কেন বাঙালী জাতির ওপর হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের আঘাত

লেখক
এইচ এন মাহাতো

বাঙালী জাতিসত্ত্বাকে কেন বার বার প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ পরবর্তীতে হিন্দী সাম্রাজ্যবাদ আঘাতে ক্ষত -বিক্ষত করে চলেছে৷ এর কারণগুলো কখনো  ভেবে দেখেছেন কি? আজকের আলোচনায় কয়েকটি বিষয় তুলে ধরার চেষ্টা করছি৷

প্রথমতঃ ভারতের আধ্যাত্মিকতাকে দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়৷ (১) অন্তর্মুখী, (২) বহির্মুখী৷

এলাহাবাদের পশ্চিম প্রান্ত থেকে গান্ধার রাজ্য যাকে  আফগানিস্তান বলা হয়৷ এই অঞ্চলের আধ্যাত্মিকতা বহির্মুখী হওয়ার ফলে এখানে যাগ-যজ্ঞের ওপর  নির্ভরশীল৷ এর ফল স্বরূপ এখানের মানুষ মনপ্রধান  না হয়ে শরীর প্রধান হয়৷ ফলাফলে আমরা দেখতে পাই এই অঞ্চলের মানুষের  প্রবণতা অনেকটা যাযাবরের মত, যেখানে এরা যাবে সেখানেই এরা রাজতন্ত্রের মত চলাফেরা করে বলপূর্বক অন্যের জমি ভোগ দখল করবে ও অন্যকে ক্রীতদাস রূপে ব্যবহার করবে৷

এলাহাবাদের পূর্বপার থেকে মায়ানমার পর্যন্ত অন্তর্মুখী যোগ ও তন্ত্রসাধনায়  নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চায়৷ যেমন মগধ,অঙ্গদেশ, মিথিলা সহ বাঙালীস্তানে এর প্রভাব পড়েছে৷ বিশেষ করে বাঙলার মানুষের মধ্যে রয়েছে কতগুলো গুণ যেমন--- এদের মধ্যে আছে প্রচণ্ড  সহনশীলতা, উদার মানসিকতা, সাহসিকতা, তেজস্বীকতা৷ এর জন্যে এরা অকাতরে মৃত্যুকে বরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না৷ নৈতিকতা ও মানবিকতায় এরা সুদৃঢ়, কঠোর পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী৷ অপরকে আপন  করতে ভালবাসে, অতিথিকে অন্নপূর্ণার মত খাওয়াতে ভালবাসে৷ এরা পছন্দ করে অন্যকে অন্নদান, শিক্ষাদান, বাসস্থান, বস্ত্রের ও চিকিৎসা সহ আধ্যাত্মিক উন্নতিতে নিজেদের উজাড় করে দিত৷

দ্বিতীয়তঃ এই বাঙলায় ছয়টি জাত বাঙালী নিয়ে বাঙালীস্তান তথা ভারতকে সমৃদ্ধ  করেছে৷ যেমন নদীমাতৃক দেশ হওয়ার  জন্যে নদীকে কাজে ব্যবহার করে তারাই ‘কৈবর্ত্ত বা কেওট’ (এখানে ক মানে জল, জলকে যারা মানব সমাজকে ব্যবহার করতে শিখিয়েছে সেই অর্থে কেওট’ বা কৈবর্ত্ত), শৌর্য-বীর্যের ও সেবার প্রতীক ‘নমশূদ্র’, মঙ্গোলীয় রক্তে-ক্ষাত্রবল সমৃদ্ধ ‘রাজবংশী’, মননশীলতায় সামাজিক প্রয়োজনে পাহাড়ী অঞ্চলে কৃষিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে, শেষ জাত বাঙালী হ’ল যারা সারা পৃথিবীতে প্রগতির  পথ দেখিয়েছেন যেমন--- কৃষিকাজে ‘হাল’ ব্যবহার , ‘আগুন’-এর আবিষ্কার, ‘চাকা’ আবিষ্কার, নানাবিধ ‘গহনাদি’র অস্ত্র ইত্যাদি ইত্যাদি  আবিষ্কার করার ফলে এদের নাম হয়েছে মহত্তন বা মাহাতো৷

