জীবনবেদের গুপ্ত গায়ত্রী

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

যদি কোন বৃহৎ বা ভারী বস্তুকে কেউ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, তার পক্ষে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে সেই বস্তুটার বীজটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া৷ একটা গোটা বটগাছকে এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া খুব শক্ত৷ কিন্তু সেই বটবৃক্ষের একটা ছোট্ট বীজকে নিয়ে যাওয়া সহজ৷ বীজটাকে নিয়ে গেলেই গাছটাকে নিয়ে যাওয়া হ’ল৷

অনেক শব্দ, অনেক কথাকে যদি সংক্ষেপে বলা হয় সেক্ষেত্রে সেই সংক্ষিপ্তসারকে বলা হয় সূত্র৷ ঠিক তেমনই অনেক ভাবকে যদি সংক্ষেপে আনতে হয়, তাহলে তাকে বলা হয় তার বীজমন্ত্র৷ অনেক কথার বীজ হ’ল সূত্র, অনেক ভাবের বীজ হ’ল বীজমন্ত্র৷ পণ্ডিতেরা অনেক বই লেখেন–বড় বড় বই৷ বিশ পাতার বইয়ে যে কথা লেখা আছে সেই কথাই হয়তো চার–পাঁচটা শব্দে বলা হ’ল৷ এই চার–পাঁচটা শব্দকে বলব সূত্র৷ প্রাচীনকালে দার্শনিকরা তাঁদের দর্শনের বিষয়সমূহকে সূত্রাকারেই লিখে রাখতেন৷ মহর্ষি কপিল তাঁর ‘সাংখ্যসূত্রম্’, মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর ‘পাতঞ্জল দর্শন’ সূত্রাকারেই লিখে গেছেন৷ অনুরূপভাবে আনন্দমার্গের দর্শনও ‘আনন্দসূত্রম্’ পুস্তকে সূত্রাকারেই লিখিত হয়েছে৷

ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোন্ জায়গায় স্থিত? –না, ‘‘তস্য স্থিতি অমানসিকেষু’’৷ সমাধির অবস্থিতি কোন্ জায়গায় স্থিত? –না, ‘‘তস্য স্থিতি অমানসিকেষু’’৷ এই ছোট্ট একটি কথায় বলা হ’ল৷ এর ব্যাখ্যা করতে গেলে হয়তো তিন–চারখানা বই লিখতে হবে৷ ঠিক তেমনই মানুষের মধ্যে যে বিদ্যার ভাব, যে intellect–তার অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক অভিব্যক্তি যাই হোক না কেন–তার জন্যে বীজমন্ত্র রয়েছে ‘ঐং’৷ এই সৃষ্টির বুকে কত রকম ধারা বিস্তৃত হয়ে চলেছে৷ সমস্ত সৃষ্টির জন্যে একটা বীজমন্ত্র ‘অং’ বা ‘অ’৷ যা কিছু পাঞ্চভৌতিক অভিব্যক্তি–কত বিরাট এই বিশ্ব তার বীজ হল ‘ক’৷ এই জন্যে ‘ক’ আমাদের বর্ণমালার প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ৷ অবশ্য সংস্কৃত ভাষায় ‘ক’–এর অনেকগুলি অর্থ আছে৷ যেমন, ‘ক’ হ’ল (১) প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ (২) পাঞ্চভৌতিক সৃষ্টির বীজ (৩) কার্যব্রহ্ম (৪) সংবৃত্তিবোধিচিত্ত (পরমপুরুষের মন যখন সংবৃত্তিতে রয়েছে সেই বোধিচিত্তকে বলা হয় ‘ক’৷ এই ‘ক’–কে অর্থাৎ সৃষ্ট জগৎকে যিনি পালন করেন, সেবা করেন তিনিই ‘কাপালিক’ অর্থাৎ যিনি সৃষ্ট জগতের সকলের সেবা করেন)  (৫) ‘ক’–এর আরেকটা অর্থ হ’ল জল৷ ‘ক’–এর দ্বারা ছাদিত তাই কচ্ছ অর্থাৎ যে জায়গাটার চার দিকে জল৷ ভারতবর্ষের গুজরাটে কচ্ছ নামে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল রয়েছে৷

