আমাদের এই পৃথিবীতে প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রথম যে ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল তা প্রায় ৬ লক্ষ বছর আগে৷ ভাষা তো এল কিন্তু বৌদ্ধিক মান বলে তখন কিছুই ছিল না৷ আধুনিক মানুষ এসেছে প্রায় এক লক্ষ বছর আগে৷ তাদের ভাষা ছিল কিন্তু তখনও ৰৌদ্ধিক মান তত উন্নত ছিল না৷ সে কারণে তাদের ভাষার শব্দসম্ভার অতি অল্প সংখ্যক৷ উন্নত প্রজাতির বানরদের মধ্যে শব্দের সংখ্যা ৮০০৷ আর একদম অবনত পর্যায়ের মানুষদের মধ্যে শব্দের সংখ্যা হচ্ছে কিঞ্চিদধিক ৯০০৷ কিন্তু আধুনিক ফরাসী ভাষাতেই শব্দসম্ভার চার লক্ষেরও অধিক৷
এখন মানুষ যখন প্রথম কথা বলতে শিখল তখন অদের অভিব্যক্তিগুলি সীমাৰদ্ধ ছিল শুধুমাত্র শারীরিক ব্যাপারে বা মানসিক ব্যাপারের সেইটুকু অংশ যা দেহ সংক্রান্ত এর বেশী কিছু নয়৷ পৃথিবীর নৃতাত্ত্বিক ও পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাস একই কথা বলে৷ মৌল মানবীয় মূল্যৰোধ বলে কিছু তখন গড়ে ওঠেনি৷ মানুষ আর পশুর মধ্যে তফাৎ ছিল খুবই নগণ্য৷
কিন্তু মানুষের অন্তর্মুখীনতার পথে যে যাত্রা তাতে সংঘর্ষ-সমিতির কারণে ৰুদ্ধি বিকশিত হ’ল৷ মানুষের মনে জেগে উঠল সেই চিরন্তন প্রশ্ণ---‘আমি কে? আমি কোথা থেকে এসেছি৷ কোথায় বা আমার যাত্রার পরিসমাপ্তি? এরপরে উন্নত ৰুদ্ধির প্রথম স্ফূরণ হ’ল, মানুষ নিজের মনের ভেতরেই উত্তর পেল---‘‘তুমি হলে তিনি অর্থাৎ পরমপুরুষ, তুমি এসেছ পরমপুরুষ থেকেই দ্বিতীয় প্রশ্ণেরও সে একদিন জবাব পেল---‘পরমপুরুষই তোমার একমাত্র লক্ষ্য৷’ কিন্তু এই স্তরে মানুষের মনে তৈরী হয়ে গেল আর একটি প্রশ্ণ---‘‘তুমি অর্থাৎ পরমপুরুষ কে? তোমার পরিচয়ই বা কি?’’ এই স্তরেই দার্শনিকতার জন্ম হ’ল৷ ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী---পৃথিবীর প্রথম দার্শনিক হচ্ছেন মহর্ষি কপিল৷ তিনি এসেছিলেন সাড়ে তিন হাজার বছর আগে৷
এখন ‘তুমি কে? হে পরমপুরুষ৷’ ---মানুষের সাধারণ ৰুদ্ধিতে এই প্রশ্ণের কোন উত্তর নেই৷ কেন নেই? না, জড়জাগতিক সংরচন বা মানুষের শারীরিক সংরচনা কাজ করে দেশ-কাল-পাত্রের সীমাৰদ্ধতার মধ্যে৷ শারীরিক ক্রিয়াকলাপ এর বাইরে যেতেই পারে না৷ তাই ৰুদ্ধিকে এক নির্দিষ্ট অধিক্ষেত্রের মধ্যেই কাজ করে চলতে হয়৷ যেখানে তার অস্তিত্ব নেই সেখানে সে যাবে কী করে? মানুষের মন তার উৎসের দিকে চলতে চলতে প্রারম্ভিক বিন্দু পর্যন্ত এসে পৌঁছায়, তারপর আর সে যেতে পারে না৷ কেননা সেখানেই তার সীমা ওটুকুই তার কর্মক্ষেত্র (functional periperiphery)৷ মানুষের মনের ক্ষেত্রে এটাই হচ্ছে তার প্রধান অসুবিধা৷ তাই পরমপুরুষের সগুণাত্মক আর নির্গুণাত্মক যে বিভিন্ন উচ্চস্তরীয় অস্তিত্ব রয়েছে তার অভিজ্ঞতা থেকে মানুষ বঞ্চিত থেকে যায়৷
