মহামতি কার্ল মার্ক্স বলেছেন---‘‘এযাবৎ দার্শনিকগণ বিশ্বসৃষ্টির নানান ব্যাখ্যা দিয়েছেন কিন্তু সময় এসেছে বিশ্বটাকে বদলানোর৷’’ (স্বকৃত বাংলা অনুবাদ) মিলিয়ন ডলারের এই উক্তিটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এতে সন্দেহের কোন অবকাশই নেই৷ যে হিংসা উন্মত্ত, দারিদ্র্যপীড়িত, অমানবীয়তায় পূর্ণ পৃথিবীতে আমরা বাস করছি, এমন পৃথিবী কোন মনীষিই কল্পনা করেন নি৷ তাই পৃথিবীর মানব সমাজের সার্বিক পরিবর্তন আশু প্রয়োজন৷ পৃথিবীটাকে বদলাবার জন্য মানুষের সমাজকে একটা লক্ষ্যের দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটে বিষয় অপরিহার্য৷ এক, একটা সর্বাত্মক আদর্শ বা দর্শন৷ দুই, সেই আদর্শ বা দর্শনের অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত নেতা ও কর্মী যাঁরা দর্শনটাকে বাস্তবায়িত করবেন৷ তিন এই আদর্শবান নেতা কর্মীদের একটি সুঘটিত সংঘটন৷
এবার একনজরে দেখে নেওয়া যাক যে, অতীতে কোন্ কোন্ আদর্শকে কেন্দ্র করে পৃথিবীকে বদলাবার চেষ্টা হয়েছে ও সেই চেষ্টার ফলাফল কী হয়েছে৷ এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সেই সব প্রচেষ্টা সফল বা ব্যর্থ যাই হোক না কেন, পৃথিবীর কোন ঘটনাই অকারণ বা উদ্দেশ্যহীন নয়, পরিবর্তনের প্রচেষ্টা তো নয়ই৷ বস্তুত প্রতিটি ঘটনার মধ্য দিয়েই সমাজ এগিয়ে চলেছে যদিও আজও সে লক্ষ্যবিন্দু থেকে বহুদূরে রয়েছে৷ লক্ষ্যবিন্দু কী সে সম্পর্কে সম্যক না হলে একটা সাধারণ থাকা আবশ্যক৷ মানবসমাজের চূড়ান্ত লক্ষ্য সম্পর্কে ঋষি অরবিন্দের বক্তব্যটি সঠিক বলে আমাদের বিশ্বাস তাই সেটি উল্লেখ করছি---’’ পশুর প্রাণের বীক্ষণাগারে প্রকৃতি যদি মানুষ গড়ে থাকে যুগযুগান্তের সাধনায়, তাহলে মানুষের প্রাণ-মনের বীক্ষণাগারে তার সচেতন সহযোগিতায় সে যে অতিমানব বা দেবতা গড়বার সাধনা করছে না, তাই-বা কে বলতে পারে? শুধু দেবতাই বা কেন, এও কি বলা যায় না যে মর্ত্য আধারে দিব্য-পুরুষকে মূর্ত করবার তপস্যাই তার চলছে এখানে?’’ (দিব্য-জীবন, শ্রীরবিন্দ, পৃঃ৪)
এই যে পশু থেকে মানুষ, মানুষ থেকে দেবতা, দেবতা থেকে দিব্যপুরুষে উত্তরণ এই মহত্ব অর্জনের ঈঙ্গিত কি প্রচ্ছন্নভাবে মার্ক্সবাদেও নিহিত হয়ে নেই? আর যদি তা না হয় তবে মার্ক্সবাদের চরম লক্ষ্য শ্রেণিহীন, রাষ্ট্রহীন সমাজ ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ এসবকী করে সম্ভব? সুতরাং একথাও স্বীকার করতেই হচ্ছে যে, কার্ল মাক্স চেয়েছিলেন--- মানুষ ও তার মানবীয় গুণাবলী উত্তরোত্তর প্রসার লাভ করুক৷ মানুষের এই উত্তরণ না ঘটলে মার্ক্সের কাঙ্ক্ষিত সমাজ তৈরি হতে পারে না৷ আর এখানেই মার্ক্সবাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা-মানুষকে