মানুষ সাধনা করে ঈশ্বর প্রাপ্তির জন্যে৷ এখন ঈশ্বর সম্প্রাপ্তিটা কেমন জিনিস? –না, নিজের সত্তাটা, নিজের অস্তিত্বৰোধটা পরমপুরুষে মিলিয়ে দেওয়া৷ এই মিলিয়ে দেওয়ার উপায়টা কী? সাধনার দ্বারা নিজেকে, নিজের সমগ্র সত্তাৰোধকে পরমপুরুষের কাছে নিয়ে যাওয়া ও এর সঙ্গে সঙ্গে আর কী করা? –না, কীর্তনের দ্বারা পরমপুরুষকে আকৃষ্ট করে তাঁকে নিজের নিকটে নিয়ে আসা৷
আধ্যাত্মিক সাধনা কেবল মানুষই করতে পারে, মনুষ্যেতর কোন জীব পারে না৷ তবে ভবিষ্যতে হয়তো মানুষ ছাড়া অন্যান্য জীবও সাধনা অভ্যাসের সুযোগ পাবে৷ যারা মানুষের শরীর পেয়েছে তাদের মধ্যে এমনি একটা ভ্রান্ত ধারণা ৰদ্ধমূল হয়ে গেছে যে যারা পতিত, যারা পাপী, তারা সাধনা করবে কী করে? আমি তো সেই সব তথাকথিত পাপী–পতিত মানুষদের আহ্বান জানিয়ে বলব যে মানুষ তো আধ্যাত্মিক সাধনা করবেই, এমন কি উন্নত পশুরাও সাধনার সুযোগ পাবে৷ কাজেই কেউ যেন একথাটা না ভাবে যে, যেহেতু সে পাপী সেহেতু সে পরমপুরুষের সান্নিধ্যে আসতে পারবে না৷ তোমাদের সে অধিকার রয়েছে, ভবিষ্যতেও থাকবে৷
মানুষ এই যে এগিয়ে যাবে, এই এগিয়ে যাওয়ার সাধনায় যে কেবল তার মন ও আত্মা এগিয়ে যাচ্ছে তা তো নয় তার শারীরিক লাভও হচ্ছে৷ শারীরিক লাভটা কী? –না, শারীরিক ঋজুতার সঙ্গে সঙ্গে ৰৌদ্ধিক বিকাশও হচ্ছে, মাথার ঘিলুও বাড়ছে৷ মানুষ অতি মনুষত্বের দিকে এগিয়ে চলেছে৷ মানুষ যখন সাধনার দ্বারা পরমপুরুষের দিকে এগোতে থাকে তখন আত্মিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক বিকাশও ঘটে থাকে৷ দেখবে, এই পৃথিবীতে যাঁরা বড় বড় কাজ করেছেন, জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বড় বড় আবিষ্কার করেছেন, মানব সমাজের সর্বাত্মক উন্নতির জন্যে বহু মহান চিন্তাভাবনার প্রসার ঘটিয়েছেন তাঁরা সকলেই ছিলেন বিশিষ্ট সাধক–উচ্চ আধ্যাত্মিক জগতের মানুষ৷ জড়ের উপাসনার দ্বারা, জড় ৰুদ্ধির দ্বারা সম্প্রেষিত হয়ে কখনও কোনো মহৎ কর্ম সম্পন্ন করা সম্ভব নয়৷ এইখানেই আধ্যাত্মিকতার মাহাত্ম্য৷
অর্থাৎ শারীরিক, জাগতিক, পাঞ্চভৌতিক স্তরেও লাভই হচ্ছে৷ আর লাভ হচ্ছে মানসিক ও আত্মিক জগতেও৷ মনটা বেড়ে যাচ্ছে, উদার হয়ে যাচ্ছে, প্রসৃত হয়ে যাচ্ছে৷ একটা মনের মধ্যে হাজারটা মন ঢুকে যাচ্ছে৷ একটা মানুষের মন যদি অতি বিরাট হয়ে যায় তাতেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দু’শ পাঁচ শ’ মন ঢুকে যেতে পারে৷ পরমপুরুষের বেলায় কী হয়? –না, তাঁর মন অতি বিশাল অতি বিরাট, ও তাঁর মনের মধ্যে জগতের সব মনগুলো ঢুকে রয়েছে৷ কার কোন্ মনের মধ্যে কোন্ সংবেদন জাগছে, কে কী মনের মধ্যে ভাবছে সব স্পন্দন তাঁর বিরাট মনের মধ্যে স্পন্দিত হয়ে যাচ্ছে, প্রতিস্পন্দিত হয়ে যাচ্ছে৷ তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা জেনে যাচ্ছেন৷
কেউ ভাবল–আজ জেনার্যাল দর্শনটা যদি একটু দেরী করে হয় তাহলে দুপুরের আহারটা সেরেই যাব৷ আবার কেউ ভাবছে–সেরে যাব কী, সেরে যাব না? বাবা কখন এসে যাবেন কে জানে? এখন এই যে মনের মধ্যে চিন্তাটা হচ্ছে–এই চিন্তাটার ভেতরে বাইরে সব দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে পরমপুরুষের মন৷ তাই কে কী ভাবছে–সে যখনই ভাবছে পরমপুরুষ তখনই জানছেন, শুণে নিচ্ছেন তার মনের কথা৷ তিনি যে কেবল মনের ব্যথা, মনের আনন্দ, মনের শোকাশ্রু আর মনের হর্ষোৎফুল্লতা জানছেন তাই নয়, সব কিছুই তাঁর বিরাট মনের মধ্যে প্রতিস্পন্দিত হয়ে চলেছে৷ তিনি একান্ত নিকট
এ যাবৎ পৃথিবীতে যত বড় বড় ব্যষ্টিত্বের আবির্ভাব ঘটেছে, যাঁরা মানব জাতির প্রগতির জন্যে, মানবতার সেবার জন্যে যা কিছু করে গেছেন তাঁরা সবাই ছিলেন পরমপুরুষের প্রতি একান্তভাবে অনুরক্ত৷ আর যাদের হূদয়ে পরম পুরুষের প্রতি প্রেম নেই, যাদের হূদয় মরুভূমির মত শুষ্ক, তাদের দ্বারা কখনো বড় কাজ হতে পারে না৷ তারা হয়তো যোগী হয়ে পর্বতের গুহায় কালাতিপাত করতে পারে কিন্তু জগতের কল্যাণের ব্যাপারে তাদের কোনো মূল্য নেই৷
তোমরা সার্থক সাধনার দ্বারা যেমন যেমন অন্তর্লোকে এগিয়ে চলবে সঙ্গে সঙ্গে দুঃস্থ মানবতার সেবাও করে চলবে৷ আর তোমাদের সেই ত্যাগ–তিতিক্ষা–সাধনা ও সেবায় পরমপুরুষও প্রীত হবেন৷
(সকালবেলা, ৩০ ডিসেম্বর ১৯৮০, আনন্দনগর