যদি কোন ৰৃহৎ বা ভারী বস্তুকে কেউ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে চায়, তার পক্ষে সবচেয়ে ৰুদ্ধিমানের কাজ হবে সেই বস্তুটার ৰীজটাকে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া৷ একটা গোটা বটগাছকে এক স্থান থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া খুব শক্ত৷ কিন্তু সেই বটবৃক্ষের একটা ছোট্ট ৰীজকে নিয়ে যাওয়া সহজ৷ ৰীজটাকে নিয়ে গেলেই গাছটাকে নিয়ে যাওয়া হ’ল৷
অনেক শব্দ, অনেক কথাকে যদি সংক্ষেপে বলা হয় সেক্ষেত্রে সেই সংক্ষিপ্তসারকে বলা হয় সূত্র৷ ঠিক তেমনই অনেক ভাবকে যদি সংক্ষেপে আনতে হয়, তাহলে তাকে বলা হয় তার ৰীজমন্ত্র৷ অনেক কথার ৰীজ হ’ল সূত্র, অনেক ভাবের ৰীজ হ’ল ৰীজমন্ত্র৷ পণ্ডিতেরা অনেক বই লেখেন–বড় বড় বই৷ বিশ পাতার বইয়ে যে কথা লেখা আছে সেই কথাই হয়তো চার–পাঁচটা শব্দে বলা হ’ল৷ এই চার–পাঁচটা শব্দকে বলব সূত্র৷ প্রাচীনকালে দার্শনিকরা তাঁদের দর্শনের বিষয়সমূহকে সূত্রাকারেই লিখে রাখতেন৷ মহর্ষি কপিল তাঁর ‘সাংখ্যসূত্রম্’, মহর্ষি পতঞ্জলি তাঁর ‘পাতঞ্জল দর্শন’ সূত্রাকারেই লিখে গেছেন৷ অনুরূপভাবে আনন্দমার্গের দর্শনও ‘আনন্দসূত্রম্’ পুস্তকে সূত্রাকারেই লিখিত হয়েছে৷
ঈশ্বরের অস্তিত্ব কোন্ জায়গায় স্থিত? –না, ‘‘তস্য স্থিতি অমানসিকেষু’’৷ সমাধির অবস্থিতি কোন্ জায়গায় স্থিত? –না, ‘‘তস্য স্থিতি অমানসিকেষু’’৷ এই ছোট্ট একটি কথায় বলা হ’ল৷ এর ব্যাখ্যা করতে গেলে হয়তো তিন–চারখানা বই লিখতে হবে৷ ঠিক তেমনই মানুষের মধ্যে যে বিদ্যার ভাব, যে নুব্ধন্দ্বপ্তপ্তন্দ্বন্–তার অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক অভিব্যক্তি যাই হোক না কেন–তার জন্যে ৰীজমন্ত্র রয়েছে ‘ঐং’৷ এই সৃষ্টির বুকে কত রকম ধারা বিস্তৃত হয়ে চলেছে৷ সমস্ত সৃষ্টির জন্যে একটা ৰীজমন্ত্র ‘অং’ বা ‘অ’৷ যা কিছু পাঞ্চভৌতিক অভিব্যক্তি–কত বিরাট এই বিশ্ব তার ৰীজ হল ‘ক’৷ এই জন্যে ‘ক’ আমাদের বর্ণমালার প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ৷ অবশ্য সংস্কৃত ভাষায় ‘ক’–এর অনেকগুলি অর্থ আছে৷ যেমন, ‘ক’ হ’ল (১) প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণ (২) পাঞ্চভৌতিক সৃষ্টির ৰীজ (৩) কার্যব্রহ্ম (৪) সংবৃত্তিৰোধিচিত্ত (পরমপুরুষের মন যখন সংবৃত্তিতে রয়েছে সেই ৰোধিচিত্তকে বলা হয় ‘ক’৷ এই ‘ক’–কে অর্থাৎ সৃষ্ট জগৎকে যিনি পালন করেন, সেবা করেন তিনিই ‘কাপালিক’ অর্থাৎ যিনি সৃষ্ট জগতের সকলের সেবা করেন) (৫) ‘ক’–এর আরেকটা অর্থ হ’ল জল৷ ‘ক’–এর দ্বারা ছাদিত তাই কচ্ছ অর্থাৎ যে জায়গাটার চার দিকে জল৷ ভারতবর্ষের গুজরাটে কচ্ছ নামে একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল রয়েছে৷
আমরা আনন্দমার্গে এইরকম সূত্রের ব্যবহার প্রায়ই করে থাকি৷ যেমন Education, Relief And Welfare Section–আমাদের আনন্দমার্গের একটা শাখা৷ আমরা সংক্ষেপে বলি ড্রত্মট্ট্বত্র. কম কথায় কাজ সারা হ’ল৷ সেইরকম প্রতিটি মানুষের একটা জীবনবেদ থাকবে৷ এখন জীবনবেদ সম্বন্ধে বলতে গেলে অনেকখানি বলতে হয়৷ অত বলাও মুস্কিল, আবার মনে রাখাও মুস্কিল৷ সেইজন্যে মানুষের জীবনধর্মের যে ৰীজ, জীবনবেদের যে ৰীজ, অনেকদিন আগেই আমি তা তৈরী করেছিলুম৷ মুখে মুখে দু’একজনের কাছে তা বলেও ছিলুম কিন্তু প্রকাশ্যে বলিনি৷ সেইটাই আজ বলব৷ সেটাও একটা সূত্রবৎ–ভবিশ্চ ঃ ভ, বি, স, চ৷
মানুষের সব ক্ষেত্রেই এই চারটা অক্ষর স্মরণ রাখা উচিত৷ তাহলে তার প্রগতি হবেই৷ এটা হ’ল গুপ্ত ৰীজমন্ত্র–গুপ্ত গায়ত্রীও বলতে পার৷ এই যে ‘ভ’, এই ‘ভ’ মানে ভগবান এখানে ‘ভগবান’ শব্দটা ব্যবহার করছি পরমপুরুষ অর্থে৷ পরমপুরুষও ভগবান৷ ‘ভগ’ শব্দের দ্বারা কতকগুলো বিশিষ্ট গুণ ৰোঝায়৷ যেমন, আমরা বলি ভগবান ৰুদ্ধ, ভগবান শ্রীচৈতন্য, ভগবান শঙ্করাচার্য ইত্যাদি৷ আবার তেমনই পরমপুরুষও ভগবান৷ এখানে আমার উদ্দেশ্য পরমপুরুষের ভাবটাই রাখা৷ সংস্কৃত ভাষায় লৌকিক অর্থে ‘ভগ’ মানে ভাগ্য৷ যেমন, প্রাচীন সংস্কৃতে একটা শব্দ ছিল ‘ভগধর’৷ ‘ভগধর’ মানে ভাগ্যধর বা ভাগ্যবান৷ এই শব্দটাই আবার পুরাতন ফারসী ভাষায় হয়ে গেল ‘বহধর’ সেইটাই আবার পাঞ্জাবী ভাষায় হয়ে গেল ‘বহদর’, উর্দুতে হ’ল ‘বাহাদুর’, হিন্দীতেও ‘বাহাদুর’, আবার ৰাংলাতেও ‘বাহাদুর’৷ এখানে পরমপুরুষ যে অর্থে ভগবান সে ক্ষেত্রে ‘ভগ’ শব্দটার অর্থ হ’ল–
‘‘ঐশ্চর্যঞ্চ সমগ্রঞ্চ বীর্যশ্চ যশসঃ শ্রিয়ঃ৷
জ্ঞান–বৈরাগ্যঞ্চ যন্নাং ভগ ইতি স্মৃতম্৷৷’’
অণিমা, লগিমা, গরিমা, ঈশিত্ব, বশিত্ব, ইত্যাদি আট প্রকারের ঐশ্বর্য রয়েছে৷ অণিমা হ’ল নিজেকে খুবই ছোট করে কারও মনের ভেতর ঢুকে যাওয়া, তার মনের ভেতরকার সব কথা জেনে নেওয়া৷ লঘিমা মানে হালকা হয়ে মিশে যাওয়া ও সর্বত্র পরিব্যাপ্ত হওয়া আর কোথায় কী হচ্ছে দেখে নেওয়া৷ মহিমা মানে গুণের অপূর্ব অভিব্যক্তি ঘটিয়ে দেখিয়ে দেওয়া যে সব গুণই একটা বস্তুতে বা একটা আধারে থাকতে পারে৷ ঈশিত্ব মানে কখনও বা নিয়ন্ত্রণ করে, কখনও বা শাসন করে, ভয় দেখিয়ে, বকাঝকা করে বা ৰুঝিয়ে–সুঝিয়ে ভালবেসে কাজ আদায় করে নেওয়া৷ এই রকমের আটটা ঐশ্বর্য রয়েছে৷ এটা হ’ল এক নম্বর গুণ৷
তারপর দ্বিতীয় গুণ বীর্য৷ প্রবাদ আছে, লোকে ভালবাসে আবার কিন্তু ভয়ও পায়৷ এই জিনিসটা কেন হয়? ‘বিনু ভয় হোই ন পিরিতি’ বলে একটা কথা আছে হিন্দীতে৷ একটু ভয় না থাকলে ভালবাসা হয় না৷ যাকে ভালবাসব তার প্রতি একটু ভয় থাকা দরকার৷ (ক্রমশঃ)