তৃতীয়তঃ বাঙালীর  রক্তে  রয়েছে বিমিশ্রিত সভ্যতার উপকরণ যেমন গঙ্গা নদীর ধারায় রয়েছে আর্য সভ্যতা, ব্রহ্মপুত্রের ধারায় রয়েছে মঙ্গোলীয় সভ্যতা, আবার রাঢ়ের নদ-নদী দামোদর, কংসাবতী, ময়ূরাক্ষী প্রভৃতির সভ্যতা বা সংস্কৃতি এসে মিশেছে বাঙালীস্তানের  ‘ব’-দ্বীপে৷ যার ফসস্বরূপ এখানে আমরা দেখতে পাই মেধা, সৃজনশীলতা, শিল্প-সাহিত্য-কলা৷ উদার মানসিকতার জন্য বাংলা তথা ভারত ও বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছে এই বাঙালী জনগোষ্ঠী৷

চতুর্থতঃ ইউ.এন.ও সম্প্রতি বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর মধ্যে মধুরতম ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে৷ কেননা বাংলা ব্যাকরণ, ধবনি বিজ্ঞান, শব্দভাণ্ডার, বানান পদ্ধতি, প্রতিশব্দ, ভাষার মাধুর্যতা (যেমন--- টুকটুকে লাল,  ধবধবে  সাদা ইত্যাদি) ও ভাষার অলঙ্করণ ইত্যাদি বাংলা বিশ্বের মধুরতম ভাষা স্বীকৃতি লাভ করেছে৷ বাংলার অক্ষর বিজ্ঞানকে অতীতে সমৃদ্ধ  করেছে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও ভাষাবিদ শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার৷ সঙ্গীত গুরু শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের যুগান্তকারী প্রভাত সঙ্গীতের  আলোকে  বলেছেন---

‘‘মধুর চেয়ে আরও মধুর

আমার বাংলা ভাষা

আমার প্রাণের ভাষা৷.....’’

পঞ্চমত ঃ বিমিশ্রিত সংস্কৃতি হওয়ার ফলে বাঙালীস্তানে জন্ম নিয়েছে দিক্‌পাল সব  মনীষা --- যারা হলেন পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক মহর্ষি কপিল মুনি, পতঞ্জলী দর্শনের প্রণেতা, অনুপরমানু  আবিষ্কারক কনাদ মুনি, জ্যোতিষবিদ মহীয়সী খনা,মহাকবি কালিদাস, বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের পথিকৃৎ ও সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করেছিলেন রাজা রামমোহন, সাহিত্য সম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, কথাশিল্পী সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র , বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত,জাগরণী সঙ্গীতের প্রণেতা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম, অমৃতাক্ষর ছন্দের জাদুকর মাইকেল মধুসূদন দত্ত, শিশু সাহিত্যিক উপেন্দ্রকিশোররায়চৌধ্, সুকুমার রায় ও লীলা রায় আশাপূর্র্ণ দেবী, মহাশ্বেতা দেবী সহ আরও অনেক  মনীষী জন্ম নিয়েছে৷ বিজ্ঞানের উদ্ভাবনে ভারতের মধ্যে বাঙলাই সবের্বাচ্চ স্থান নিয়েছে৷ বিশেষ করে  বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু মেঘনাথ সাহা, জগদীশ চন্দ্র বোস ও  আরো অনেকে৷ নোবেল জয়ীতে ভারতকে উচ্চস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছে মাননীয় রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুর, অমর্ত সেন, মাদার টেরেসা, মহম্মদ ইউনিস, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এছাড়াও অস্কার পেয়েছেন সত্যজিৎ রায়৷ শিল্প  ও চারুকলায়  অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, যামিনী রায়, নন্দদুলাল বসু , উদয় শঙ্কর, মহানায়ক উত্তম কুমার ও আরো অনেকে৷ ভারতের স্বাধীনতার বিপ্লবে ব্রিটিশকে ভারত ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল যাঁরা--- তাঁরা হলেন প্রথম শহীদ ক্ষুদিরাম বোস, প্রফুল্ল চাকী থেকে শুরু করে বিনয়-বাদল-দীনেশ, বাঘা যতীন, মাষ্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতা, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বোস সহ আরো অনেকে যাঁদের তালিকা এই অল্প পরিসরে লেখা সম্ভব নয়৷