মার্ক্সবাদে দীক্ষিত করার জন্য তৈরি করা হয়নি৷ অর্থাৎ মানুষের মন যতটা মহৎ যতটা বৃহৎ যতটা উদার হলে মার্ক্সবাদের লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ততটা হয়নি৷ বরং বলা ভাল যে মার্ক্সবাদে মানুষের মধ্যে অন্তর্নিহিত দেবত্বকে জাগাবার, তাকে অতিমানসের স্তরে উন্নীত করার কোন পদ্ধতিই নেই৷ মার্ক্স ধরেই নিয়েছিলেন যে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান অর্থাৎ ‘রুটি কাপড়া ঔর মোকান-এর ব্যবস্থা করে দিলেই সব হয়ে যাবে৷ মানুষকে তিনি উদর-উপস্থ জীব বলেই ধরে নিয়েছিলেন৷ মানুষ ও তার মনস্তত্ব সম্পর্কে তাঁর এই ভ্রান্ত ধারণাই মার্ক্সবাদের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ৷ তাই রবীন্দ্রনাথ যথার্থই বলেছেন---‘‘যেখানে মানুষ তৈরি নেই, মত তৈরি হয়েছে, সেখানকার উচ্চণ্ড দণ্ডনায়কদের আমি বিশ্বাস করি নে৷ প্রথম কারণ নিজের মত সম্বন্ধে আগে ভাগে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা সুবুদ্ধি নয়, সেটাকে কাজে খাটাতে খাটাতে তবে তার পরিচয় হয়৷’’ এজন্যই মার্ক্সবাদ দিকে দিকে তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়েছে৷
বিশ্বজয়ী বীর সন্ন্যাসী বিবেকানন্দও একদা বলেছিলেন যে, ‘একশোজন উপযুক্ত ছেলে পেলে তিনি পৃথিবীটা বদলে দিতে পারেন৷’ বাংলা তথা ভারতের মায়েরা সেদিন তাঁর ডাকে সাড়া দিতে পারেন নি৷ তাই আমরা বিবেকানন্দের কল্পনার সমাজ, বাস্তবের পৃথিবীতে দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি৷ যে দুঃখ নেতাজীকে ব্যথিত করেছিল৷ একই কারণে গান্ধীর রামরাজ্যের কল্পনাও কল্পনার রাজ্যেই থেকে গেছে৷
বর্তমান ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দল সমূহের কার্যকলাপ ওই রকম একটা সমাজ সংরচনার ক্ষেত্রে কতটা সম্ভাবনাময় সে বিষয়ে আলোচনা নিবন্ধের শেষ দিকে কিঞ্চিত করার চেষ্টা করছি৷
স্বাধীনতার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী কোন দূরদর্শিতা ছাড়াই ‘মিশ্র অর্থনীতি’ নামের এক ‘হাসজারু’ টাইপ অর্থব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ণ দেখেছিলেন, তার পরিণতি সকলেরই জানা৷ আসলে নিজের মহত্ত্ব প্রচারের জন্য এসব একধরণের বা বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক বিলাসিতা৷
