জাতি, ভাষা, ধর্মমত ও সংস্কৃতিতে বিশ্বজনীনতা

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হ’ল ‘‘জাতি (race), ভাষা প্রভৃতিতে বিশ্বজনীনতা’’৷ যদিও মানুষের ভাষা, বর্ণ ইত্যাদিতে কিছু কিছু আপাত বৈষম্য রয়েছে, তথাপি মানুষের এই সকল অপরিহার্য বিষয়গুলি কিন্তু এসেছে একই উৎস থেকে, এইসব এসেছে সেই একক সত্তা পরমপুরুষ থেকে৷ ভাষাগত বৈষম্য, বর্ণগত বৈষম্য, জাতিগত বৈষম্য আছে ঠিকই কিন্তু এই সই বাহ্য ও আপাতদৃষ্ট৷ মুখের ভাষা নয়, আসলে হৃদয়ের ভাষা, সেণ্টিমেণ্টের ভাষাই শুণতে হবে৷

কোন ভাষাই আদি ভাষা বলে দাবী করতে পারে না, তা সে ইংরেজীই হোক, বা তাগালগ হোক বা বাংলাই হোক৷ ইংরেজী ভাষা আদি ভাষা (original language) নয়৷ ৯০০ বছর আগে ইংরেজী ভাষা ছিল না৷ ১৫০০ বছর আগে বাংলা ভাষা ছিল না৷ ৮০০ বছর আগে অঙ্গিকা, মৈথিলী, অসমীয়া ভাষা ছিল না৷ আধুনিক ইংরেজী ভাষা হ’ল স্কচ, পুরানো নর্মাণ্ডি, অ্যাংলো-স্যাক্সন, ব্রিটন, কেল্ট, ল্যাটিন ও গ্রীক কথ্যভাষার মিশ্রণ৷ এই সকল কথা ভাষাই মিলিত ভাবে জন্ম দিয়েছিল আধুনিক ইংরেজী কথ্যভাষা আলফ্রেড দি গ্রেট্’ এর রাজত্বকাল পর্যন্ত ইংরেজী ভাষায় কোন স্বীকৃত শব্দভাণ্ডার ছিল না৷ এমনিভাবে দেখা যায়, বাংলা ভাষা সংস্কৃত ধাতু ও শব্দ, বিপুল সংখ্যক ইংরেজী শব্দ, জাপানী, পর্তুগীজ, আরবীয় প্রভৃতি শব্দ দিয়ে তৈরী৷ এমনিভাবে তাগালগ ভাষা তৈরী হয়েছে ক্যাণ্টনীজ, চাইনিজ, ইন্দোনেশিয়ান, মালয়েশিয়ান শব্দ ও বেশ কিছু সংস্কৃত শব্দ নিয়ে৷

ঠিক এমনিভাবে কোন জনগোষ্ঠীই তার রক্তের পুরোপুরি বিশুদ্ধতা দাবী করতে পারেনা৷ হিটলার যে আর্য রক্তের বিশুদ্ধতা দাবী করতেন, সেটা বস্তুতঃ জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে৷ এক ইয়ূরোপেই রয়েছে নানা জনগোষ্ঠী, যেমন নর্ডিক, ভূমধ্যসাগরীয় অ্যালপাইন, মঙ্গোলীয়ান, মঙ্গোলো-নিগ্রোয়েড প্রভৃতি৷ ভারতবর্ষে রয়েছে অষ্ট্রিকো-নিগ্রোয়েড, দ্রাবিড়ীয়, মঙ্গোলীয়, মঙ্গোলো-নিগ্রোয়েড--- এমনি সব জনগোষ্ঠী৷ সুতরাং কোন জনগোষ্ঠীই এই রক্তগত সংমিশ্রণ থেকে মুক্ত নয়৷ সর্বত্রই চলছে এই বিশ্বজনীন সংমিশ্রণ৷ বিশ্বের কোথাও একটা মৌলিক জনগোষ্ঠী বা ভাষা খুঁজে পাওয়া যাবে না৷ মানব-সমাজ একটা একক সত্তা৷ সমাজের সকল দোষ গুণ সে-সব আমাদের সকলের৷ সব গুণগুলি আমাদের আর সব খারাপগুলি অপরের এরকম দাবী করা নির্বুদ্ধিতা৷

এই বিশ্বে সকল সত্তাই দিব্যসত্তা---এটাই মানুষকে উপলব্ধি করতে হবে৷ কেউই এই বিশ্বে একা বা অসহায় নয়৷ বিশ্বের সঙ্গে আমাদের রয়েছে ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পর্ক৷ যেহেতু বিশ্বের সকল সীমিত সত্তার মধ্যে অসীমের ক্ষুধা রয়েছে তাই সকল মানুষকেই তাদের মনের পরিভূ বাড়িয়ে চলতে হবে৷ এটা তাদের অবশ্য করণীয়৷ সর্র্বন্ধন মুক্ত পরম সত্তাই সার লক্ষ্য৷ মানুষকেও এমনভাবে মনের বিস্তার ঘটাতে হবে---যাতে সে সমস্ত সীমার ন্ধন অতিক্রম করে যায়৷ কারুর মনের মধ্যেকোন হীনম্মন্যতা বা মহাম্মন্যতা থাকবে না---থাকা উচিতও নয়৷ যারা ব্যষ্টিগত বা জাতিগত শ্রেষ্ঠতা প্রচার করে, তারা পাপ কাজ করছে৷ তারা মানব-ধর্মের বিরোধিতা করছে৷ মাটি, জল, বায়ুর মত ধর্মও সকলের সাধারণ (common) সম্পদ৷ সবাইকেই ভূমাসত্তার সঙ্গে মিলে মিশে এক হয়ে যেতে হবে৷

প্রখ্যাত আমেরিকান কবি কাল স্যাণ্ডবার্গের ভাষায়---

‘There is only one man in the world

                And his name is All-men

There is only one woman in the world

                And her name is All-women

There is only one child in this universe

                And her name is All-women’’

ঠিক এই কথাটিকেই অতি সুন্দর ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এশিয়ার কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত---

                ‘‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে

                                সে জাতির নাম মানুষ জাতি

                একই পৃথিবীর স্তন্যে লালিত

                                একই রবি শশী মোদের সাথী৷’’