মহাপ্রয়াণ দিবসের শপথ

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

২১শে অক্টোবর৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী মহাপ্রয়াণ দিবস৷ ১৯৯০ সালের ২১শে অক্টোবর তিনি স্থূল শরীর ত্যাগ করেছিলেন৷ তাই স্থূল দেহগত বিচারে এটা তাঁর মহাপ্রয়াণ দিবস৷ কিন্তু সূক্ষ্ম বিচারে তথা আধ্যাত্মিক বিচারে তাঁর মহাপ্রয়াণের প্রশ্ণই ওঠে না৷ আধ্যাত্মিক বিচারে তিনি শাশ্বত চৈতন্য সত্তা–পরম আনন্দঘন সত্তা৷ তা তাঁর ভক্ত সাধকেরা সর্বদাই অনুভব করেন–মনকে আধ্যাত্মিক স্তরে উন্নীত করে’৷ তাঁরা অনুভব করেন, তিনি সবার অন্তর্লোকে সদা আনন্দমূর্ত্তিরূপে বিরাজিত৷

এই আপেক্ষিক জগতের কথা বললেও–এই স্থূল জগতে তিনি শরীর ত্যাগ করলেও তিনি এখানেও সূক্ষ্মরূপে সদা বিরাজমান৷ কারণ, তিনি মানব জীবন সম্পর্কে যে অমোঘ সত্যের বাণী শুণিয়েছেন, তা হ’ল–ন্ন্দ্রন্দ্ব ন্ব্দ ঢস্তুন্দ্বপ্সপ্তপ্সন্ধ্ ন্দ্রপ্তপ্সভ্র–মানবজীবন এক আদর্শের প্রবাহ৷ আর এক্ষেত্রে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী জীবন তো এক পরম তথা পরিপূর্ণ আদর্শের প্রবাহ ছাড়া আর কিছু নয়৷ তাই তিনি বলেছেনও–আমি এই ভৌতিক হ্মড়ম্ভব্দন্ন্তুত্রপ্ত্ শরীর নই, এই ভৌতিক শরীরটাও ‘আমি’ নয়৷ যদি আমাকে জানতে চাও, তবে আমার আদর্শের জন্যে কাজ করো, কারণ ‘আমি’ নিজেকে আদর্শের সঙ্গেই সম্পূর্ণ একাত্ম করে দিয়েছি৷’

কী সেই আদর্শ বস্তুতঃ তিনি সেই আদর্শের মূর্ত্ত বিগ্রহ–যে আদর্শ মানবজীবন তথা মানব সমাজের পরম আদর্শ৷ এই আদর্শের পথ ধরে মানুষ তার জীবনের পরম চরিতার্থতা লাভ করতে পারবে৷ আর এই আদর্শের পথ ধরে মানব সমাজও তার পরম লক্ষ্য–বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠা করতে পারবে৷

এখন, কী সেই আদর্শ ‘আত্মমোক্ষার্থং জগদ্ধিতায় চ’৷ গানের ভাষায় তিনি বলেছেন, ‘‘জীবনের ধ্রুবতারা ভুলো না রে৷’’ (প্রভাত সঙ্গীত)৷ মানুষের জীবনের পরম লক্ষ্য সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে’৷

তিনি সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘‘মানুষ তুমি ওঙ্কারের পথ ধরে সূক্ষ্মত্বের দিকে এগিয়ে চলো৷ ছুটো না তুমি আপাতমধুর তমোগুণী মরীচিকার দিকে৷ সত্ত্বগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর ব্রহ্মত্বে লীন হও৷ ওঁঙ্কার যেখান থেকে এসেছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাও৷ সাধনায়, নিষ্ঠায় জাগিয়ে তোল নিজের সুপ্ত মনুষ্যত্বকে–উদ্বোধন করো দেবত্বের মনীষাকে, আর সেই সাধনালব্ধ শুচিশুভ্র দেবত্বকে বিলিয়ে দাও ব্রাহ্মী মহিমার অখণ্ড স্রোতে৷ অর্জন করো সেই পরমা স্থিতি যার জন্যে অনাদিকাল থেকে তুমি অনেক কষ্টে এগিয়ে এসে আজ নিজেকে মানুষ বলে পরিচয় দেবার সুযোগ পেয়েছ৷’’

এ হ’ল আধ্যাত্মিক দিকের আদর্শ৷ আর তার সঙ্গে অবশ্যই চাই সমাজকল্যাণব্রত৷ শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী শিক্ষা, ‘‘সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে চলার মধ্যেই সমাজের সার্থকতা৷ কেউ যদি যাত্রাপথে পিছিয়ে পড়ে, গভীর রাত্রির তমিস্রার দমকা হাওয়ায় যদি কারও দীপ নিভে যায় তবে তাকে অন্ধকারের মধ্যে একলাটি ফেলে দিয়ে চলে গেলে চলবে না, তার হাত ধরে তুলে নিতে হবে–নিজের প্রদীপের আলোয় জ্বালিয়ে দিতে হবে তার নিভে যাওয়া দীপকের শিখাকে৷’’

মানুষের মধ্যে এই সমাজ–চেতনার জাগরণই শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী সমাজ–কল্যাণ ব্রতের গোড়ার কথা৷ তিনি তাঁর আদর্শ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘‘আমাদের ‘সংগচ্ছধ্বং সংবদধ্বং’ (একসঙ্গে চল, একই ভাব প্রকাশ কর) মন্ত্রে সমাজ চেতনার মূল ভাবটি নিহিত৷ যেখানে সেরূপ কোনো মন্ত্র নেই, সেখানে কোনো আদর্শ নেই, সেখানে জীবন একটা লক্ষ্যহীন যাত্রা মাত্র৷ ‘সংগচ্ছধ্বং’ এর তাৎপর্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই আমি ‘প্রাউট’ তত্ত্বকে দিয়েছি৷ সুতরাং পুরো ‘প্রাউট’ তত্ত্বটাই এই বৈদিক সংগচ্ছধ্বং মন্ত্রের ওপর দাঁড়িয়ে আছে’৷

‘প্রাউট’ তত্ত্বের মাধ্যমে শ্রীশ্রীআনন্দমূর্ত্তিজী (শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার) সমাজের মানুষকে সর্বাত্মক মুক্তির পথ–নির্দেশনা দিয়েছেন৷ বলেছেন, জড় জগতের যে অর্থনৈতিক বন্ধন (অভাব), রাজনৈতিক দাসত্ব, নানান ধরণের সামাজিক পরাধীনতা এসব থেকে মুক্তিলাভের যে প্রয়াস সেটাই হ’ল জড়জগতের মুক্তি৷ এই ধরণের জাগতিক বন্ধন–মুক্তির জন্যে মানুষকে চেষ্টাশীল হতে হবে৷’’

সোজা কথায়, সমাজের সর্বপ্রকার সমস্যার সমাধানের পথ তিনি ‘প্রাউটে’র মধ্যে দিয়েছেন৷ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক বা শিক্ষা–সংস্কৃতিগত–সমস্ত সমস্যারই সুষ্ঠু সমাধানের সুস্পষ্ট পথনির্দেশনা দিয়েছেন৷

আজ সমাজের জন্যে যা প্রয়োজন–ত্ত্বন্দ্বভ্র ত্ত্ত্রু, ত্ত্বন্দ্বভ্র ত্নপ্ত্ত্রু (নোতুন মানুষ, নোতুন পরিকল্পনা)–কীভাবে সমাজে সেই নীতিবাদী, সেবাব্রতী ও ত্যাগব্রতী মানুষ তৈরী করতে হবে–তার বাস্তবসম্মত পথ যেমন তিনি দিয়েছেন, তেমনি কেমন করে এক আদর্শ সর্বাত্মক শোষণমুক্ত সমাজ গড়ে তুলতে হবে, তার পূর্ণ পরিকল্পনাও তিনি দিয়েছেন–তার আধ্যাত্মিক আদর্শ, নব্যমানবতাবাদ, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র তথা প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রের আদর্শের মাধ্যমে৷

আজ যাঁরা তাঁর এই আদর্শকে সামান্যতম বুঝেছেন, তাঁদের এই সুমহান আদর্শকে নিজেদের জীবনে তথা সমাজে বাস্তবায়িত করার জন্যে দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করতে হবে৷ এই মহাপ্রয়াণ দিবস–সেই সংকল্প গ্রহণের–শপথ গ্রহণের দিন৷ তাই ৬দিনের কীর্ত্তন শেষে সকল মার্গী ভাই বোনদের শপথ নিতে হবে–আনন্দমার্গের সর্বান্যুসূ্যত জীবন দর্শনকে বাস্তবে রূপ দেবার৷