বিশ্ব ১৯১৭ সনের দুঃস্বপ্ণকে পেছনে রেখে ঘুরে ফিরে আবারও পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থাতেই ফিরে এসেছে৷ গ্রামের দাদানদার থেকে করপোরেট বিশ্বের মহাজন, সবাই শোষণের নতুন নতুন কৌশল নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে৷ এখন তারা অধিক সচেতন তাই সঙ্গে এনেছে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন এনেসথেসিয়া অর্থাৎ সচেতন মানুষের জন্য অনুভূতিনাশক ঔষধ যা দিয়ে চিন্তাশীল জনগোষ্ঠীকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে৷ আর এক শ্রেণী এখনও স্বপ্ণ দেখছে ১৯১৭র পুনরাবৃত্তি ঘটবে৷ কারণ, ‘‘পৃথিবীর সব ভাববাদীদের মত ভারতের ভাববাদী বুদ্ধিজীবীদেরও মার্ক্সবাদ আকর্ষণ করে৷’’ (ধর্ম ও সমাজ, ডঃ সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, পৃঃ ১৮) এই বুদ্ধিজীবীগণ রোজা লুক্সেমবার্গ (১৮৭১-১৯১৯) এর মত বিশ্ববিখ্যাত মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকের যুক্তিকেও অস্বীকার করেন--- তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন---‘‘মার্ক্সবাদ সাময়িক সত্যতা দাবি করে, আগাগোড়া ডায়ালেকটিকের উপর স্থাপিত হওয়াতে, ও মত নিজের বিনাশের বীজ নিজের মধ্যেই বহন করে৷’’ (তদেব পৃঃ১৯) মার্ক্সবাদ সম্পর্কে লুক্সেমবার্গের ধারণাই ঠিক, কারণ মার্ক্সবাদ মূলত একটি এন্টিথিসিস আর এন্টিথিসিস কখনও চিরস্থায়ী হতে পারে না৷ তত্ত্বের যথার্থতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন---‘কাজে খাটাতে খাটাতে তত্ত্বের পরিচয় পাওয়া যায়৷ তখন মানুষ সে তত্ত্বকে বিশ্বাস করে, তার ওপর আস্থা রাখে৷ এই কথাটিকেই বিংশ শতাব্দীর মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন এভাবে---‘‘যেখানে সিদ্ধান্ত প্রয়োগভূমিকে অনুসরণ করে প্রথমে প্র্যাকটিক্যাল বা রূপায়ণের দিক---তারপর সিদ্ধান্ত বা থিওরি৷ --- আপেল মাটিতে পড়ার পর সিদ্ধান্ত তৈরী হল---সিদ্ধান্ত তৈরী হবার পর আপেল মাটিতে পড়ে নি৷’’ (অভিমত, প্রভাতরঞ্জন সরকার ষষ্ঠ খণ্ড পৃঃ-২৮)৷ তিনি তাঁর আর্থসামাজিক দর্শন প্রাউট-কেও প্রয়োগ ভৌমিক তত্ত্ব হিসেবেই বর্ণনা করেছেন৷ শুধুমাত্র তথাকথিত ভোট কেন্দ্রিক রাজনীতি নয়৷ তত্ত্বের অন্তর্নিহিত বিষয়বস্তুকে প্রয়োগের মধ্য দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে করতে এগিয়ে চলা৷ রবীন্দ্রনাথ যথার্থ বলেছেন ‘কাজে খাটাবার’ উদাহরণ স্থাপন করে এগিয়ে গেলে ব্যর্থ হওয়ার সম্ভাবনাই থাকবে না৷ শুধু তত্ত্ব আউরে সমাজ পরিবর্তন অসম্ভব৷
নেতার গুরুত্ব অনুধাবন করে তাঁদের চরিত্র গঠন সম্পর্কেও শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার কিছু নির্দিষ্ট নিয়মাবলী বেঁধে দিয়েছেন৷ যে সমস্ত নিয়মাবলী পালনের ফলে নেতার চরিত্র হবে ইস্পাতের মত দৃঢ়, যা সাধারণ মানুষের কাঙ্ক্ষিত একজন নেতার প্রকৃত সম্পদ৷ একথা আজ সর্বজন বিদিত যে, নেতার চারিত্রিক দৃঢ়তার অভাব আজকের সমস্ত রাজনৈতিক কেলেঙ্কারির মূলে৷ ত্রুটিমুক্ত উপযুক্ত তত্ত্ব, কর্মী বা নেতা ও সংঘটন এই তিনের যথাযথ সমন্বয় সংসাধিত হয়নি বলেই মনীষিদের কল্পনার সমাজ এযাবৎ সংরচিত হতে পারে নি৷
