ক্ষুধা নিয়ে রাজনীতি

লেখক
আচার্য সর্বাত্মানন্দ অবধূত

খবরে প্রকাশ যে প্রধান খাদ্যশস্য, যেমন ধান,গম, ডাল,তৈলবীজ ইত্যাদির মূল্য গত পাঁচবছরে ক্রমাগত কমে যাচ্ছে তুলনায় ঘাসের দাম, যে ঘাস পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তার দাম বেড়েই চলেছে৷ দেশে ছড়িয়ে পড়া কর্ষক (কৃষক) অসন্তোষ  ও  তার জেরে কর্ষক আন্দোলনের এটাই মূল কারণ৷ ঋণশোধ না করতে পারা আর অভাবে অনটনে জেরবার হয়ে  অনেক চাষীভাই আত্মহত্যা করেছেন ও করছেন৷ মধ্যপ্রদেশে, যেখানে সাম্প্রতিক কর্ষক আন্দোলনের  সূত্রপাত, সরকার চাষীদের নেওয়া কৃষিঋণ মকুব করায় সেখানে এই আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত  হয়েছে  বটে, কিন্তু সমগ্র দেশে এই আগুন ধিকি ধিকি জ্বলছে৷ কেননা মূল সমস্যার অর্র্থৎ খাদ্যশস্যের দাম ক্রমাগত কমে চলা, তার তো কোন সুরাহা হচ্ছে না, হবেও না, আর এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান করার কোন সদিচ্ছা বর্তমান সরকারের নেই (পূর্ববর্তী কোন সরকারেরও ছিল না) : এর পিছনে আছে একটি বড় রাজনীতি , যা শুধু এখানে নয়,  দুনিয়াজুড়ে চলছে৷

আচ্ছা, অতি সাধারণ জিনিস ঘাস, তার দাম কেন বেড়ে চলছে? অর্থনীতির যে কোনো ছাত্র উত্তরে বলবে, পশুখাদ্য হিসেবে ঘাসের চাহিদা নিশ্চয়ই বেড়েছে ৷ চাহিদা কেন বেড়েছে? এর উত্তর সোজা৷ নিশ্চয়ই পশু খামারের সংখ্যা বেড়েছে অথবা কোন কারণে পশুপালনের জন্যে পশুর সংখ্যা অনেক বেড়েছে৷ এখন, পশুখামারের সংখ্যা বাড়া বা পশুর সংখ্যা বাড়া, এর কারণ কী? এর উত্তরটা কিন্তু অত সহজ নয়৷ আর এখানেই লুকিয়ে আছে সমস্ত রহস্য৷

