গত রাতে আমি এই পরিদৃশ্যমান জগতে বিভিন্ন সম্ভাবনাপূর্ণ অস্তিত্ব,যেমন—অণুমানসত্বা ও চিতিসত্তা সম্পর্কে বলেছিলুম ।পরম চিতিশক্তির যে অন্তর্মুখী গতি (বহির্মুখী গতিতে পঞ্চভৌতিক জগতের উৎপত্তি) তারই এক স্তরে মানুষের সৃষ্টি ।এইঅন্তর্মুখী গতি পরম চিতিশক্তিতে ফিরে আসার জন্যে । **এখন আমরা জানি শক্তির ঘনীভূত রূপ হচ্ছে জড় বস্তু । আবার এই জড়তত্ত্ব চূর্ণীভূত হলে (সুক্ষ্মক্ত্বের পথে চলতে থাকলে) মনের উৎপত্তি হয় । ধর তোমাকে খুব কষ্টকর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করতে হচ্ছে । এতে স্বাভাবিক ভাবে তুমি এক সময় পরিশ্রান্ত হয়ে পড়বে । কিন্তু তুমি যদি একনাগাড়ে দশ-বারো ঘন্টা ধরে বৌদ্ধিক শ্রমের কাজ করতে থাক তাহলেও তুমি ক্লান্তিবোধ করবে । সেক্ষেত্রে তুমি শরীর মন দু’য়েতেই ক্লান্তি অনুভব করবে । তাই নয় কি?
তাই মানুষের শরীর কেবলমাত্র একটি জড়াধারই নয়, এটি মানসাধার ও আত্মিক অস্তিত্বও বটে । আসলে এই আত্মিক অস্তিত্বের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম ।মানুযের আছে পাঞ্চভৌতিক দেহ আর আছে মানসদেহ যাতে আছে বিভিন্ন স্তর বা কোষ---স্থূল-সুক্ষ্ণ-কারণ ইত্যাদি । কিন্তু আধ্যাত্মিক অধিক্ষেত্রে কোন দেহ বা আধার থাকতে পারেনা । আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে সাক্ষীতত্ত্ব যা দেহভূত কোন সত্তা হতে পারেনা ।
কিন্তু এই সাক্ষীসত্বা অবশ্যই শরীর ও মনের সঙ্গে সর্বদা সম্বন্ধিত হয়ে থাকছে । তোমার শরীর যা কিছু করছে আত্মা তার সাক্ষী হয়ে সব দেখছে, জেনে যাচ্ছে । অনুরূপভাবে তোমার মানসদেহেরও সব চিন্তাভাবনার সাক্ষী হচ্ছেন আত্মা ।
যখন এই সাক্ষীতত্বা কোন ব্যষ্টিসত্ত্বার সাক্ষীস্বরূপ হয়ে থাকে তখন তাকে বলা হয় জীবাত্মা বা অণুচৈতন্য । আর যখন তা সামুহিকভাবে এই বিশ্বের সব কিছুর জ্ঞাতা তখন তা পরমাত্মা বা পরম চৈতন্যসত্তা ।তাই এই পরম চৈতন্য হচ্ছেন পরমপুরুষ, পরমপিতা, অণুচৈতন্য হচ্ছেন জীবাত্মা ।
অণু ও ভূমার মধ্যে এখানেই পার্থক্য হয়ে যায় । অণু চৈতন্য বা জীবাত্মা, অণুমন বা দেহ কী করছে তা জানতে পারছে । ধর,কেউ একজন একাদশী তিথিতে নির্জলা উপবাস করছে ।সে একটি ঘরে বসে লুকিয়ে চকোলেট খেয়ে নিলে । সে ভাবছে কেউ জানতে পারল না । কিন্তু তা নয় ।জীবাত্মা সঙ্গে সঙ্গে এটা জেনে যাবেন যে সে লুকিয়ে চকোলেট খেল । আর জীবাত্মা জানবেন বলেই পরমাত্মাও জেনে যাবেন যে ওই মানুষটি একটা ঘরে বসে লুকিয়ে চকোলেট খেল,আর সে মনে মনে ভাবছে উপবাসের দিনে তার চকোলেট খাওয়া কেউ জানতে পারল না । তাঁর কাছে কিছুই লুকোনো থাকেনা ।
ধর‘ক’নামে একজন মনে মনে ভাবল—‘আমি জেনারেল দর্শনে যাব না আর ‘বাবনাম কেবলম্’ কীর্তনও আজ রাতে করব না’ ‘ক’এর এই চিন্তাতরঙ্গ পরমপিতার কাছে তৎক্ষণাৎ পৌঁছে যাবে । তিনি বলবেন—‘‘হুঁ’’ –‘ক’ এই ভাবছে । আচ্ছা আজ থেকে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করে দাও যে ‘ক’ কোনদিনই জেনারেল দর্শনে যোগদান করতে পারবে না ।’’ তাই তাঁর কাছে গোপন বলে কিছু থাকতে পারেনা ।