এ প্রসঙ্গে ভারতীয় রাজনৈতিক দল সমূহের আদর্শ ও কার্যধারার ওপর আলোকপাত করাও জরুরি৷ ভারতবর্ষের রাজনীতিতে অসংখ্য আঞ্চলিক দল রয়েছে যাদের কর্মপদ্ধতি কতকটা কর্র্পেরেট বিশ্বের কোম্পানির মত৷ এগুলোর সাময়িক কিছু বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে৷ উদাহরণ হিসেবে অসমে কংগ্রেস সরকারের ব্যর্থতার জন্য জন্ম হয়েছিল আঞ্চলিক দল অসম গণ পরিষদ৷ পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের অপশাসনের পরিপ্রেক্ষিতে জন্ম নিয়েছিল তৃণমূল৷ এছাড়া সমাজের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য কোন মহৎ আদর্শ এইসব আঞ্চলিক দলের সামনে কোনদিনই ছিল না, থাকে না৷
ভারতবর্ষের শাসনক্ষমতাসংক্ষিপ্ত কিছু সময় বাদ দিলে বরাবরই কংগ্রেসের হাতেই ছিল৷ এই দল জন্মলগ্ণ থেকেই পুঁজিবাদী চিন্তাধারাকে আশ্রয় করেই চলে এসেছে৷ পুঁজিবাদের মৌলিক সমস্যা এই যে, এই ব্যবস্থায় সম্পদ অস্বাভাবিকভাবে কেন্দ্রীভূত হতে থাকে৷ এক কথায় ধনী-দরিদ্রের মধ্যেকার দূরত্ব দ্রুত বাড়তে থাকে৷ বিজেপির অর্থনৈতিক চিন্তাও এই ধারারই৷ তবুও ক্ষমতার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবীই ছিল৷ আর এই মুহূর্তে জনপ্রিয়তার নিরিখে সর্বভারতীয় স্তরে কোনদলই বিজেপির ধারে কাছেও নেই৷ বস্তুত বিজেপি হচ্ছে ভারতে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের প্রতি চলা হাজার বছরের বঞ্চনার প্রতিফলন ও জনগণের কাছে আগামী দিনে ঘটতে যাওয়া অপ্রতিরোধ্য ডেমোগ্রাফিক বিপর্যয় থেকে পরিত্রাণের প্রতিভূ স্বরূপ৷ বছর আগে এক বর্ষাস্নাত শ্রাবণে কালিদাস নাগ-কে তাঁর গভীর পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে লিখেছিলেন---‘‘পৃথিবীতে দুটি সম্প্রদায় আছে অন্য সমস্ত মতের সঙ্গে যাদের বিরুদ্ধতা অতূ্যগ্র সে হচ্ছে খৃষ্টান আর মুসলমান ধর্ম৷ তারা নিজের ধর্মকে সংহার করতে উদ্যত৷ এইজন্যে তাদের ধর্ম গ্রহণ করা ছাড়া তাদের সঙ্গে মেলবার অন্য কোন উপায় নেই৷’’ (কালান্তর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃঃ ৩১২)৷
এই সমস্ত বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করে মানব সমাজকে অরবিন্দ, বিবেকানন্দ, শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার, আরও অনেক মনীষির নির্দেশিত লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে বৌদ্ধিক সমাজকে প্রচলিত পুঁজিবাদ ও পরিত্যক্ত মার্ক্সবাদের বিকল্প খুঁজতেই হবে৷ আর সেই বিকল্প হিসেবে এই মুহূর্তে প্রাউট এর কোন বিকল্প নেই৷
- Log in to post comments