গোরু দুধ দেয়, মোষও দুধ দেয় ও দেয় অনেক বেশী৷ ছাগলও দুধ দেয়, কিন্তু পরিমাণে অনেক কম৷ সেই অর্থে অধিকাংশ গবাদি পশুই দুধ দেয়৷ এই প্রসঙ্গে বলি, বেছে বেছে গোরুকেই কেন গো-রক্ষা বা আইন করে সংরক্ষণের আওতায় আনা হ’ল তা আমার মোটা মাথায় বোধগম্য হয় না৷ অবশ্য সংরক্ষণের আওতায় মোষকেও হয়তো আনা হয়েছে৷  কিন্তু কেন? গোরু তো কোন endangered animal  বা বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী নয়৷ হয় তো এর পিছনে আছে অন্য কোন রাজনীতি৷ (আচ্ছা, কেউ কি কখনো দেখেছে বা শুণেছে যে মোষ হত্যার জন্য কাউকে পিটিয়ে মারা হয়েছে?) যাইহোক, সেটা আমাদের বিচার্য বিষয় নয়৷ আমাদের বিচার্য বিষয় এর থেকে অনেক বড় আর একটা রাজনীতি৷ আগেই বলা হয়েছে যে প্রায়  সব গবাদি পশুই দুধ দেয় কিন্তু তার থেকেও বড় ব্যাপার সব গবাদি পশুই মানুষের প্রিয় খাদ্য৷ এ ব্যাপারে আকারে যে আকারে বৃহৎ , তার মাংসের চাহিদা তত বেশী৷ আর পরিসংখ্যান বলছে, সারা পৃথিবীতে মাংসাহারীদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে৷ আর মাংসাহারের পরিমাণ যত বাড়বে , মাংস ব্যবসায়ীদের তত পোয়াবারো, তাদের তত লক্ষ্মী লাভ৷ যেখানে বেশী মুনাফা তথা অর্থলাভের গন্ধ, সেখানেই বড় বড় পঁুজিপতিদের ঝাঁপিয়ে পড়া বিশাল বিনিয়োগ করা ও সামনে থেকে বা পিছনে থেকে কলকাঠি নাড়া৷ এই যে চুটিয়ে ব্যবসা করার নীতি, যার দুনিয়া-জোড়াChain  বা শৃঙ্খলা আছে, তাতে একে বারে নীচের স্তরের থাকা খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী চাষীরা সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বা হতে থাকবে৷ ফলতঃ অসহায় চাষীরা  অর্থাভাবে অথবা ক্রয়ক্ষমতার অভাবে না খেয়ে মরতে থাকবে৷ এটাই হচ্ছে আজকের যুগে ক্ষুধা নিয়ে রাজনীতি৷

এ ব্যাপারে কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য সামনে রাখছি৷

প্রথমতঃ হিসেব করে দেখা গেছে যে, যদি আমাদের  শস্যভান্ডারের বৃহদংশ খাদ্যের জন্য গবাদি পশুর পরিবর্তে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষকে দেওয়া হতো, তা হলে অনাহারে-অর্র্ধহারে মরতে থাকা পৃথিবীর প্রায় সমস্ত জনসাধারণের খাদ্যের ব্যবস্থা হয়ে যেতো, সেক্ষেত্রে  কোন মানুষই অপুষ্টির শিকার হতো না, কেননা অপুষ্টির মূল কারণ হচ্ছে যথেষ্ট খাদ্য না পাওয়া , তৎসহ যথেষ্ট পুষ্টিকর খাদ্যের অভাব৷

দ্বিতীয়তঃ, পৃথিবীতে এক বিশাল পরিমাণ  জমি খাদ্যের জন্যে পশুপালনে ব্যবহার করা হয়৷ যদি সেই জমির অর্ধেকের কিছু বেশী অংশ খাদ্য শস্য, সয়াবীন ও অন্যান্য প্রোটিন ভিটামিন সরবরাহকারী ফসল উৎপাদনে ব্যবহৃত হতো, তাহলে মানুষ খেয়ে পরে,  স্বাস্থ্য বজায় রেখে বাঁচতে পারতো৷ সেইজন্যে রাষ্ট্র সংঘের প্রাক্তন সেক্রেটারী জেনারেলKurt waldem  বলেছিলেন যে, ধনী দেশগুলোর খাদ্যের ব্যবহারই পৃথিবীতে ক্ষুধার প্রধান কারণ৷ আমেরিকা ও তার মতো  অন্যান্য ধনী দেশগুলোতে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য উৎপাদিত হয় তার ৮০-৯০ শতাংশ পশুর খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যা পরে পশু-প্রোটিন হিসেবে দেশে-বিক্রয় করা হয়, আর সেই ব্যবসাতে তারা ১০ গুণ ২০ গুণ লাভ অর্জন করে৷ তাহলে মানুষ ক্ষুধার জ্বালায় ভুগবেন কেন?

