এক এব সুহূদ্ধর্ম নিধনেহপ্যনুযাতি যঃ’’৷ ধর্মই তোমার একমাত্র সুহৃদ (এক ধরণের বন্ধু যা মৃত্যুর পরেও মানুষের সঙ্গে থেকে যায়)৷ সংস্কৃতে ‘বন্ধু’ শব্দের কয়েকটিই প্রতিশব্দ রয়েছে৷ ‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ সদৈবানুমতঃ সুহৃদ৷ একক্রিয়ং ভবেন্মিত্রং সমপ্রাণাঃ সখা স্মৃতঃ৷৷’’ ‘‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ’’৷ যে বিচ্ছেদ–বেদনা সহ্য করতে পারে না সে–ই বন্ধু৷ যার সঙ্গে তোমার ভালবাসার সম্পর্ক এতই দৃঢ় যে তোমার বিচ্ছেদ তার কাছে অসহনীয় বলে মনে হচ্ছে তাকেই বলব বন্ধু৷ পারস্পরিক স্নেহ–ভালবাসার এই বন্ধন এতই দৃঢ় যে সে তোমার কাছ থেকে দূরে থাকতে পারে না–তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না৷ এই পৃথিবীতে বাস্তবে দেখা যায়, প্রত্যেকেই তোমার বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে৷
কেউ যখন মারা যায়, তার বাবা–মা–ভাই–বোনেদের দেখে কী মনে হয় দেখবে, ওরা গলা ছেড়ে হাপুসনয়নে কাঁদছে৷ দু’–তিন দিন যেতে না যেতেই আবার তারা স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ তারা আবার তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে শুরু করে দেয়৷ আর কয়েক দিন বা কয়েক মাস কেটে গেলে তো আর কথাই নেই৷ তারা সংশ্লিষ্ট লোকটিকে বেমালুম ভুলে যায়৷ যে সব সমাজে বিধবা–বিবাহ স্বীকৃত সেখানে বিধবারা স্বামীর মৃত্যুর পর পুনর্বিবাহ করে থাকেন৷ প্রসঙ্গতঃ বলি, ভারতবর্ষের হিন্দু সমাজের উচ্চ শ্রেণীতে বিধবা–বিবাহ মেনে নেওয়া হয় না৷ কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই, এমন কি ভারতবর্ষেও অনেক ক্ষেত্রে বিধবার বিবাহ সমাজ–স্বীকৃত৷
তাই বলছিলুম, তোমার কোন আত্মীয়কেই তুমি বন্ধু বলতে পার না৷ এক্ষেত্রে কেউই তোমার বন্ধু নন৷ ভারতীয় রীতিনীতি অনুসারে পিতামাতার যদি কেবল একটি মাত্র সন্তান থাকে তবে তাঁরা অন্য জনকেও দত্তক নিতে পারেন৷ তাহলে তোমার প্রকৃত বন্ধু কে?
উত্তরে বলব, জগদ্বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু৷ পরমপুরুষই তোমার আসল বন্ধু৷ তিনি অতীতে তোমাকে ভালবেসেছেন–ভবিষ্যতেও তোমাকে ভালবাসবেন৷ তিনিই কেবল তোমার বন্ধু–তিনি যে জগদ্বন্ধু৷ ‘সুহৃদ’৷ ‘বন্ধু’ শব্দের আরেকটা প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘সুহৃদ’৷ সুহৃদ তাকেই বলব যার সঙ্গে কোন দিন কোন মতের অমিল হয়নি বা হবে না৷ অথচ বাস্তব জগতে মতের অমিল তো সব সময় হয়েই থাকে৷ যেমন স্বামীর সঙ্গে স্ত্রীর বা ভাইয়ের সঙ্গে ভাইয়ের৷ পরমপুরুষের ক্ষেত্রে কী হয়?–না, তুমি যা–ই কর তিনি সমর্থন জানান–জানাতে থাকেন৷ তিনি এমনটি কেন করেন? –না, করেন এই জন্যে যে তিনি তোমার প্রকৃত বন্ধু৷