এখন আধ্যাত্মিক সাধনা হচ্ছে অণুঅস্তিত্ব কে ভূমাঅস্তিত্বে রূপান্তরিত করা । ব্যাপারটা আরো স্পষ্ট করে বলি । প্রতিটি অণুসত্ত্বা সীমার বন্ধনে আবদ্ধ । যা সীমিত তা সত্ত্বগুণ । রজোগুণ ও তমোগুণ – এই ত্রিগুণের পরিসরে এসে যাবেই । যখন মনের বিষয় বা object কোন সীমিত বা ক্ষুদ্র তখন তার বিষয়ীভূত counterpart হচ্ছে অণুচৈতন্য ।
যখন কোন ক্রিয়া সংঘটিত হয় তাতে থাকে দুটি সত্তা,--বিষয় (object) আর বিষয়ী(subject) । দৃষ্ট বস্তু হচ্ছে বিষয়, দ্রষ্টা হচ্ছে বিষয়ী আর এদের মধ্যে যোগসুত্র হিসাবে দর্শন রূপ কার্য (act of seeing) । এখন বিষয় যখন অসীমিত বা অনন্ত তখন বিষয়ী অবশ্যই হবেন অনন্তসত্তা অর্থাৎ ভূমাচৈতন্য ।
তাই সাধনা হচ্ছে এই ক্ষুদ্র বিষয়কে অনন্ত বিষয়ে পরিনত করা । তুমি যখন এ টুকু ভাব ---‘এই ক্ষুদ্র শরীরটা আমার’—তুমি তখন জীবাত্মা । আর তখন তুমি ভাব বা ভাবতে পার, ‘এই বিশাল মহাবিশ্ব আমার’—তুমি তখন হয়ে গেলে পরমপুরুষ! প্রথম ক্ষেত্রে তুমি অণুমনের সব কিছু জেনে যাবে । কিন্তু যখনই এই মহাবিশ্ব তোমার বিষয় হয়ে যাবে তুমি তখন এই ব্রহ্মান্ডের সব রহস্য জেনে যাবে । তাই তোমার সাধনা হচ্ছে ক্ষুদ্রকে বৃহতে রুপান্তরিত করার অনুশীলন ।
সাধনার মধ্যে দিয়ে নিজেকে রূপান্তরনের এই যে প্রয়াস তাই মানুষকে বিশ্বমানবতার পুজারী করে তোলে । এই ভাবেই তার মন দেশ-কাল-পাত্রের সীমা ছাড়িয়ে অসীমের দিকে ধাবমান হয় । সে অবস্থায় সে শুধু সর্বশক্তিমান হয়ে যায় তাইই নয়,সে সর্বজ্ঞত্ত্বও অর্জন করে । সে গাদা গাদা বই না পড়েও সব কিছু জেনে যায় ।
অনুর ক্ষেত্রে কোন রকমের জ্ঞান অর্জন করতে গেলে একজন মানুষকে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে, অন্য মানুষের সাহার্য নিয়ে ও পুস্তকের মাধ্যমে অনেক কিছু শিখে নিতে হবে । তা ছাড়া অণুসত্তাকে নানা আশা-নিরাশা, অনেক রকম সংঘর্ষ-সমিতির মধ্যে দিয়েও যেতে হবে ।
কিন্ত পরমপুরুষের ক্ষেত্রে কোন হতাশা, কোন সংঘর্ষ-সমিতির প্রশ্ন থাকে না । কেননা ভূমার ক্ষেত্রে সবকিছু আভ্যন্তরীণ; সবকিছুই তাঁর মনের মধ্যে,কোন কিছুই ভূমার বাইরে নে্ই, সমগ্র মহাবিশ্ব ভূমার মানস সত্তার অঙ্গীভুত হয়ে আছে, তাই এই ক্ষেত্রে কোন দ্বিতীয় সত্তা থাকতে পারে না । সেই জন্যে কোন সংঘর্ষ-সমিতির প্রশ্নও ওঠেনা ।
তাই কেউ যদি মানসিক শান্তি পেতে চায় ভাহলে তাকে কি করতে হবে? তাকে তার ক্ষুদ্র অস্তিত্বকে বৃহৎ অস্তিত্বে রূপান্তরিত করতে হবে । মানসিক শান্তি পাওয়ার আর দ্বিতীয় কোন রাস্তা নেই । শুধু শান্তির বাণী প্রচার করলেই মানুষের জীবনে শান্তি আসবে না । তোমাকে এই জন্যে নিজের স্থুলত্বকে বিসর্জন দিয়ে বৃহত্বে পর্যবসিত হতেই হবে ।
(লিঁয়, ফ্রান্স, ৩রা জুন,১৯৭৯,সকাল)