ যুগে যুগে প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এটাই তো হয়ে আসছে আজ তার ব্যতিক্রম হয় কি করে? তাই আজকের এই অভিনব কুরুক্ষেত্রে হয় পাণ্ডব পক্ষ অথবা কৌরবপক্ষ, ধর্মের পথ নতুবা অধর্মের গহ্বর, পুণ্যের রথ অথবা পাপের শকট অবলম্বন করতেই হবে৷ নিরপেক্ষ থাকার কোন প্রশ্ণই ওঠে না৷ কারণ আজকের সংঘর্ষ শুধু, বাক্যবলের নয়, অথবা শারীরিক, বৌদ্ধিকক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, এ সংগ্রামে শারীরিক ও মানসিক শক্তি অপেক্ষা আধ্যাত্মিক শক্তির প্রাধান্য বেশী, গুরুত্ব বেশী৷ এ সংগ্রাম মানুষের শুভশক্তির সঙ্গে অশুভ শক্তির, দৈব চেতনার সঙ্গে পশু প্রবৃত্তির৷ এ সংগ্রাম দুর্নিবার৷ এ মহাধর্মযুদ্ধে ধর্মের জয় অবশ্যম্ভাবী৷ নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ভাষায়---‘‘কোন জাতিকে ধবংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে সময়ে বৈপ্লবিক পদ্ধতি অবলম্বন করা অপরিহার্য হয়ে উঠে৷ তাই আজ প্রভাত এসেছে ঝঞ্ঝার ঘুর্নিবায়ে, প্রলয়ের জটা পড়েছে ছড়ায়ে৷ তাই তো যে শুনেছে সে আহ্বানবানী ছুটেছে সে নির্ভীক পরানে, সঙ্কট আবর্ত মাঝে, দিয়েছে সে বিশ্ব বিসর্জন, মৃত্যুর গর্জন শুনেছে সে সঙ্গীতের মত৷
এহেন মহালগ্ণ ধরাপৃষ্ঠে কয়েকবারেই এসেছে৷ আজ থেকে প্রায় সাতহাজার বছর আগে---যখন মানুষ ও পশু একই সঙ্গে, প্রায় একই স্তরে, একই রকম জীবনযাপন করত, তখন প্রথম মহালগ্ণ--- এসেছিল সদাশিবের আগমনে৷ তিনি প্রথম মানুষের মধ্যে সভ্যতার বিকাশ এনে দিয়েছেন, মানুষকে বুদ্ধি দিয়ে, উন্নত মানসিকতা ও চিন্তাধারা ও সংঘচেতনা দিয়ে৷ এইভাবে প্রথম পশুপতি সদাশিব শৈবতন্ত্র, সাধনা, গণিতবিজ্ঞান, ছন্দবদ্ধ নৃত্য ও গীত, বৈদ্যশাস্ত্র, বৈবাহিক পদ্ধতি, সমাজ সংরচনার মন্ত্র শিখিয়েছেন মানুষকে৷৷ কারণ মানুষ বিশ্বস্রষ্টা পরমপুরুসের সবচেয়ে বেশী প্রিয় সৃষ্টি, অমৃতের সন্তান৷ তাই তো সদাশিব মানুষের জয়যাত্রার সূচনা করলেন, মানবতার উত্তরন ঘটালেন৷ আর দ্বিতীয় মহালগ্ণ উপনীত হয়েছিল৷ আজ থেকে সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আগমণে যখন সমাজে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, পীড়ণে, মানুষ হয়েছিল নির্যাতীত, নিপীড়িত, জর্জরিত, পরশুরাম, জরাসন্ধ, দুর্র্যেধন, দুঃসাশন যখন বাহুবলে মানবতাকে করেছিল ধূলব্যলুন্ঠিত৷ তখন সম্ভাবামী যুগে যুগে এই মাভৈ! মহামন্ত্রে নিপীড়িত মানুষকে সঞ্জীবিত করেছেন পরম দয়াল জগন্নাথ শ্রীকৃষ্ণ৷
এবার মহালগ্ণ এসেছে বিংশ শতকে ---যখন অবহেলিত ধূল্যবলুন্ঠিত মানবতা করুন আর্তনাদে তাঁকে ডেকেছেন তখন নিপীড়িত মানবতার সেই আহ্বানে তাঁকে আসতেই হয়েছে এই ধুলির ধরাধামে নবরূপে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের দুঃখ মোচনের নিমিত্ত৷ এবারে তিনি শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিরূপে বিশ্বের সার্বিক মঙ্গল সাধনের জন্য, আর্ত মানবতাকে রক্ষা করার জন্য, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য, ধর্মের মাহাত্ম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ও অধর্মের বিনাশের জন্য এসেছেন৷ এবারে তিনি এসেছেন সুদর্শন চক্র নিয়ে নয়, তিনি এসেছেন, সু-দর্শন অর্থাৎ ভাল সুন্দর দর্শন নিয়ে৷
এবারে তিনি কুরুক্ষেত্রে ধর্মযুদ্ধে সারথীরূপে পুরোভাগে না থেকে, অন্তরালে থেকেই অদৃশ্য অঙ্গুলি সঙ্কেতে ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন প্রকৃতির উপর দায়িত্ব দিয়ে৷ শক্তি (প্রকৃতি) সা শিবস্য শক্তি৷ আর শিবশক্তাত্মকং ব্রহ্মঃ৷ তিনি তাঁর সর্বানুসূ্যত অস্তিত্বের দ্বারা, সর্বব্যাপী আনন্দমার্গ মিশন প্রতিষ্ঠার দ্বারা এই কাজ করে চলেছেন৷ তাঁর সর্বানুসূ্যত কর্মপ্রেষণায়, সমাজে,সাহিত্য,শিক্ষা, সংস্কৃতি,রাজনীতি, ধর্মনীতি, কৃষি, শিল্প, বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্ত্তন সূচীত হয়েছে, মহান দার্শনিক সমাজগুরু, ধর্মগুরু, তারকব্রহ্ম, মহাকাল, মহাসম্ভূতি ও জগৎগুরু শ্রীশ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী বলেছেন---‘‘তোমরা যখনই যে কোন কাজ কর না কেন, মানবতার অবমাননা কখনও করো না৷ যখনই কোন কাজ করবে, ভেবে দেখবে সেটা মানবতা সম্মত কিনা৷ যে মুহূর্তে বিচারের ফলশ্রুটি তোমার মধ্যে জেগে উঠল যে এটা সৎকর্ম, একমুহূর্তে অপেক্ষা না করে, কর্ম সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ো, জয়--- তোমাদেরই হবেই৷ মানবতাকে বাঁচাতে, স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত করতে এ সুমধুর আহ্বান কতই না মর্মস্পর্শী৷ তাঁর দেওয়া নব্যমানবতাবাদ ও বিশ্বৈকতাবাদ তো এ কথাই প্রমাণ করে৷
- Log in to post comments