হিন্দি ভাষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত ---প্রশংসনীয় নয়

লেখক
মনোতোষ কুমার মণ্ডল

হিন্দি আগ্রাসনের সুকৌশলে প্রভাবিত কন্ঠশিল্পী সহ মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী রবীন্দ্র সংগীত গাইলেন রাজ্যসঙ্গীতরূপে---‘বাঙালীর স্থানে ‘বাঙলার’ শব্দ প্রয়োগ করে--- যা এক নিন্দনীয় পদক্ষেপ৷

একটা জাতিকে ধবংস করার প্রথম সোপান--- তার শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে বিকৃত করা ও তার সঙ্গে অভিপ্রকাশের স্বাভাবিক ও সহজতম মাধ্যম তার মাতৃভাষাকে অবদমিত করা৷ আর তারই সূত্রপাত করলেন---মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে বিকৃত ভাষায় রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে৷ এই কাজ মোটেই প্রশংসনীয় নয়---বরং এটা অবশ্যই বিশ্বকবির অবমাননা ও সেই সঙ্গে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর তীব্র কুঠারঘাত৷

বাংলায় একটা প্রবাদ বাক্য আছে---‘অল্প বিদ্যা ভয়ঙ্করী৷ হাঁ, এটাই হয়েছে৷ সঠিক জ্ঞানের অভাবেই মানুষ এই ধরণের নিন্দিত কর্ম করতে পারে৷ অন্যথা নয়৷ তাছাড়া ‘‘নেই কাজ তো খই ভাজ’’--- এখানে এটাও প্রযোজ্য হতে পারে৷

কোন একজন দার্শনিক বলেছেন---‘‘অল্পজ্ঞানী লাফায় বেশি, মধ্য জ্ঞানী চুপ৷ পূর্ণ জ্ঞানীর বিষয় বেশি, শান্ত তাহার রূপ৷৷’’

এছাড়া হিন্দিতেও একটা প্রবাদ আছে---‘‘অধজল গগরী ছলকত যায়’’ ভর্তি কলসীর জলে কোন শব্দ হয় না৷ কারণ একটাই ‘ফাঁপা ঢেকির শব্দ বেশি৷ যাই হোক--- এবার কাজের কথায় আসি৷

একজন সম্মানীয় ব্যষ্টি, যিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীও বটে, যিনি বিদ্যা বুদ্ধিতেও কম যান না,তাঁর কন্ঠে এই ধরনের বিকৃত ভাষা গান করা, যার দ্বারা বাঙালি সমাজ আজ মর্মাহত,মোটেই শোভনীয় হয়নি৷ এ কাজ গর্হিত কাজ৷ একাজ--ঘৃণিত কাজ৷ একাজ বাঙালীর আবেগে তীব্র কষাঘাতের কাজ৷ কিন্তু এমনটা কেন হলো? আমার মনে হয়, এর পিছনে অবশ্যই কোন দুরভিসন্ধি কাজ করছে৷ যা তিনি বুঝতে পারেন নি৷

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বাঙালী হৃদয়ের এক বিশাল আবেগ---যা প্রতিটি বাঙালীর মর্মে গাঁথা এক অবিস্মরণীয় জীবন কাহিনী৷ তাই রবীন্দ্র সঙ্গীত শুধু গান নয়--- বাঙালীর  আবেগের মর্মবাণী৷ সেই গানের একটা শব্দও এদিক ওদিক করার অর্থ বাঙালীর আবেগকে মর্মাহত করা ছাড়া আর কিছু নয়৷ এ হন নিন্দনীয় কাজ--- মোটেই শোভনীয় নয়৷ এটা অবশ্যই বিকৃত চিন্তাধারার প্রতিফলন৷ যাই বা হোক, এই ধরণের অন্যায় আচরণের জন্য তাঁর উচিত বাঙালী জনগোষ্ঠীর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করা৷ কারণ এ ধরণের  অন্যায় ও গর্হিত কাজের মাধ্যমে বাঙালী সমাজের হৃদয়ের আবেগ যে কষাঘাত করেছেন৷ তা অবশ্যই কঠিন বেদনাদায়ক৷ তিনি তা যদি না করেন তাহলে অবশ্যই তাঁকে  তীব্র প্রতিবাদের শিকার হতেই হবে৷ সুতরাং সাধু সাবধান৷

রবীন্দ্রনাথের কবিতার উপর কলম চালানো--- অবশ্যই দুঃসাহসিক কাজ৷ তবুও তাঁরই পদতলে মাথা রেখে তাঁর রচিত কবিতার সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিতে বাধ্য হচ্ছি৷ কারণ আজকের পরিস্থিতিতে এটার প্রয়োজন আছে৷ ভুল ত্রুটি সবাই নিজ গুণে ক্ষমা করবেন৷