হাত–পা দিয়ে তিনি হয়তো তোমার জাগতিক কাজকর্ম করে দেন না ঠিকই, কিন্তু মানস জগতে তিনি সব সময় তোমাকে নির্দেশনা দিয়ে চলেছেন যদিও জাগতিক ক্ষেত্রে তিনি সরাসরি কিছুই করেন না৷ তাই তিনি ভাল মানুষেরও যেমন সুহৃদ তেমনি মন্দ মানুষেরও সুহৃদ৷ তিনি সকলেরই সব সময় সুহৃদ৷ ‘‘এক এব সুহৃদ্ধর্ম নিধনেহপ্যনুযাতি যঃ৷’’ তিনিই কেবল তোমার মৃত্যুর পরেও সঙ্গে থেকে যাবেন৷ হয়তো মৃত্যুর পর তোমার বন্ধুরা তোমাকে শ্মশান পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাবে৷ সৎকারের পর তোমার শরীরটা যখন পুড়ে ছাই হয়ে যাবে, তখন তোমার বন্ধুরা হয়তো চিতাভস্মের ওপর কিছুটা জল ছিটিয়ে দেবে৷ তারপর নিঃশব্দে তারা নিজের নিজের বাড়ী ফিরে যাবে৷ যতক্ষণ তারা শ্মশানঘাটে থাকবে শুধু ততক্ষণই তোমার কথা ভাববে৷ তারপর সব কিছুই ভুলে যাবে৷
‘ধর্ম’ কিন্তু তোমার মৃত্যুর পরও সঙ্গে থেকে যাবে৷ আর ধর্ম রক্ষার্থে তুমি পৃথিবীতে যা যা করেছ তাও চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে৷ তাই পার্থিব জগতে ধর্মনিষ্ঠ হতে হবে৷ তাহলে ধর্মও তোমাকে শক্তি যুগিয়ে যাবে৷ তাই বুদ্ধিমান ও বুদ্ধিজীবী মানুষদের উচিত ধর্মের হাত শক্ত করা৷ আর তুমি তোমার বন্ধু ধর্মের হাত শক্ত করলে ধর্মও তোমাকে বিপদে আপদে রক্ষা করবে৷
‘মিত্রম্’৷ যখন কোন দু’টি মানুষ একই পেশাভুক্ত–তারা একই ধরণের কাজে নিযুক্ত, তখন তাদের বলব ‘মিত্র’৷ যেমন ধর, দু’জন ডাক্তার, দু’জন উকিল বা দু’জন ব্যবসায়ী৷ এদের পরস্পর ‘মিত্রম্’ বলব কারণ এদের কাজের ধরণটা একই রকমের৷ এ বিচারে দু’জন চোরকেও ‘মিত্রম্’ বলতে পারি৷ সংস্কৃতে ‘মিত্র’ শব্দটি যখন পুংলিঙ্গে ব্যবহূত হয় তখন ‘মিত্র’ মানে সূর্য৷ আর ক্লীবলিঙ্গে ব্যবহূত হলে তখন ‘মিত্র’ মানে সহকর্মী৷ শব্দটির ক্লীবলিঙ্গ রূপ হ’ল ‘মিত্রম্’৷
‘সখা’৷ ‘সখা’ ব্যাপারটা হচ্ছে, যেখানে দু’জনের কেবল শরীরটাই আলাদা কিন্তু মন দু’টো ভাবে–ভালবাসায় যেন একেবারে এক, এ ধরণের মানুষকে বলব ‘সখা’৷ তাই পরমপুরুষ ছাড়া আর কে–ই বা সখা হতে পারে? অর্জুনের সখা ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ৷ এভাবে দেখতে গেলে এই পৃথিবীতে ‘ফ্রেণ্ড’ friend অর্থে যে চারটি সমার্থক শব্দ রয়েছে তার মধ্যে ‘বন্ধু’, ‘সুহৃদ’ বা ‘সখা’ কেবল পরমপুরুষই হতে পারেন৷ এই আপেক্ষিক জগতে তুমি ‘মিত্রম্’ খঁুজে পেলেও পেতে পার কিন্তু ‘বন্ধু’, ‘সুহৃদ বা ‘সখা’ পাবে না৷ কেবল পরমপুরুষের জন্যেই এসব শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে৷ তিনিই তোমার সব কিছু৷ তাঁকে বাদ দিয়ে তুমি কিছুই করতে পার না৷ পরমপুরুষের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা কেমন –না, যেমন জলের সঙ্গে মাছের সম্পর্ক৷ তাই তাঁকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা বৃথা–বরং সুখে দুঃখে সব সময় তাঁকে মনে রাখার চেষ্টা করো৷ জীবনের সর্বক্ষেত্রে সর্বস্তরে সব সময় তাঁকে মনে রাখাকেই বলে ‘ধ্রুবাস্মৃতি’৷ সাধনার দ্বারা ধ্রুবাস্মৃতিকে বাড়িয়ে তোল আর তাঁর সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যাও, চিরকালের জন্যে অনন্ত প্রশান্তিতে প্রতিষ্ঠিত হও৷ (পটনা, ২৫শে অক্টোবর, ’৭৮)