তৃতীয়তঃ  অনেক বিজ্ঞানী ও অর্থনীতি বিদদের  মতানুসারে যেকোনো ধনীদেশের মধ্যবিত্তশ্রেণীর  মান অনুযায়ী আমাদের গ্রহের প্রত্যেকটি মানুষের  অন্ন, বস্ত্র ইত্যাদির  সর্বনিম্ন প্রয়োজনপূর্ত্তির জন্যে যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে৷ একটা সাম্প্রতিক গবেষণা এটা প্রমাণ করেছে যে, পৃথিবীতে এমন কোন দেশ নেই যেখানে জনসাধারণ তাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে খাদ্যের সংস্থান করতে পারে না৷ তাই অত্যধিকহারে জনসংখ্যাবৃদ্ধির চিত্র তুলে ধরে যে, আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয় (অপ্রাকৃতিক ব্যবস্থায় জন্ম নিয়ন্ত্রয়ণের স্বার্থে) তার সঙ্গে  বাস্তবতার কোন মিল নেই৷ আমাদের ভারতবর্ষে প্রতি একর জমিতে জনসংখ্যার যা ঘনত্ব  density) চীনেও তাই , চীনে বরং বেশী, কিন্তু ভারতের মতো চীনদেশের জনসাধারণ  ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করে না৷ তাই এটা স্পষ্ট যে জনসংখ্যার  ঘনত্ব জনসাধারণের ক্ষুধার  কারণ নয়৷ সেই  কারণ হচ্ছে বহুজাতিক সংস্থাগুলি Multi National Companies), যারা খাদ্য-ব্যবসাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে, যারা আবার বিভিন্ন দেশে ব্যাপক রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণেরও অধিকারী, এরা খাদ্য ব্যবস্থার প্রত্যেকটি পর্যায়ের কর্ত্তৃত্বও দখল করে৷ ভারতে আবার বর্তমানে বহুজাতিকদের হাতে বাজার (খোলা ও পাইকারী দুই-ই) বহুজাতিকদের পুরোপুরি খুলে দেওয়া হয়েছে৷ ব্যবসার জন্যে বহুজাতিকরা একটা কৌশল করে৷ প্রথমে উৎপাদনকারীদের কাছে চড়া দামে বা উপযুক্ত দামে জিনিস কেনে৷ তাছাড়া বহুজাতিকরা  আবার নিজেরাই খাদ্য উৎপাদন করে  ও তার সঙ্গে সম্পর্কিত বাকী পণ্যদ্রব্যও নিজেরাই উৎপন্ন করে, খাদ্য-প্রক্রিয়াকরণ শিল্পও কিনে নেয়৷ এইভাবে একটার পর একটা ঝাঁ চকচকে সুপার মাকের্ট, নিজেরাই , মল চালু করে ক্ষুদ্রচাষী বা ব্যবসায়ীদ্রেদর বাজারে প্রতিযোগিতা থেকে সরিয়ে দেয়৷ তারপর তারা কৃত্রিমভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি করে ও বিনিয়োগ থেকে অনেকগুণ বেশী লাভের কড়ি ঘরে তোলে৷

চতুর্থতঃ ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি ছোট্ট দেশ হাইতি আজ চরম দারিদ্রে জর্জরিত৷ তারা তাদের দেশে পাহাড়গুলির ঢালু অংশে খাদ্যশস্যের চাষ করে৷ এই জমিগুলি চাষের জন্যে খুবই উপযোগী৷ বর্তমানে সেই দেশের বা অন্য দেশের ধনী লোকেরা এই জমিগুলির মালিক৷ আমেরিকা বা অন্য ধনী দেশের  ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলি এখন গবাদি পশুদের এখানে চরানোর জন্যে উড়িয়ে আনে ও তাদের মাংস অন্যান্য দেশে রপ্তানি করে৷ তাই বাস্তব সত্যটা হচ্ছে বহু সস্তান উৎপাদনকারী ক্ষুধার্ত জনসাধারণ খাদ্য-সুরক্ষার জন্যে বিপদ নয়৷ বিপদ হচ্ছে অল্পসংখ্যক সুবিধাভোগী মানুষের অর্থ-গৃধ্নুতা তথা অতিলোভ৷

