জাতীয়  নাগরিকপঞ্জীকরণ সমস্যা-সমাধান কোন পথে

লেখক
গৌরাঙ্গ রুদ্রপাল

গত ৩০শে জুলাই অসমে জাতীয় নাগরিক পঞ্জীকরণ(এন.আর.সি)-এর কারণে যে চল্লিশ লক্ষাধিক বাঙালির  নাম বিদেশির  খাতায় উঠল  তাদের ভবিষ্যতের  প্রশ্ণে গোটা বাঙালি সমাজ এখন  গভীরভাবে উদ্বিগ্ণ৷ কারণ  অসমে  বিদেশি চিহ্ণিত হওয়া  মানে তারা  গোটা ভারতবর্ষেই বিদেশি মানে তারা গোটা ভারতবর্ষেই বিদেশি  বা অবৈধ  অনুপ্রবেশকারী  এ ধরনের  মানুষদেরকে  তো ভারত সরকার এদেশে  স্থান দেওয়ার কথা নয়৷  তাহলে নিশ্চয়ই  নাগরিক পঞ্জীকরণের  পরের ধাপ  হবে  সেই  চল্লিশ লক্ষ বিদেশি  বাঙালিদেরকে  অন্য কোনও  দেশে ঠেলে  দেওয়া৷ সেটি  কোন দেশ--- পাশের  বাংলাদেশ কী?  নতুন করে নেবে বাংলাদেশ এই বিপুল সংখ্যক মানুষের  দায়িত্ব৷ এ ব্যাপারে  ভারত  সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশ  সরকারের কোনও কথা বার্র্ত হয়েছে কি?  হয়নি, হওয়ার কথাও নয়৷ কারণ বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই  জানিয়ে দিয়েছে যে  তাদের  দেশের  কোনও নাগরিকই ভারতে প্রবেশ করেনি ও  নাগরিকপঞ্জীর বিষয়টি  সম্পূর্ণভাবেই  ভারতের  অভ্যন্তরীণ ব্যাপার৷ এই যখন  অবস্থা তখন  বিদেশির খাতায় নাম উঠা ৪০ লক্ষ  বাঙালির  ভবিষ্যৎ কী হতে পারে  সহজেই  অনুমেয়৷ তাই বিষয়টি  এখন জাতীয় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ লোকসভা, রাজ্যসভায়  এ নিয়ে  উঠেছে ঝড়৷ তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা ব্যানার্জিই এব্যাপারে  সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকায়৷ এ পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে  শুধু রাজনীতিই হয়ে চলেছে৷ সমাধানের  রাস্তায়  কিন্তু হাঁটছে না৷ অবশ্য বিষয়টি  অত্যন্ত  স্পর্শকাতর ও জটিল৷ কয়েকশ  বা কয়েক  হাজার  মানুষ তো  নয়৷ সংখ্যাটা  যেহেতু  চল্লিশলক্ষের  উপর তাই  এন.আর.সির বলি দুর্র্ভগা  বাঙালিদেরকে  ঠেলে  বিভিন্ন রাজ্যে  পাঠিয়ে  পুনর্বাসনের  ব্যবস্থা করা  যাবে  তাও সম্ভব নয়৷ আর  বাঙালিরাই  বা যাবে কেন?  অতীত দিনের  দণ্ডকারণ্য বা মরিচঝাঁপির স্মৃতি  কী  বাঙালিরা  ভুলে গেছে?  তাহলে উপায়?

উপায় অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকার একটা বের করেছে৷ সেটি কী?  না ---ডিটেনশন ক্যাম্প যা  জেলখানারই আরেক নাম৷ অবশ্য ডিটেনশন ক্যাম্পের  ফর্মুলা  আবিষ্কার  করে গেছে পূর্বতন  কংগ্রেস সরকার৷ একথা  সবাই জানেন যে,  এন. আর. সি’র প্রয়োগ  অসমের  পূর্বতন  কংগ্রেস  সরকারের আমলেই  শুরু হয়৷ তাদের আমলেই  ১৯৮৫ সালে অসমে  পাশ  হয় অগপ-রাজীব গান্ধি চুক্তি  যার প্রতিপাদ্য বিষয় ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চ পর্যন্ত  যারা অসমে  এসেছে  তারা বৈধ নাগরিক৷ এরপর যারা  অসমে  প্রবেশ করবে তারা  অবৈধ নাগরিক বা অনুপ্রবেশকারী Illegal migrants) হিসাবে  চিহ্ণিত  হবে৷  অথচ ভারতের  নাগরিকত্ব আইনের  একটি ধারা অনুযায়ী কারও জন্ম  যদি ভারতের  মাটিতে  হয় তবে জন্ম সূত্রেই সে ভারতের  নাগরিক Citizenship by Birth)৷ ভারতের নাগরিকত্ব  আইনের  অন্য ধারায়  বলা আছে যে, কেউ  যদি একটানা  ৫ বছর  বাইরের কোন দেশ থেকে এসেও  ভারতে বসবাস করে  ভারতের সংবিধানের রীতিনীতি মেনে চলেন  তবে  তিনিও ভারতের নাগরিক হবার  যোগ্যতা অর্জন  করবেন৷  কাজেই বর্তমানে অসমের  বাঙালিরদের উপর  যে এন.আর.সি  নামক বিধির প্রয়োগ  করা হয়েছে তা  সংবিধানের  উল্লেখিত  ধারা  দুটিকে  যে লঙ্ঘন  করা হয়েছে  তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না৷

অন্যদিকে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি বা রাজীব-অগপ চুক্তিকে সামনে  রেখে  যারা এন.আর.সি প্রয়োগের  মাধ্যমে  লক্ষ লক্ষ  বাঙালিকে ডিটেনশন  ক্যাম্পে  পাঠিয়ে  ফৌজ লেলিয়ে দিয়ে, ভয় দেখিয়ে, দাবিয়ে রেখে  সমস্যার সমাধান করতে চান তাদেরকে  স্বাধীনতার  সময় দেওয়া যে জাতীয় প্রতিশ্রুতিWhenever the minorities of East Bengal will cross the border they will be welcome .  অর্র্থৎ যখনি পূর্ববঙ্গের  সংখ্যালঘুরা সীমানা অতিক্রম করবে  তাদের  স্বাগত  জানানো হবে--- তা ভুলে গেলে হবে না৷ পঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্র্বসনের  ব্যবস্থা করা হলেও  বাঙালি উদ্বাস্তুদের ক্ষেত্রে  যে ছিটেফোঁটাও করা হয়নি তা কিন্তু  বাঙালিরা  ভুলে  যায় নি৷ কাজেই এন.আর.সির  কোপে পরা  বাঙালিদের  ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠাবার  আগে  বা দেশছাড়া  করার পূর্বে  উল্লেখিত  বিষয়গুলিও ভেবে  দেখতে হবে৷ নইলে বিজ্ঞানের  ধর্ম  অনুযায়ী ক্রিয়ার সমান বিপরীত  প্রতিক্রিয়া হতে বাধ্য৷ এতে নতুন করে অসম তথা দেশজুড়ে  অশান্তি  বাড়ার  দায় নিতে  হবে অসম বা কেন্দ্র  সরকারকেই৷ বাস্তবে  অসমের  বর্তমান  সমস্যাটা যতটা  না জাতিগত তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক৷ এই সমস্যা সৃষ্টির  নেপথ্যে রয়েছে সংকীর্ণমনা কিছু কায়েমি  স্বার্থবাদী   রাজনীতিবিদ৷ ইতিহাস  পর্যালোচনায় দেখা যায় যে অতীতে  অসম  বলে কোনও প্রদেশই  ছিল না৷ বাঙালির  নেতৃত্বে  স্বাধীনতা সংগ্রামকে  বানচাল করতেই ব্রিটিশ সরকার অসম রাজ্য  গঠন করে বাংলার  রংপুর  ও মৈমনসিং জেলা থেকে  গোয়ালপাড়া, নওগাঁও, কামরূপ  হোজাই-লংকা , লামডিং ও ১৯২২ সালে শ্রীহট্টের  ১২টি থানা এলাকা  তথা  কাছাড়কে  অসমের সঙ্গে  জুড়ে  দেওয়া হয়৷ কাজেই  বর্তমান  অসমের  সেইসব অঞ্চল  ওরিজিন্যালি বাংলার জায়গা  ও সেখানকার  অধিবাসী  বাঙালিরা  যে  সেখানকার  ভুমিপুত্র  তা বলার অপেক্ষা  রাখে না৷  অথচ  অত্যন্ত পরিতাপের  ও বেদনার বিষয় এই যে আজ সেইসব অঞ্চলের লক্ষ লক্ষ  বাঙালিরা  এন.আর.সির  বলি৷ বর্তমান  অসমের সাহিত্য  ,কৃষ্টি সংসৃকতি, অর্থনীতি  সবকিছুর  উন্নতির মূলে বাঙালিদের যে  বিশাল অবদান  রয়েছে  তা কি  কেউ অস্বীকার করতে পারে?

