জাতিস্মরত্ব

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

অনেকদিন আগে রাঁচীতে আমি স্মৃতি, মস্তিষ্ক সঞ্জাত স্মৃতি ও অমস্তিষ্ক সঞ্জাত স্মৃতি সম্বন্ধে কিছু বলেছিলুম৷

মানুষ এ জীবনে অনেক কথা মনে রাখে, আবার অনেক কথা ভুলে যায়৷ মানুষ অনেক কিছু পড়ছে, শিখছে৷ আবার আজ যা শিখছে, কাল ভুলে যাচ্ছে আবার অনেকে কিছু পূর্ব জন্মের কথাও মনে রাখে৷ পূর্ব জন্মের কোনো কোনো ঘটনা---এ জন্মের ঘটনা নয়----এরূপ জিনিস তোমার মনে থাকতে পারে৷ তুমি সেগুলোকে স্বপ্ণের মত করে দেখতে পাও৷ তুমি জানো না যে ওই ঘটনাগুলো তোমার জানা কিন্তু তোমার মনে আছে৷ এই স্মৃতিগুলোকে বলা হয় অ-মস্তিষ্কসঞ্জাত স্মৃতি (non-cerebral memory)৷ রাঁচীতে একবার দেখিয়েছিলুম যে একজন মানুষ ৫০ বছর, ১০০ বছর, ৫০০ বছর পিছনে চলে গেলে সেই অবস্থায় সে কী দেখছে৷

এই যে অ-মস্তিষ্ক সঞ্জাত স্মৃতি, আসলে এটা কী? সাধারণ ভাবে ‘স্মৃতি’ বলতে ৰোবায় যে স্মৃতিকে তুমি তোমার মস্তিষ্কে স্নায়ু-কোষের মাধ্যমে ধরে রাখতে পার৷ কিন্তু ওই স্মৃতির বেলায় তোমার স্নায়ুকোষগুলো কোনো সাহায্য করবে না, করতে পারে না কারণ বিগত ঘটনাগুলোর কোনো স্মৃতিই তোমার বর্তমান মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষগুলোতে জমা হয়ে নেই যে তোমার তা’ মনে থাকবে৷ কারণ, তোমার ওই পুরাতন স্নায়ুকোষগুলো সবই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ তোমার দেহ পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তার সঙ্গে তোমার স্নায়ুকোষগুলোও পুড়ে মাটির সঙ্গে মিশে এক হয়ে গিয়েছিল৷

এ জীবনে মানুষ যা কিছু দেখে বা শোণে সেগুলো বর্তমান মস্তিষ্ক স্মৃতি রূপে সঞ্চিত হয়ে থাকে৷ কিন্তু পূর্ব জীবনের কথাটা তো আর এই স্নায়ুকোষেতে জমা নেই৷ কারণ, পূর্ব জীবনের স্নায়ুকোষটা তো পূর্ব জীবনের শরীরের সঙ্গেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে৷ তাহলে মনে থাকবে কী করে? মনে থাকছে কীভাবে?

মানুষ যখন দেহত্যাগ করে তখন তার সঙ্গে তার পূর্ব জীবনের সংস্কারটাও থাকে৷ সংস্কারটা কী? ---না, পূর্ব জীবনে যে কাজটা সে করেছে কিন্তু সেই কর্মের ফলপ্রাপ্তি হয়নি অর্থাৎ কর্মটা হয়ে গেছে, ফল প্রাপ্তি হয়নি---সেই ফলপ্রাপ্তিটা বীজ রূপে সম্ভাবনাময় অবস্থায় তার মনের সঙ্গে থেকে যায়৷ আর পরের জীবনে সেই সম্ভাবনাটা অর্থাৎ যেটা অভুক্ত কর্মফল রূপে ছিল যার ফল এখনও পাওয়া হয়নি---শুধু কর্মই করা হয়েছিল, সেইটার স্ফুরণ ঘটাবার জন্যে যে ধরনের শরীর প্রয়োজন-সেই ধরনের শরীর ধারণ বা আধার আশ্রয় করে৷ সেই ধরনের নার্ভসেল পায়, সেই ধরনের শরীর পায়৷’