আর যখন মন সাধনার মাধ্যমে পরমপুরুষের সঙ্গে একীভূত হবার চেষ্টা করে তখন চরম একাগ্রতার কারণে এক সময় মন নিরুদ্ধ হয়ে যায়৷ সেই নিরুদ্ধাবস্থায় পরমাত্মার স্পর্শ পাওয়ার পর যখন আবার মন দেশকালপাত্রের পরিসীমার মধ্যে ফিরে আসে তখন সে সেই অনির্বচনীয় আনন্দানুভূতিকে ভাষায় ব্যক্ত করতে পারে না, বোঝাতে পারে না সেই অবস্থাটা কী রকম ছিল৷ তাই মানুষ একমাত্র ৰোধির সাহায্যেই পরমপুরুষের অনুভূতি পেতে পারে৷ ৰুদ্ধির সাহায্যে তাকে ধরাছোঁয়া যায় না ৰুদ্ধি যেখানে অগম্য বোধি যেখানে সহজে পৌঁছে যায়৷ হাজার হাজার বছর পরে যখন মানুষের মধ্যে ৰোধির বিকাশ ঘটল, মানুষ ৰুঝল যে কিছু মৌল নীতি রয়েছে যার মধ্যে মানুষের অস্তিত্বের মহত্তম মূল্যৰোধ নিহিত আছে৷ তখনই মানুষ অনুভব করল জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হলেন পরমপুরুষ, দ্বিতীয় লক্ষ্য বলে কিছু নেই৷
আর মানুষের পরমপুরুষের দিকে যে গতি এটাই সত্যিকারের প্রগতি৷ আধ্যাত্মিকতা ছাড়া জীবনের অন্য কোন স্তরে প্রগতি সম্ভব নয়৷ এই আধ্যাত্মিক প্রগতির সাথে ধর্মীয় মতবাদের কোন সম্পর্ক নেই৷ এই প্রগতি মানুষের জীবন ধারণের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে সংগতিপূর্ণ৷ পরমপুরুষ অভিমুখী এই যে গতি তা হচ্ছে সংশ্লেষণাত্মক, অনেক থেকে একের দিকে৷ আর বাকী সব গতি বিশ্লেষণাত্মক---এক থেকে অনেকের দিকে বা প্রগতির পক্ষে বাধা স্বরূপ৷ মানুষের সামগ্রিক প্রয়াসটাই হবে সংশ্লেষণাত্মক(synthetic)৷
প্রথম উন্নত ভাষা হচ্ছে বৈদিক ভাষা৷ কিন্তু তখন কোন লিপি ছিল না৷ বৈদিক আর্যরা ১৫ হাজার বছর আগে যে বৈদিক ভাষায় কথা বলতেন তা তারা লিপিৰদ্ধ করতে পারতেন না৷ লিপি এসেছে আনুমানিক ৫ হাজার বছর আগে৷ তার আগে সেই যুগের মুনি-ঋষিরা তাদের পারমার্থিক উপলব্ধি, আধিদৈবিক ধারণাসমূহ আর মহত্তর নান্দনিক বিচারধারা তাঁদের শিষ্যদের কাছে ব্যক্ত করতে মুখে মুখে৷ কেননা এ, বি, সি, ডি, আলফা, বিটা, গামা প্রভৃতি অক্ষর না থাকার জন্যে সে সব লিপিৰদ্ধ করা যেত না৷ হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের আধ্যাত্মিকতার পথে যে প্রয়াস তাতে কোন নিয়মৰদ্ধতা ছিল না৷ প্রায় ৭ হাজার বছর আগে ভগবান সদাশিব প্রথম সাধনা তথা আধ্যাত্মিক পদ্ধতিকে একটা নিয়মের মধ্যে, একটা সংরচনার ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে এলেন৷ সেটাই হ’ল তন্ত্র, যোগ৷ সাড়ে তিন হাজার বছর আগে ভগবান কৃষ্ণ সেই একই কাজ করেছিলেন৷ এখন আধ্যাত্মিকতার পথে, পরমাপ্রাপ্তির পথে এগিয়ে চলতে চলতে উপযুক্ত নির্দেশনার অভাবে মানবতা কখনও কখনও অধঃপতিত হয়েছে, কলুষিত হয়েছে৷ সেই অবস্থায় মানুষ পাপ ৰোধের শিকার হয়ে নানারকম দুর্দৈবের সম্মুখীন হয়েছে৷ আমি তোমাদের আগেই বলেছি যে ‘আমি পাপী’ এটা একটা ত্রুটিপূর্ণ ধারণা আর এই ধারণাকে প্রশ্রয় দিলে তুমি পাপী না হলেও একদিন পাপী হয়েই যাবে৷ এক শ্রেণীর মানুষ পাপ সংক্রান্ত মানুষের হীনম্মন্যতা ৰোধকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করেছে, মানুষের সমাজে অসংখ্য ভেদাভেদ, গোষ্ঠী আর বিভিন্নতা তৈরি করেছে৷ এই ভাবে তারা এক ও অবিভাজ্য মানবসমাজকে খণ্ড খণ্ড করেছে৷ আজ এই বিংশ শতাব্দীতে শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মানুষদের কর্তব্য হচ্ছে নিরাপরাধ ও সাধাারণ মানুষকে ওই সব জাগতিক-মানসিক-মতবাদগত শোষণ থেকে সযত্নে রক্ষা করা৷
সুদূরতীতে যখন মানুষ ওই রকম বঞ্চনার কবলে পড়েছিল, সাধারণ মানুষের মনে পাপবোধের সূচীকাভরণ করে দেওয়া হয়েছিল, তখন ভগবান কৃষ্ণ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন---
‘‘অপিচেৎ সুদূরাচারো ভজতে মামনন্যভাক
সোপি পাপবিনিমুক্তোমুচ্যতে৷৷’’
পরমপিতা বলছেন---‘তুমি যদি নিকৃষ্ট ধরনের পাপী হও যাকে অন্যান্য পাপীরাও ‘‘পাপী’ বলে ঘৃণা করে, তবু তুমি যদি পরমপুরুষের শরণ নাও তাহলে তিনি তোমাকে পাপের অভিশাপ থেকে, নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা করবেন৷’একমাত্র এই ভাবনার মধ্যে দিয়েই মানুষ পাপ সংক্রান্ত সব ভীতি, উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে৷
পরমপুরুষ যখন তোমার সঙ্গে আছেন তখন হীনম্মন্যতা ৰোধের দ্বারা গ্রস্ত হয়ে শুধু শুধু কষ্ট পাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই৷ পরমপুরুষকে ‘‘আমি পাপী, আমাকে বাঁচাও” একথা বলাও নিরর্থক৷ তিনি যে মানুষটির ক্ষেত্রে যা করার দরকার তা অবশ্যই করবেন৷ তাই তুমি একটিই কাজ করতে পার---তা হচ্ছে পরমপিতার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসর্পণ৷ তবেই তুমি পরম প্রশান্তি লাভ করবে৷ তুমি জেনে বা না জেনে যদি কোন ভুল করেও থাক তাহলে তোমার অনুতাপ ৰোধের মধ্য দিয়ে আর প্রাণ, মন ঢেলে ‘‘বাবা নাম কেবলম্” কীর্ত্তন করে নিলে তুমি সব পাপ থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে৷ তাই তোমার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, তা অত্যন্ত উজ্জ্বল৷
(লিঁয়, ফ্রান্স, ৩রা জুন, ১৯৭৯ সন্ধ্যা)