ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর ত্রিপুরা জেলার পানিসাগর ব্লকের একটি গ্রাম চামটিলা৷ চামগাছের টিলা৷ প্রায় অর্দ্ধশতাব্দি বৎসর পূর্বে ১৯৬৬ সালে আমি এই অঞ্চলে এসেছিলাম৷ ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী শহর আগরতলা থেকে এখানে আসার রাস্তা তখন ছিল, কিন্তু যাতায়াতের জন্য বাস ইত্যাদি ছিল না৷ ছিল মালবাহী বড় বড় ট্রাক৷ এরূপ ট্রাকে চেপেই পাহাড়ময় রাস্তা পেরিয়ে এখানে এসেছিলাম৷ দেখলাম চারিদিক জঙ্গলে আচ্ছন্ন৷ মানুষের বাস ছিল অতিনগণ্য৷
১৯৫৯ সালে ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তথা বিশ্ববন্দিত দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার সবার হিত, সবার কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রচার করলেন প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব, Progressive Utilization Theory) সংক্ষেপে প্রাউট৷ তাঁর দৃপ্ত ঘোষনা---‘এই পৃথিবী সবার, সবাই এই পৃথিবীর৷ মানুষ পশুপাখী উদ্ভিদ সবাই এই পৃথিবীর৷ আস্তিত্বিক পরিচিতির সাথে সাথে বিকাশের সুযোগ থাকবে সবার জন্য৷ পৃথিবীর যাবতীয় সম্পদ সকলের সাধারণ সম্পদ ও সমাজের সকলেই এর নায্য অংশীদার৷ মহান দার্শনিকের শুভ সংকল্প---প্রাউটতত্বের ভিত্তিতে একটা আদর্শ সমাজ নির্মিত হবে---যেখানে সবার জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক কল্যাণ সুনিশ্চিত হবে৷ এই মহৎতত্ত্বকে বাস্তবায়িত করার জন্য মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার দিলেন প্রয়োগ ভৌমিক পরিকল্পনা---চক্রনেমী-মাষ্টার ইউনিট অর্থাৎ বহুমুখী সেবা প্রকল্প৷ এইরূপ মাষ্টার ইয়ূনিটে থাকবে শহরের শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্ম সংস্থান ও গ্রামের দুষণমুক্ত আকাশ-বায়ু- আলো-জল-মাটিতে উৎপাদিত শস্য,সব্জি,ফল, ফুল, দুগ্ধ ও বিশুদ্ধ পরিবেশ৷
শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তথা দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার প্রবর্ত্তিত প্রাউট তত্ত্বে আধারিত---মাষ্টার ইয়ূনিট অর্থাৎ বহুমুখী সেবা প্রকল্পের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে চামটিলার গ্রামবাসীগণের সহযোগে ১৯৮৮ সালে গড়ে উঠে চামটিলার মাষ্টার ইয়ূনিট বহুমুখী সেবাপ্রকল্প৷
এভাবেই শুরু হল জঙ্গলে মঙ্গলদীপ প্রজ্জ্বলনের মহৎ কর্মযজ্ঞ৷ বর্তমানে এই মঙ্গলযজ্ঞের কর্মাধ্যক্ষ হলেন আচার্য জগমিত্রানন্দ অবধূত৷ আচার্য জগমিত্রানন্দ অবধূতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক স্থাপিত হয় ১৯৮০ সালে৷ আমি তখন বারানসী প্রশিক্ষণ মঠের প্রশিক্ষণ সচিব৷ ২০/২৩ বছরের দৃপ্ত যুবক আমাকে তার মনের শুভ সংকল্পের কথা জানালেন৷ সমাজ সেবায় সন্ন্যাস গ্রহণ করে ধর্মগুরু শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী প্রদর্শিত আদর্শ রূপায়ণে জীবন উৎসর্গ করতে সংকল্পবদ্ধ৷ তার আশ্রমিক নাম জয়দেব ব্রহ্মচারী৷ সন্ন্যাস জীবনের সর্বাত্মক সংযম পালন, নিয়মিত ধ্যান সাধনার অনুশীলন, একই সঙ্গে দর্শন শাস্ত্রে জ্ঞান অর্জন করে যথা সময়ের ব্রাহ্মণ মঠের অধ্যায় সমাপ্ত করেন৷ কল্যাণময় গুরুদেব শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী তার কর্মে সন্তুষ্ট হয়ে ১৯৮২ সালে তাকে পূর্ণ সন্ন্যাসে দীক্ষিত করেন৷ তার নূতন নাম হয় আচার্য জগন্মিত্রানন্দ অবধূত৷
জগন্মিত্রানন্দ অবধূতকে জিজ্ঞাসা করলাম এই বহুমুখী সেবাপ্রকল্পে তোমার কী কী পরিকল্পনা৷ উত্তরে জগন্মিত্রানন্দজী বললেন---বার মাসের ফল, ফুল, সব্জি ও শস্য উৎপাদন৷ জৈব সার ব্যবহার করে উন্নতমানের ফল, সবজি শস্য উৎপাদন করে গ্রামবাসীদের আমাদের প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত করা৷ কৃষিপণ্য নির্ভরশীল ছোট ছোট কুটীর শিল্পের দ্বারা গ্রামবাসীদের আর্থিকমানকে সমৃদ্ধ করা৷ আমি জগন্মিত্রানন্দজীকে বললুম--- তোমাদের ফল, ফুল,সবজি এসব আমাকে দেখাও৷ সর্বক্ষণের সহায়ক ধর্মনগরের বিভাস সরকার ও কয়েকজন গ্রামবাসীকে সাথে নিয়ে প্রথমেই গেলুম আমবাগানে৷ জগন্মিত্রানন্দ বললেন---আমাদের আম্রকুঞ্জে ৫০ প্রজাতির বিভিন্ন দেশের আমের গাছ রয়েছে৷ আমি বিস্ময় প্রকাশ করলে গ্রামবাসীরা বললেন হ্যাঁ দাদা ৫০ প্রজাতির আম গাছ আমরাই লাগিয়েছি৷ একটা তালিকাও তৈরী করা রয়েছে৷ জগন্মিত্রানন্দজী বিভিন্ন প্রকারের গাছ দেখিয়ে বলে চলেছেন---আম ৩ প্রজাতির, কাঠাল ১৬ প্রজাতির, লিচু-৪ প্রজাতির, পেঁপে-৪ প্রঃ কলা---৬ প্রঃ, (বেল ৪ প্রঃ আতা-৪ প্রঃ সবেদা-৬ প্রঃ, পেয়ারা-৫ প্রঃ, তেঁতুল- ৪ প্রঃ আপেল-২ প্রঃ, চেরী-৩ প্রঃ, মোসাম্বী-৫ প্রঃ, বাতাবী-২, নেবু-৫ প্র কমলালেবু ষ্ট্রবেরী-২ ফ্যাসনফ্রুট-২ প্রঃ গ্রেটফ্রুট-১ শশা-৩ প্রঃ, ড্রাগন-৩ প্রজাতি৷ তারপর পুষ্পউদ্যান দেখতে গেলাম৷ সেখানে রয়েছে ৮ প্রজাতির গোলাপ ডালিয়া-২৫ প্রজাতির, চন্দ্রমল্লিকা-৪০ প্রঃ, অর্কিড-৫ প্রঃ গাঁদাফুল -১০ প্রঃ রজনীগন্ধা-২ প্রঃ, এডিনাম----৩০ প্রঃ কেকটাস -১০ প্রঃ বোগানডিলা ২০প্রঃ পিটুনিয়া প্রঃ তাছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন রংয়ের জবা, অপরাজিতা চাঁপা, টগর, জুঁই সহ অনেক সুগন্ধীফুল৷ রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির তুলসী৷ সবজি বাগানে দেখলাম বহুধরণের লাউ,কুমড়া, ঝিঙ্গা, পটল ওল,আলু,কচু,বরবটি,ঢ্যাঁরস, করলা, মূলা, গাজর, বীট, ফুটি ও বিভিন্ন প্রকারের শাক৷ ১৬১/২বিঘার জমির বিভিন্ন প্লটে বিভিন্ন শস্যও উৎপাদিত হচ্ছে৷
জগন্মিত্রাজী এরপর একটা লেক (জলাধার) এর কাছে নিয়ে গেলেন৷ দেখলাম সুদৃশ্য লেকের চারিদিকে রয়েছে বিভিন্ন ধরণের ঔষধীয় গাছ-গাছড়া, ফুল ফল গাছ নিমগাছ, চন্দন গাছ, আগর গাছ৷ জগন্মিত্রানন্দজী বললেন একটি বড় ধরণের চন্দন গাছের মূল্য হবে ২/৩ লাখটাকা আর আগর গাছের দাম হবে আরও বেশী৷ এই আগর গাছ থেকেই তৈরী হয় সুগন্ধী আতর৷ চন্দন ও আতারের চারা আমরা গ্রামবাসীদের ও দিয়েছি৷ চন্দন ও আগর গাছ এখানকার আর্থিক অবস্থার উন্নয়ণে বিশেষভাবে সহায়ক হবে৷ এখানকার উৎপাদিত ফল সবজি আমরা বাইরে এখনও বিক্রি করি না৷ অতিথি আপ্যায়নের পর সব্জি ফল ইত্যাদি গ্রামবাসীদের মধ্যেই বিলি করি৷ ওদের শ্রমেই আমাদের মাষ্টার ইয়ূনিটের উন্নতি ওদের নিয়েই আমাদের আনন্দ পরিবার৷ ওদের ছেলেমেয়েরা এখানে খাবার খায়, আমাদের স্কুলেই পড়াশুনা করে আমাদের স্কুলের পঠন, পাঠন, নিয়মশৃঙ্খলা, সঙ্গীত, নৃত্য, অঙ্কন খেলাধূলার জন্য বিশেষভাবে প্রশংসনীয়৷ এখানে হিন্দু, মুসলমান, খ্রীষ্টান, মনিপুরী, ত্রিপুরী, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ছেলেমেয়েরা পড়াশুনা করে৷ স্কুলে ১১জন শিক্ষিত ত্যাগব্রতী শিক্ষক শিক্ষাদান করেন৷ স্কুলটি সবার উৎসব আনন্দের প্রাণকেন্দ্র৷ এখানে জন্মদিন,অন্নপ্রাশন, বিবাহ, সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান,সামাজিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়৷ ত্রিপুরায় অনেক রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় প্রতিষ্টান রয়েছে৷ শাসনকার্যেরও বিভিন্ন কার্য্যালয়ও রয়েছে৷ বিভিন্নতা ভুলে সবাই এখানে আমাদের উৎসব অনুষ্ঠানে যোগদান করেন, দানও করেন৷ আমরা সম্প্রীতির প্রতীক স্বরূপ আমাদের ফুল, ফল, সবজি চারাগাছ উপহার দিই৷
বর্ত্তমান সমাজের সর্বত্রই অন্ধকারে মানুষ দিশেহারা, বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত৷ আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের এই বহুমুখী সেবা প্রকল্পের (মাষ্টার ইয়ূনিট) আলো ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে৷ আমাদের এই মঙ্গলদীপ সহস্রদীপে জগৎ সংসারকে আলোকিত করবে৷
- Log in to post comments