বাঙলা ও বাঙালীর এত অবদানের পরেও কতিপয় অর্থলোভী, সংকীর্ণমনা কাপুরুষ, ধান্দাবাজ মীরজাফরের জন্য বাঙালীস্তানের সুজলা, সুফলা ‘মা’কে আজ  ক্ষত-বিক্ষত করে বাঙলাকে হাতে ও ভাতে মারার পরিকল্পনার ফলে বাঙলার শিল্পাঞ্চল কেটে বিহারকে সমৃদ্ধ করেছে৷ আজ রাজনৈতিকভাবে যাহা ঝাড়খণ্ড রাজ্যে কিছুটা বিহারে রয়েছে, বাঙলার কৃষি অঞ্চল কেটে (তৎকালীন আমলে ) রঙপুর জেলার অংশ গোয়ালপাড়া সাব ডিভিশনকে (আজ যাহা চারটি জেলা), শ্রীহট্ট জেলার  সমতল ও হিল কাছাড়কে, গাঢ়ো ও জয়ন্তীয়া পাহাড় কেটে, নওগাঁ ও বরপেটার বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অসম প্রদেশকে দেওয়া হয়েছিল৷ তৎকালীন আমলের ভারতবর্ষের নেতৃবর্গ বলেছিল বাঙলার যে অংশ অসম প্রদেশে থাকবে সেই অঞ্চলের বাঙালীদের ভাষা সহ বাঙালী সংস্কৃতির পূর্ণ মর্যাদা দেওয়া হবে৷ অসম প্রদেশের অতীতের ইতিহাস বলছে এই অঞ্চলটি বাঙালীস্তানের অংশ ও এখানে অতীত থেকেই বাঙালীদের জনসংখ্যা বেশী ছিল৷ আজ হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের  তথাকথিত  নেতৃবর্গ  সহ অসমের উগ্রবাদীদের দ্বারা  বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করার ষড়যন্ত্র  চলছে৷ আজ আমরা দেখছি গত সত্তর দশক থেকেই অসমে বাঙালী হিন্দু ও মুসলমানের রক্তে ব্রহ্মপুত্রের জল লালে লাল হচ্ছে৷  প্রত্যেকেই বাঙালী বিদ্বেষী নানা প্রকার কালো আইন তৈরী  করে বাঙালীকে ভারতের মাটি থেকে উৎখাত করাও রাষ্ট্রহীন করা চেষ্টা করে চলেছে৷ এখন আবার নূতন করে বলছে অসমীয়ারাই অসমের ভূমিপুত্র৷ বাঙালীরা বহিরাগত ও অনাকাঙ্খিত৷ অসম কেন বলব, ত্রিপুরার বাঙালীরা ভুমিপুত্র হওয়ার পরেও তাদের বিরুদ্ধে সেই হিন্দী  সাম্রাজ্যবাদের নেতৃবর্গ একটার পর একটা আইন তৈরী করে বাঙালীকে উৎখাত করার চেষ্টা করে চলেছে৷ সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চল সহ সমগ্র ভারতের বাঙালীদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় সরকারের একটাই টার্গেট ভারত থেকে বাঙালীকে রাষ্ট্রহীন করা৷

কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে বাঙালীর অস্তিত্বকে বিলোপ করা মানেই হিন্দী সাম্রাজ্যবাদের শেকড়কে শক্তিশালী করা৷ এর পরিণতি সারা ভারতের বৈপ্লবিক চেতনাকে শেষ করে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক তৎসহ আধ্যাত্মিক শোষণকে প্রতিষ্ঠা করা৷ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ভালভাবেই জানে বাঙালী চেতনাই ঊণবিংশ শতাব্দীতে নবজাগরণের দীপ জ্বালিয়েছিল৷ সেই চেতনাই ব্রিটিশ বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামে প্রেরণা জুগিয়েছিল৷ তাই দেশী পুঁজিপতি ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আজ বাঙালীকে নিশ্চিহ্ণ করার খেলায় মেতেছে৷ কিন্তু তারা হয়তো জানে না, মহান দার্শনিক ঋষি শ্রী প্রভাতরঞ্জন প্রবর্ত্তিত প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব ভিত্তিক সমাজ আন্দোলন এই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন ঘটাবেই ও শোষণমুক্ত মানব সমাজ গঠন করবে৷ বাঙলাই হবে সেই মহা সংগ্রামের অগ্রপথিক৷