এই যে পূর্ব জন্মের সংস্কারটা, যেখানে কর্ম করা হয়েছে কিন্তু কর্মের ফলপ্রাপ্তি হয়নি, কর্মের সমাপ্তি হয়েছে কিন্তু ফল প্রাপ্তি হয়নি, এইটাকেই ‘সংস্কার’ (reactive momenta) বলা হয়৷ ওই সংস্কারের সঙ্গে মানুষ ব্যষ্টিগতভাবে জড়িত ছিল৷ পূর্ব জন্মের সেই লোকটা অর্থাৎ তার মনটা জড়িত ছিল৷ তাই যে সমস্ত বিশেষ বিশেষ ঘটনার সঙ্গে তার মনটা জড়িত ছিল, সেই সেই ঘটনার সংস্কার আজও তার মধ্যে রয়েছে৷ যে ঘটনার সংস্কার নিয়ে আজ সে জন্মেছে সেই ঘটনাগুলো তার মনে থাকে৷ কোনো কোনো মানুষের মধ্যে সেটা আবছা, অপরিষ্কার, অপরিচ্ছন্ন ভাবে মনে জমা থাকে৷ কেউ কখনো কখনো হঠাৎ একলা বসে রয়েছে, মনের মধ্যে আজগুবি কল্পনা এল যে ‘আমি, তো এই জমিটার মালিক ছিলুম, ওই জমিটা তো আমি চাষ করতুম’--এই কথাটা মনে এল৷ এটা হ’ল কী? সেই পূর্ব জন্মের সংস্কার ওই সঙ্গে জড়িত ছিল বলে সেটা হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল৷ সে তখন ৰুঝতে পারছে না যে এক্ষেত্রে তার পূর্ব জন্মের কথাটাই মনে পড়ছে৷ কিন্তু এ রকম সব মানুষেরই হয়৷ কিন্তু কিছু কিছু মানুষের এমন হয় যে পূর্ব জন্মের কথাটা, হুবহু চিত্রটাই তার মনে থাকে, আর সেইগুলো হয় যদি প্রথমতঃ সে খুব উন্নত ধরনের মানুষ হয়, দ্বিতীয়তঃ যে মানুষটার ইচ্ছামৃত্যু হয়েছে অথবা যে মানুষটা সজ্ঞানে মরেছে অর্থাৎ যার মরবার সময়ে জ্ঞান ছিল, আর তৃতীয়তঃ যদি সেই মানুষটা কোনো দুর্ঘটনায় মরে গিয়ে থাকে৷ এই তিন রকম ক্ষেত্রে পূর্ব জন্মের কথাটা তার ভালভাবে মনে থাকে৷

সাধারণতঃ এই ধরনের স্মৃতি বেশীদিন মনে থাকে না৷ বার-তের বৎসর অবধি কিছুটা মনে থাকে৷ তারপর আস্তে আস্তে ভুলে যায়৷ কারণ, মনে থাকলে হয় কী? ‘দ্বৈত ব্যষ্টিত্ব বা dual personality থেকে যায়৷ এই জন্মে তার নাম হ’ল রামকুমার আর পূর্ব জন্মে নাম ছিল হরিহর৷ এখন একই মানুষের মধ্যে দু’টো ব্যষ্টিত্ব (personality) থেকে যাচ্ছে৷ এই হয় ব্যাপারটা৷

তা’ যারা এই জিনিসটা, এই স্মৃতিটা, মনে রাখে বা মনে রাখতে পারে এই বার/তের বৎসর অবধি- সংস্কৃত ভাষায় তাদের বলা হয় ‘জাতিস্মর’৷ মানুষ যদি সাধনার দ্বারা নিজের মনকে বিন্দুতে পরিণত করতে পারে, একাগ্র করতে, সূচ্যগ্র করতে পারে কিন্তু তার সংস্কার পূর্ণ হয়নি, সেক্ষেত্রে পর জন্মে সে পূর্ব জন্মের সব কথাই বলতে পারে---সব কিছুই মনে রাখতে পারে৷ কিন্তু আমি কখনই কোনো সাধককে জাতিস্মর হবার জন্যে চেষ্টিত হতে বলি না৷ কারণ, তোমার অতীত জীবনের ইতিকথা জেনে তুমি কী করবে? কেবল ভবিষ্যতের কথা জানতে চেষ্টা করো৷ আর ভবিষ্যৎটা কী? ভবিষ্যৎটা কী হওয়া উচিত! তুমি পরমপুরুষের সঙ্গে এক হয়ে মিলে যাও---সব তুমি জানতে পারবে৷ তাঁর সঙ্গে একীকরণ করো ও অমৃতানন্দ উপভোগ করো৷ পরমপুরুষের সঙ্গে তোমার একীকরণের অর্থ হ’ল পরমানন্দ ভোগ করা৷ পূর্ব পূর্ব অজন্মগুলোর অতীত ইতিহাস জেনে তোমার কী প্রয়োজন? ওই জানাটা তোমার আধ্যাত্মিক অগ্রগতিকে কোনো সাহায্য করবে না৷                                     ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা