জানা ও না-জানা

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

জানা মানে হ’ল একটা বিশেষ মানসিক প্রক্ষেপ৷ না-জানাও হ’ল আরেকটা বিশেষ ধরনের মানসিক প্রক্ষেপ৷ একটা ধনাত্মক, অপরটা ঋণাত্মক৷ সুতরাং দু’টোই মানসিক প্রক্ষেপ৷ তাই বেদে বলা হয়েছে

‘‘নাহং মনো সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ৷

 যো নস্তং বেদ তৎবেদ নো ন বেদেতি৷৷’’

বৈদিক ঋষি বলছেন, আমি এমন কথা মনে করছি না যে আমি জানি৷ আবার আমি এমন কথাও মনে করছি না যে আমি জানি না৷ কারণ, আমি জানি অথবা আমি জানি না---এই দুটোই মানসিক প্রক্ষেপ৷ আর যা’ পরম তত্ত্ব তা’ মানসিক তত্ত্বের ঊধের্ব৷ সুতরাং মানসিক ভাবনা অনুযায়ী বা মানসিক সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে রূপ দেওয়া বা রূপান্তরিত করা সম্ভব নয়৷

সেই জন্যেই যথার্থভাবেই বৈদিক ঋষি বলেছেন, ‘‘আমি জানি না যে আমি জানি অথবা আমি জানি না৷’’ আমি জানি কি না অথবা আমি জানি না কি না---এটা আমি জানি না৷ কারণ, জানা বা জ্ঞানের মধ্যে এলেই তাকে ইতিবাচক বা নেতিবাচক রূপ Positive বা negative) দিতে হবে৷ অথবা যা’ মানসাতীত, মানস জগতের উধের্ব, তাকে আমি ধনাত্মক মানসিক রূপ দিতেও পারি না, ঋণাত্মক মানসিক রূপ দিতেও পারি না৷ যেমন, কিছু নেই---কে মানুষ যখন নিজের মনোবিকলনের দ্বারা কোনো রূপ দিয়ে দেয়, মনস্তত্ত্বে যাকে ইতিবাচক মূল্যায়ন (Positive valuation) বলা যায় অথবা যার অস্তিত্বকে নসাৎ করে দেওয়া যায়, যাকে নেতিবাচক মূল্যায়ন (negative valuation) বলা যায়---এ দু’টোই মানসিক ক্রিয়া মাত্র ও যিনি মানস সত্তার উধের্ব তিনি এ ধরনের মানসিক পরিধির মধ্যে তো আসবেন না৷ সেইজন্যে বলা হচ্ছে---

‘‘যস্যামতং তস্য মতং মতং যস্য ন বেদ সঃ৷

অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতং বিজানতাম্‌৷’’

একটা লোক বলছে, আমি এই জিনিসটা খুব ভালভাবে জানি, জোর করে তর্ক করছে আর বলছে---বই থাকলে দেখিয়ে দেব৷ কিন্তু সে দেখাচ্ছে কী? --- না, দেখাচ্ছে ১৯১২ সালের কোনো একটা ভূগোলের বই যাতে লেখা রয়েছে কলিকাতা ভারতের রাজধানী৷ সে ঠিক কথা বলছে, কারণ ১৯১২ সালে কলকাতা থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লীতে চলে গেছে৷ সুতরাং আগেকার বইয়ে ওই কথা লেখা আছে৷ সেই বইয়ের ভিত্তিতেই সে তর্ক করে যাচ্ছে, বইতে সে দেখিয়ে দিচ্ছে কিন্তু বইটাই ভুল৷ কারণ, ১৯১২ সাল থেকে অন্য যে সমস্ত বই, লেখা হয়েছে তাতে লেখা আছে দিল্লী ভারতের রাজধানী দিল্লী ভারতের রাজধানী এখনও নয়৷ তা’ নোতুন দিল্লী ভারতের রাজধানী সুতরাং যে নিজেকে অত বড় পণ্ডিত মনে করছে ও দৃঢ়ভাবে বলছে যে ‘আমি জানি’, আসলে সে জানে না৷

আবার যে লোকটা ভাবে যে সে কিছুই জানে না কিন্তু সে-ই হয়তো ঠিক জিনিসটা জানে৷ তা’ আমাদেরও সেই জন্যে কে বেশী জ্ঞানী আর কে অজ্ঞান বুঝতে গেলে অনকখানি মাথা ঘামিয়ে তবে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে৷ হঠাৎ কিছু বলতে পারি না, ফট্‌ করে কিছু বলতে পারি না, বলবার আগে অনেক ভাবতে হবে৷

এখানে একটা ছোট্ট কথা বলে শেষ করছি৷ এক্ষুণি বললুম কিনা, ‘ফট্‌’ করে কিছু বলতে পারি না৷ প্রাচীনকালে তন্ত্রে যে সমস্ত ৰীজমন্ত্র ছিল তার মধ্যে একটা বীজের নাম ছিল ‘ফট্‌’ একটার নাম ‘বষট্‌’ আরেকটার নাম ‘বৌষট্‌’৷ এক এক ধরনের ক্রিয়ার পূর্বে এক একটা তান্ত্রিক বীজ নিক্ষেপ করা হ’ত৷ এটা ছিল নিয়ম৷

কোনো কাজে বীজকে দ্রুত কর্মে রূপান্তরিত করা হত৷ অর্থাৎ ভাবনাকে দ্রুত কর্মে রূপান্তরিত করা হত৷ হঠাৎ ইচ্ছা উঠল, কটক যাই, সঙ্গে সঙ্গে বেরিয়ে পড়ল অর্থাৎ ইচ্ছাকে তাড়াতাড়ি রূপ দেওয়া হ’ল৷ তাই কোনো কাজ, কোনো ভাবনাকে যদি দ্রুত কর্ম রূপ দেওয়া হত তাহলে তান্ত্রিক নিয়ম ছিল সেই কাজটা করার আগে ‘ফট্‌’ মন্ত্র উচ্চারণ করা৷ সেই জন্যে আমরা এখনও বলি লোকটা ফট্‌-ফট্‌ করছে---বড্ড ফট্‌-ফট্‌ করছে৷ ‘ফট্‌’ বলে ওই তান্ত্রিক বীজটাকে৷ কোনো কাজ তাড়াতাড়ি করতে চাইছে এই অর্থে৷ ‘বড্ড ফটটানি’---লোকে বলে না এসব! আমিও বললুম যে ফট্‌ করে বলা যায় না যে কে পণ্ডিত আর কে অপণ্ডিত৷ একটু ভেবেচিন্তে বলতে হয়৷ এখানে তান্ত্রিক বীজ ‘ফট্‌’টা প্রয়োগ না হওয়াটাই ভাল৷                                               ২০ ডিসেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা