সংসদে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেন্দ্র পুঁজিপতিদের স্বার্থে কর্ষক (কৃষক) বিরোধী কৃষিবিল পাশ করিয়ে আইনে পরিণত করেছে৷ তার প্রতিবাদে সারা দেশ আন্দোলনে উত্তাল৷ হরিয়ানা, পঞ্জাব ও উত্তরপ্রদেশের চাষীরা দিল্লি অবরোধ করে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে৷ ৮ই ডিসেম্বর কেন্দ্রের কৃষি আইনের প্রতিবাদে ভারত বন্ধ পালিত হ’ল
কিন্তু মোদি সরকার কর্ষকদের দাবী মানতে নারাজ৷ মোদিজী বলেই চলেছেন, তাঁরা চাষীদের শৃঙ্খলমুক্তির জন্যেই এই আইন পাশ করিয়েছে৷ কী আছে এই আইনে? এই আইনের একটি দিক হ’ল---অত্যাবশ্যক পণ্য আইন সংশোধন৷
এই আইনে চাল, ডাল,গম, ভোজ্যতেল, তৈলবীজ, পেঁয়াজ প্রভৃতি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুতের ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে৷ কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়োজনে কিছু বিধি নিষেধ জারী করতে পারে৷ কিন্তু এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের এক্তিয়ার থাকবে না৷ অথচ, এটা বুঝতে কষ্ট হয় না এই সব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুত করার অনুমতি পেলে পুঁজিপতিরা এই সমস্ত দ্রব্য ইচ্ছেমত মজুত করে বাজারে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করবে৷ ফলে অবধারিতভাবে এগুলির দাম বাড়তে থাকবে৷ জনসাধারণের দুুর্দশা বাড়বে, আর পুঁজিপতিরা দুহাত ভরে মুনাফা লুটবে৷
এই আইনের আর একটি অংশে আছে, কৃষিপণ্যের ব্যবসায়ী রফতানীকারী ও খাদ্য-প্রক্রিয়াকরণ সংস্থাগুলি চুক্তির ভিত্তিতে চাষীদের দ্বারা চাষ করিয়ে নিয়ে সরাসরি চাষীদের কাছ থেকে ফসল কিনে নিতে পারবে৷ কৃষিপণ্যের বাজার কমিটির নিয়ন্ত্রণে থাকা মণ্ডিতে চাষীদের উৎপাদিত দ্রব্য বিক্রি করবার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না৷
দেশের গরীব চাষীদের দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে তাদের আগে টাকা দিয়ে চুক্তি করে তাদের পছন্দমত ফসল চাষ করাবে৷ পুঁজিপতিরা মুনাফার দিকে লক্ষ্য রেখে যে ফসল ফলালে তাদের বেশি মুনাফা হবে সেই ফসলই ফলাবে৷ জনসাধারণের প্রয়োজনের দিকে তাকিয়ে তারা ফসল ফলাবে না৷ প্রয়োজনে অধিক মুনাফার লোভে স্থানীয় জনসাধারণের প্রয়োজন উপেক্ষা করে বিদেশে রফতানীর জন্যে প্রয়োজনীয় ফসল ফলাবে৷ এর ফলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে৷
চাষীরা পুঁজিপতিদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে তাদের টাকার কাছে আত্মবিক্রয় করতে বাধ্য হবে৷ ব্রিটিশ আমলে সাহেবরা এইভাবে এ দেশের চাষীদের সঙ্গে নীলচাষের চুক্তি করিয়ে চাষীদের ওপর কীভাবে শোষণ চালাতো দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণে ভয়ঙ্কর চিত্র লিপিবদ্ধ আছে৷ সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হতে চলেছে৷ কেবল পরিবর্তন হ’ল বিদেশী সাহেবদের জায়গা দখল করবে দেশী পুঁজিপতিরা৷
আইনের তৃতীয় অংশে কর্ষকদের সুরক্ষা ও ফসলের মূল্য সুনিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি রয়েছে৷ বলাবাহুল্য, স্বাধীনতার পর থেকে সরকার এমনি কতই না প্রতিশ্রুতির অমৃতবাণী শুনিয়েছে৷ কিন্তু চাষীদের দুঃখ হয়নি৷
তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশবাসীর অন্নদাতা এই চাষীরা ১২ মিনিট ৩৭ সেকেন্ডে ১জন করে’ আত্মহত্যা করছে ঋণের দায়ে৷ এই ট্র্যাডিসন সমানে চলছে৷ দেশের প্রায় ৬৫ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী৷ তাদের স্বার্থ দেখার কেউ নেই৷ অথচ তাদের টুপি পরিয়ে তাদের নানান্ মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন৷ গরীব চাষীদের প্রতি অবহেলা বঞ্চনা ও শোষণ সমানে চলেছে৷
এইভাবে মুনাফাখোর মধ্যসত্ত্বভোগী, ব্যবসায়ী, পুঁজিপতিদের হাতে চাষীদের ভাগ্যকে সঁপে দিয়ে কোনোকালে কোনোভাবে কৃষি বা কর্ষকদের উন্নতি করা যাবে না৷
প্রাউট দর্শনের প্রবক্তা কৃষি কর্ষক তথা সমগ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক শোষণমুক্তির নবদিগন্তের সন্ধান দিয়েছেন৷ এ পথ অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণের পথ৷ অর্থনৈতিক ক্ষমতাকে মুষ্টিমেয় ব্যবসায়ী বা পুঁজিপতিদের হাতে কেন্দ্রীভূত হতে না দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে বন্টিত করতে হবে৷ যেমন,চাষীদের দুঃখ দুর্দশার প্রথম কথা হল চাষীরা তাদের ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছে না৷ ফসল উৎপাদন করতে তাদের যা খরচ হচ্ছে, তার চেয়ে কম দামেই তাদের ফসল বিক্রি করতে হচ্ছে৷ ফলে তাদের গরীবী যাচ্ছে না৷
তাই প্রাউট দর্শনে বলা হচ্ছে, ‘‘কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দিতে হবে৷’’ যেভাবে শিল্পদ্রব্যের মূল্য নির্ধারিত হয় সেভাবে কৃষিদ্রব্যেরও মূল্য নির্ধারিত হবে, কিন্তু তা হয় না৷ প্রাউটে বলা হয়েছে, ‘‘কৃষিপণ্যের দাম স্থিরীকৃত হবে যুক্তিসঙ্গতভাবে ও নিম্নলিখিত বিষয়গুলির ভিত্তিতে শ্রমের মজুরী, কাঁচামালের খরচ, পরিবহন ও ষ্টেরেজের খরচ, ক্ষয়ক্ষতি (depreciation), প্রতিপূরক sinking) ও অন্যান্য৷ এর অতিরিক্ত এই দামের মধ্যে উৎপাদন ব্যয়ের শতকরা ১৫ শতাংশ মুনাফা হিসেবে ধরতে হবে৷’’
দ্বিতীয় কথা, কৃষি নির্ভর করে উপযুক্ত জলসেচের ওপর৷ তাই সারা বছর কৃষিজমিতে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে৷ না, স্যালোর সাহায্যে মাটির নীচের জল কৃষির প্রয়োজনে যথেচ্ছভাবে তুলে নিলে অদূর ভবিষ্যতে পানীয় জলের ভয়ানক সংকট দেখা দেবে৷ বর্ষার জলকে আধুনিক সেচব্যবস্থার সাহায্যে ধরে রেখে সারা বৎসর চাষের জন্যে সরবরাহ করতে হবে৷ পুঁজিপতিদের স্বার্থে এক এক করে মেগাসিটি, রাস্তাঘাটের অত্যুন্নতি প্রভৃতি পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, অথচ দেশের ৬৫ শতাংশ চাষীদের জন্যে সেচের ব্যবস্থা উন্নতি করা হচ্ছে না৷ এই হচ্ছে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য৷
কৃষি ও কর্ষকদের উন্নতি করতে গেলে তথা গ্রামপ্রধান ভারতবর্ষে গ্রামোন্নয়ণ করতে গেলে ধাপে ধাপে সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিব্যবস্থা পরিচালনার ব্যবস্থা করতেই হবে৷ অথচ কোনো সরকার সেদিকটার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন না৷ সমবায় ছাড়া কৃষি ও কর্ষকদের উন্নতির অন্য কোনো স্থায়ী রাস্তা নেই৷ কেবল উৎপাদনই নয়, কৃষিজ দ্রব্যের বিক্রয়ের জন্যেও ব্যবসায়ীদের ওপর নির্ভর না করে উপভোক্তা,সমবায়ের ওপরেই নির্ভর করতে হবে৷ কৃষিতে উৎপাদিত ফসল উৎপাদক সমবায় থেকে উপভোক্তা সমবায়ের মাধ্যমে যাতে উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছে তারই ব্যবস্থা করতে হবে৷ বলা বাহুল্য, কৃষি, শিল্পে ও বাণিজ্য-যতদূর সম্ভব সমবায়ের মাধ্যমেই পরিচালনা করতে হবে৷ জনসাধারণের শোষণমুক্তির জন্যে এটা অত্যাবশ্যক৷
- Log in to post comments