আমরা আনন্দমার্গে এইরকম সূত্রের ব্যবহার প্রায়ই করে থাকি৷ যেমন Education, Relief And Welfare Section –আমাদের আনন্দমার্গের একটা শাখা৷ আমরা সংক্ষেপে বলি ERAWS. কম কথায় কাজ সারা হ’ল৷ সেইরকম প্রতিটি মানুষের একটা জীবনবেদ থাকবে৷ এখন জীবনবেদ সম্বন্ধে বলতে গেলে অনেকখানি বলতে হয়৷ অত বলাও মুস্কিল, আবার মনে রাখাও মুস্কিল৷ সেইজন্যে মানুষের জীবনধর্মের যে বীজ, জীবনবেদের যে বীজ, অনেকদিন আগেই আমি তা তৈরী করেছিলুম৷ মুখে মুখে দু’একজনের কাছে তা বলেও ছিলুম কিন্তু প্রকাশ্যে বলিনি৷ সেইটাই আজ বলব৷ সেটাও একটা সূত্রবৎ–ভবিশ্চ ঃ ভ, বি, স, চ৷

মানুষের সব ক্ষেত্রেই এই চারটা অক্ষর স্মরণ রাখা উচিত৷ তাহলে তার প্রগতি হবেই৷ এটা হ’ল গুপ্ত বীজমন্ত্র–গুপ্ত গায়ত্রীও বলতে পার৷ এই যে ‘ভ’, এই ‘ভ’ মানে ভগবান এখানে ‘ভগবান’ শব্দটা ব্যবহার করছি পরমপুরুষ অর্থে৷ পরমপুরুষও ভগবান৷ ‘ভগ’ শব্দের দ্বারা কতকগুলো বিশিষ্ট গুণ বোঝায়৷ যেমন, আমরা বলি ভগবান বুদ্ধ, ভগবান শ্রীচৈতন্য, ভগবান শঙ্করাচার্য ইত্যাদি৷ আবার তেমনই পরমপুরুষও ভগবান৷ এখানে আমার উদ্দেশ্য পরমপুরুষের ভাবটাই রাখা৷ সংস্কৃত ভাষায় লৌকিক অর্থে ‘ভগ’ মানে ভাগ্য৷ যেমন, প্রাচীন সংস্কৃতে একটা শব্দ ছিল ‘ভগধর’৷ ‘ভগধর’ মানে ভাগ্যধর বা ভাগ্যবান৷ এই শব্দটাই আবার পুরাতন ফারসী ভাষায় হয়ে গেল ‘বহধর’ সেইটাই আবার পাঞ্জাবী ভাষায় হয়ে গেল ‘বহদর’, উর্দুতে হ’ল ‘বাহাদুর’, হিন্দীতেও ‘বাহাদুর’, আবার বাংলাতেও ‘বাহাদুর’৷ এখানে পরমপুরুষ যে অর্থে ভগবান সে ক্ষেত্রে ‘ভগ’ শব্দটার অর্থ হ’ল–

 

‘‘ঐশ্চর্যঞ্চ সমগ্রঞ্চ বীর্যশ্চ যশসঃ শ্রিয়ঃ৷

জ্ঞান–বৈরাগ্যঞ্চ যন্নাং ভগ ইতি স্মৃতম্৷৷’’

অণিমা, লগিমা, গরিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, ইত্যাদি আট প্রকারের ঐশ্বর্য রয়েছে৷ অণিমা হ’ল নিজেকে খুবই ছোট করে কারও মনের ভেতর ঢুকে যাওয়া, তার মনের ভেতরকার সব কথা জেনে নেওয়া৷ লঘিমা মানে হালকা হয়ে মিশে যাওয়া ও সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হওয়া আর কোথায় কী হচ্ছে দেখে নেওয়া৷ মহিমা মানে গুণের অপূর্ব অভিব্যক্তি ঘটিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে সব গুণই একটা বস্তুতে বা একটা আধারে থাকতে পারে৷ ঈশিত্ব মানে কখনও বা নিয়ন্ত্রণ করে, কখনও বা শাসন করে, ভয় দেখিয়ে, বকাঝকা করে বা বুঝিয়ে–সুঝিয়ে ভালবেসে কাজ আদায় করে নেওয়া৷ এই রকমের আটটা ঐশ্বর্য রয়েছে৷ এটা হ’ল এক নম্বর গুণ৷

তারপর দ্বিতীয় গুণ বীর্য৷ প্রবাদ আছে, লোকে ভালবাসে আবার কিন্তু ভয়ও পায়৷ এই জিনিসটা কেন হয়? ‘বিনু ভয় হোই ন পিরিতি’ বলে একটা কথা আছে হিন্দীতে৷ একটু ভয় না থাকলে ভালবাসা হয় না৷ যাকে ভালবাসব তার প্রতি একটু ভয় থাকা দরকার৷     (ক্রমশঃ)