অপরদিকে অসমে জনজাতিদের ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখা  যায় যে সৃষ্টির  আদি থেকে অসমিয়ারা অসমের স্থায়ী বাসিন্দা নয়৷ কোনও কোনও  ঐতিহাসিকদের মতে ত্রয়োদশ শতাব্দী হলেও আধুনিক  ঐতিহাসিকদের  মতে ১৬৮৯ সাল  থেকে অহম বা অসম জনগোষ্ঠীর মানুষেরা পাশের  আরাকানের মতো বিভিন্ন দেশ থেকে  অসমে এসে বসবাস শুরু করে৷ এর আগেই নিষাদ, কারাত, বোর, কোর ইত্যাদি জনজাতির মানুষেরা অসমের  বনাঞ্চলে  প্রবেশ  করেছে বলে কোনও কোনও  নৃতত্ত্ববিদ ও ঐতিহাসিকদের অভিমত৷ ১৯৫১ সালের  জনগণনাতে দেখা যায় অসমে বাঙালিরা অসমিয়াদের চেয়ে অনেক বেশী ছিল যদিও  পরে তাতে ব্যাপক কারচুপি  করে অসমিয়াদের  সংখ্যাগুরু হিসাবে  দেখানো হয়৷ তারপরের ইতিহাস সবার জানা৷ শুরু হয় জাত্যভিমানের খেলা, বাঙালি জাতিবিদ্বেষ৷ অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ঘোষণা করলেন--- ‘অসম শুধু অসমিয়াদের জন্য৷ তারপর  আর এক মুখ্যমন্ত্রী বিমলা প্রসাদ চালিহা ১৯৬০ এর ১০ই অক্টোবর  অসম  বিধানসভায়  বাংলা ভাষাকে  খতম  করার লক্ষ্যে  আইন পাশ করলেন যাতে অসমিয়া ভাষাই হবে অসমের একমাত্র সরকারী ভাষা৷ এর প্রতিবাদেই ১৯৬১-র ১৯শে মে কাছাড়ে হয়েছিল বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলন যাতে ১১জন বাঙালি বীর যুবক-যুবতী প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন৷ তাঁদের  আত্মত্যাগই  সেদিন  অসমের বুকে বাংলা ভাষাকে  বাঁচিয়ে দিয়েছিল৷  এর আগে  ও পরে অর্র্থৎ ১৯৫১, ১৯৫৩-৫৪, ১৯৬০-৬১, ১৯৬৪,১৯৭১, ১৯৮৩ সালে বাঙালিদের উপর অসমে বার বার আক্রমণ নেমে এসেছে ৷ এত কিছুর পরেও কিন্তু নিজেদের জন্মভূমি ভেবে  অসমের বাঙালিরা অসমকে  আপন  করে নিয়েছিল৷ অসমের বাঙালিদের কাছে  হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে যতটা প্রিয় ঠিক ততটাই  প্রিয় ভূপেন হাজারিকা৷ কাজেই বর্তমান এন.আর.সি  তথা অসম সমস্যা সমাধানে  বাঙালিদের  ভাবাবেগ  ও সেইসঙ্গে  অসমের অগ্রগতিতে বাঙালিদের  কায়িক  ও বৌদ্ধিক শ্রম বা অবদানের  কথা ভুলে  গেলে  চলবে না৷  অধিকন্তু যেই বাঙালিরা জন্মসূত্রে অসম, বাংলা বা অবিভক্ত ভারতের  ভূমিপুত্র  তাদেরকে শুধু চুুক্তি বা এন.আর.সির অজুহাত দেখিয়ে বিদেশি বা অবৈধ নাগরিক  হিসাবে  চিহ্ণিত করা যে চূড়ান্ত মানবতাবিরোধী উল্লেখিত সমস্যা সমাধানের  সময় তাও মনে রাখতে হবে৷

যেহেতু এন.আর.সি’র কবলে পড়া ৪০ লক্ষাধিক  বাঙালিদের  দায়িত্ব  অন্য আর কেউ নেবে  না তাই  না এহেন  পরিস্থিতিতে সবচেয়ে ভাল হয় বাঙালিদের নাগরিকত্বের অধিকার হরণ না  করে  সমধিকারের ভিত্তিতে বাঙালি ও অসমিয়া সমাজকে  বসবাসের  ব্যবস্থা করে  দেওয়া৷ অসম তথা ভারতের সংহতি  ও স্বার্থ বিনষ্টকারী  অবৈধ অনুপ্রবেশকারী  বাছাইয়ের  প্রশ্ণে শুধু ভিত্তিসাল  কতটা যুক্তিযুক্ত তা  এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে৷ আর যদি  তা না করা যায় তবে বর্তমান  অসম সমস্যা সমাধানের  সর্বশেষ উপায় হতে পারে বাঙালি প্রধান অঞ্চলগুলি কেটে নিয়ে ভারতের সংবিধানের ৩নং ধারা  মোতাবেক  আলাদা  রাজ্য গঠন  অথবা সেইসব অঞ্চলগুলিকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে বৃহত্তর  বঙ্গপ্রদেশ  গঠন  যা স্বাধীনতার সময় দেওয়া জাতীয়  প্রতিশ্রুতি  ছিল৷  তা না করে গায়ের জোরে যদি  অসম বা কেন্দ্রীয়  সরকার এন.আর.সি-র কবলে পড়া ৪০ লক্ষাধিক  বাঙালিকে ডিটেনশান ক্যাম্প ঠেলে  দেবার ব্যবস্থা করে তবে অসমের পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত৷ আমাদেরকে মনে রাখতে হবে ভারতের শত্রুপক্ষ কিন্তু সুযোগ  নেওয়ার জন্য ওতপেতে বসে আছে৷