বিশালতম পঁুজিবাদীদের মাত্রাছাড়া লোভ এমন পর্র্যয়েও চলে যায়, যার জন্যে বিশালতম অ্যামাজন জঙ্গল (যাকে বলা হয় পৃথিবীর ফুসফুস) কেটে সাফ করে মাংস  রপ্তানীর কারখানা খুলতেও এরা দ্বিধাবোধ করেনা৷ পরে জানাজানি হওয়ায়, পৃথিবীজুড়ে যখন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু হয় তখন এরা নিবৃত্ত হয়৷

কয়েক বছর আগে পৃথিবীর বিশিষ্ট বিজ্ঞানীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ করেছে যে, সমুদ্রের তলায় যে পরিমাণ মানুষের খাদ্য সঞ্চিত আছে, যদি অনুমাণ করা যায় বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে, তার থেকে অনেক বেশী হারে যদি জনসংখ্যা বাড়েও তবু কয়েক হাজার বছর ধরে সমুদ্রের নীচের ওই খাদ্যসম্ভারের ওপহর নির্ভর করে মানুষ ভালভাবে বেঁচে থাকতে পারবে৷

প্রাউট প্রবক্তা শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার বলেছেন যে, সৃষ্টিকর্র্ত যিনি এই মানুষ , জীবজগৎ সৃষ্টি করেছেন, মানুষেরা পৃথিবীতে আসার অনেক আগে থেকে তিনি তাদের জন্য অফুরন্ত খাদ্যভান্ডার সৃষ্টি করেছেন মানুষকে দিয়েছেন সবচেয়ে বড় সম্পদ বুদ্ধি৷ সেইসব বৈজ্ঞানিক বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে, জল-স্থল-অন্তরীক্ষ তোলপাড় করে সেই খাদ্যকে খাওয়ার উপযোগী করে মানুষকে  তৈরী করে নিতে হবে৷ কিন্তু এ ব্যাপারে গবেষণা বেশীদূর এগোতে পারছে না৷ কারণ বিশেষ সুবিধাভোগী পঁুজিপতি শ্রেণী ভাল করেই  জানে যে এই ভাবে অনেক সহজে ও কম খরচে মানুষের খাদ্যের ব্যবস্থা হয়ে যাবে, তাদের কাছে যা চরম সর্বনাশের সমতুল৷ তা হল এতদিন ধরে সযত্নে গড়ে তোলা ও জাঁকিয়ে বসা আর্থিক শোষণ-নিষ্পেষণ নিপীড়নের মৌরসী-পাট্টা ধসে পড়বে যে৷ তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি কোন সমস্যাই নয়৷

সবজাতি, সবদেশ ও সব সম্প্রদায়ের মানুষই আজ ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস অভ্যস্ত৷ এটা ঠিকই যে মানুষের ত্রুটিপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস  একদিনে বদলানো যাবে না, আর এ ব্যাপারে জোর জবরদস্তি করা যায় না বা করাও উচিত নয়৷ মানুষকে ভাল করে বোঝাতে হবে, তাদের ও সকলকে এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে, মানবত্ববোধ জাগানোর চেষ্টা করে যেতে হবে৷

তবে একটা কথা সত্যি যে পঁুজিবাদের এই সর্বনাশা ও আগ্রাসী মনোভাব এখন গভীরে চলে গেছে , তার মূলোচ্ছেদ করতে হবে, ক্ষুধা নিয়ে এই ঘৃণ্য রাজনীতি চিরতরে বন্ধ করতে হবে৷ এর জন্যে এক সুমহান আদর্শের Ideology) পতাকাতলে সকলে সমবেত হতে হবে, একটা ফলপ্রসূ ও বৈবহারিক সামাজিক-আর্থিক তত্ত্ব বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে হবে৷ আর শোষক তত্ত্বকে সম্ঝে দিতে হবে ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে৷’ সেদিন সমাগত প্রায়৷