বিশ্বকবির যে গানটি ফিল্ম ফেষ্টিভ্যালের মঞ্চে গীত হয়েছিল তাতে মোট চারটি স্তবক আছে৷ প্রথম দুটি স্তবক যথারীতি গীত হয়েছিল৷ কিন্তু শেষের দুটি স্তবকে ‘বাঙালির পণ’ বাঙালির আশা ইত্যাদি শব্দগুলোর জায়গায় বাঙালির  বদলে ‘বাংলার পণ’, ‘বাংলার আশা’ ইত্যাদি শব্দগুচ্ছের ব্যবহার করেছেন--- যা কেবল নিন্দনীয়ই নয়---সামাজিক অপরাধ---সাংস্কৃতিক অপরাধও বলা যেতে পারে যার শাস্তি অপরিমেয়৷

কবিতাটির তৃতীয় স্তবকে আছে---

‘বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,

বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা,

সত্য হউক, সত্য হউক, সত্য হউক হে ভগবান৷’’

বাঙালির পণ--- যার অর্থ হচ্ছে--- বাঙালির প্রতিজ্ঞা, সেখানে ‘বাঙলার পণ’ শব্দগুচ্ছটি মোটেই প্রযোজ্য নয়৷ কারণ কোন পণ বা প্রতিজ্ঞা কোন ভূখণ্ড করে না, প্রতিজ্ঞা করে--- সেই ভূখণ্ডের মানুষ অর্থাৎ বাংলার পণ নয়---বাঙালির পণ৷ এছাড়া বাঙালির আশা, বাঙালির কাজ, বাঙালীর ভাষা এগুলো মোটেই ভূখণ্ডের মধ্যে সীমায়িত নয়৷ কারণ এ সবই হচ্ছে বাঙালীর হৃদয়ের আবেগ--- বাঙালীর মর্মবাণী--- বাঙালীর হৃদয়ের আকুতি৷ সেই আবেগের আবেদন---কভু অস্বীকরণীয় নয়--- মোটেই নয়৷

বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষা অতি বৃহৎ৷ বাঙালী জনগোষ্ঠী কেবল বাঙলার মাটি ধরে বসে থাকতে চায় নি--- তাঁদের আশা আকাঙ্ক্ষার বিশ্বব্যাপী প্রতিফলনে সদা সর্বদা ধবনিত হয়--- বিশ্বৈকতাবাদের অমর বাণী৷ তাই বাঙালী মনের উদার ভাবনাকে মর্মাহত করে তিনি যে গর্হিত ও নিন্দনীয় কাজ করেছেন তার একমাত্র প্রায়শ্চিত্ত--- ক্ষমা ভিক্ষা করা৷

এখানে আরেকটা কথা অবশ্যই স্মরণীয়, যে বাঙালীর নিজস্ব বাসভূমি কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়৷ কারণ পশ্চিমবঙ্গ সন্নিহিত ঝাড়খণ্ড, অসম, উড়িষ্যা, ত্রিপুরা ইত্যাদি রাজ্যেও বাঙালী জনগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ--- একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়৷ এই গানের শব্দ পরিবর্তনের  মাধ্যমে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন বাঙালী তারাই যারা পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক অন্যরাজ্যের বাঙালী জনগোষ্ঠী--- বাঙালী নয়৷ এটা অবশ্যই ক্ষুদ্র মানসিকতার পরিচয় ছাড়া কিছু নয়৷ কারণ একটাই--- ধন, সম্পদ, শক্তি ও সাহসের প্রাচুর্য--- মানুষের মনকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে দেয়৷ অবশেষে সঙ্কীর্ণ মানসিকতার শিকার হয়ে বৃহত্তর ভাবনা থেকে ক্রমশঃ দূরে সরে যায় আর এটাই হয়েছে৷ এই অবস্থায় যে কোন মানুষ সামাজিক আবেগের কথা সম্পূর্ণ রূপেই ভুলে যায়৷ কারণ ভূলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক৷

শেষের স্তবকে আছে ‘বাঙালীর প্রাণ, বাঙালীর মন, ইত্যাদি৷ বাংলা একটা ভূখণ্ড৷ কোন ভূখণ্ডের মন প্রাণ বলে কিছু নেই--- যা আছে তা তার জনগোষ্ঠীর--- অর্থাৎ বাঙালীর প্রাণ,বাঙালীর মন৷ এছাড়া অন্য কোন শব্দ ব্যবহারযোগ্য নয়৷ সুতরাং যে ঘৃণিত কাজ তিনি করেছেন তার একমাত্র শাস্তি ক্ষমা প্রার্থনা৷ ক্ষমা ভিক্ষার পথ ধরেই তিনি পুনরায় বাঙালীর মনে আশ্রয় পেতে পারেন৷ অন্যথা নয়৷