গত রাতে আমি তোমাদের ‘মন্ত্র’ শব্দের যথাযথ অর্থ সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছিলুম৷ আমি বলেছিলুম যে ‘মন্ত্র’ শব্দের আধ্যাত্মিক অর্থ ও জাগতিক অর্থ এক নয়৷ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে মন্ত্রের অর্থ হচ্ছে সেই সত্তা যা তোমাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি প্রদান করবে৷ এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক ৰন্ধন থেকে তুমি চিরস্থায়ী নিবৃত্তি পেয়ে যাবে৷ আমি আরও বলেছিলুম যে ভারতীয় বর্ণমালায় সব ধ্বন্যাত্মক অভিব্যক্তিই মন্ত্র পদবাচ্য৷
যেখানেই অস্তিত্ব বা গতি আছে সেখানেই মন্ত্র থাকবে৷ তুমি চলছ–খট্, খট্, খট্–এইরূপ ধ্বনি উৎপন্ন হচ্ছে৷ খট্, খট্ হচ্ছে তোমার চলারূপ কার্যের ধ্বন্যাত্মক অভিব্যক্তি যার জন্যে সংস্কৃতে শব্দ হ’ল ‘ৰীজমন্ত্র’৷ তা হলে সব অভিব্যক্তির গতি ও কার্যেরই ৰীজমন্ত্র থাকবে৷ এই ৰীজমন্ত্র হ’ল কোনো বিশেষ ধ্বনি বা ওই পঞ্চাশটি মূল ধ্বনি থেকে নেওয়া বিভিন্ন ধ্বনির মিলিত রূপ (বর্ণমালায় ‘অ’ থেকে ‘ক্ষ’ অক্ষর পর্যন্ত পঞ্চাশটি ধ্বনি বর্ত্তমান)৷ ধ্বনির শেষে ‘অং’ শব্দটি যুক্ত করে দেওয়া হয়৷ এইভাবে ৰীজমন্ত্র তৈরী হয়৷
‘এ’ এক ধ্বনি বা স্বর৷ এটি শিক্ষাপ্রদান রূপ কার্যের দ্যোতক৷ এর শেষে অনুস্বার লাগিয়ে হয় ‘এং’৷ তালব্য ‘শ’ ধ্বনিটি রজোগুণকে ব্যক্ত করে৷ দন্ত ‘স’ সত্ত্বগুণ ও মূর্ধণ্য ‘ষ’ তমোগুণের দ্যোতক৷ ‘শ’ রজোগুণের আর ‘র’ শক্তির (energy) প্রতিভূ৷ চুম্বকীয় শক্তি, বিদ্যুৎ শক্তি বা যত প্রকারের শক্তি আছে ‘র’ ধ্বনি তাদের প্রতিনিধিত্ব করে৷ সুতরাং যেখানে রজোগুণের ক্রিয়াশীলতা আছে, রজোগুণের মনোহর আকর্ষণ আছে, আর তার সঙ্গে আছে শক্তির স্পন্দন, সেখানে শ র, যোগ করে পাচ্ছি ‘শ্র’, স্ত্রীলিঙ্গ ‘শ্রী’৷ এই ‘শ্রী’র সঙ্গে অনুস্বর যুক্ত করে ৰীজমন্ত্র তৈরী হয় ‘শ্রীং’৷ প্রতিটি মানুষ ‘শ্রী’ চায়৷ সেজন্যে এ দেশের পুরোনো প্রথা হচ্ছে যে কোনো ব্যষ্টির নামের আগে ‘শ্রী’ শব্দ যুক্ত করা৷ মহান ব্যষ্টির নামের আগে একাধিক ‘শ্রী’ যুক্ত করারও বিধি আছে৷
এইভাবে আমরা মূল ধ্বনি সূত্রকে নানাভাবে যুক্ত করে অসংখ্য ৰীজমন্ত্র তৈরী করতে পারি৷ কিন্তু আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তাদের সকলেরই কি উপযোগিতা আছে? বলা হয়েছে–
‘‘চৈতন্যরহিতা মন্ত্রা প্রোক্তা বর্ণাস্তু কেবলম্৷
ফলং নৈব প্রযচ্ছন্তি লক্ষ কোটি জপৈরপি৷৷’’
আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ধ্বনির ব্যবহারই যথেষ্ট নয়, এর সঙ্গে থাকতে হবে অতিরিক্ত কিছু আর তা হচ্ছে মন্ত্রচৈতন্য৷ মন্ত্রচৈতন্য শব্দটার অর্থ হচ্ছে, যে মূল বিশেষ ধ্বনির সাহায্যে মহাকৌল বা কৌল নিজের বা অন্যের স্থূলতম অস্তিত্বকে জাগিয়ে নিয়ে তাকে ওপরে ওঠাতে ওঠাতে শেষ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে দিতে পারেন৷ তোমরা জান যেখান থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অভিব্যক্তির সূত্রপাত হয় অর্থাৎ সৃষ্টিরচনার যে প্রারম্ভিক বিন্দু তাকে বলা হয় শম্ভূলিঙ্গ৷ ‘শম’ আর ‘ভূ’ এই দু’টি শব্দ নিয়ে তৈরী হয় ‘শম্ভূ’ শব্দটি৷ ‘শম্’ এর অর্থ নিয়ন্ত্রণ করা৷ তাহলে ‘শম্ভূ’ শব্দের অর্থ হচ্ছে সেই সত্তা যার কাজই হচ্ছে সব জাগতিক কর্ম বা অস্তিত্বকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ ‘‘শঙ্কর’’ শব্দটিও এইভাবে তৈরী হয়েছে৷ শম্ + কৃ + অল্ করে শঙ্কর অর্থাৎ সকলের নিয়ন্ত্রক সত্তা৷ ‘শম্ভূ’ শব্দের অর্থও তাই৷ ‘ভূ’ মানে হওয়া, সকলকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে যে সত্তার উদ্ভূতি তিনিই শম্ভূ৷ সৃষ্টিরচনার প্রারম্ভিক বিন্দু এই শম্ভূ, সেইজন্যে তাঁকে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডের মূলীভূতা ধ্বনাত্মিকা শক্তি অর্থাৎ শম্ভূলিঙ্গ বলা হয়৷ মানুষ বা যে–কোনো সৃষ্ট বস্তুর আদি মাতৃকাগত (causal matrix) বা উৎপত্তিগত সম্পর্ক শম্ভূলিঙ্গের সঙ্গেই৷ লিঙ্গ শব্দের অর্থ হচ্ছে – ‘‘লিঙ্গতে গম্যতে যস্মিন তল্লিঙ্গম্’’–অর্থাৎ সম্পূর্ণ সৃষ্টির অন্তিম লক্ষ্য যা তাই হচ্ছে লিঙ্গ৷ সৃষ্টিধারার কার্যকরী স্তরে স্পন্দিত সত্তাসমুহ (জীব) যখন অস্থায়ী বিরামের অবস্থায় আসে তখন তার সেই যে অভিষ্টযুক্ত বিরাম (desiderating pause), তাকে বলা হয় স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ৷ মানুষের সুষুম্নাকাণ্ডের অন্তিম বিন্দুস্থিত এই যে স্বয়ম্ভূ লিঙ্গ তাতে জীবের অণু দৈবী শক্তি প্রসুপ্তা অবস্থায় থাকে৷ [এটি যেমন] মানবদেহে প্রসুপ্তা দৈবী শক্তি, সব আধ্যাত্মিক সাধকের সাধনার সূত্রপাত বিন্দুটিও এটিই৷ এই বিন্দু থেকেই আধ্যাত্মিক গতির যাত্রা আরম্ভ হয়৷ তাই একে মূলীভূতা ঋণাত্মক শক্তি বা কুলকুণ্ডলিনী বলে৷
যেহেতু জীবদেহে এই দৈবীশক্তি প্রসুপ্তা অবস্থায় থাকে, মহাকৌলকে এই জন্যে কী করতে হবে? মহাকৌল নিজের ব্যষ্টিগত প্রয়াসের দ্বারা সাধকের কুলকুণ্ডলিনীকে মূলীভূতা ধনাত্মিকা শক্তি অর্থাৎ শম্ভূলিঙ্গের স্তর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দেন৷ তন্ত্রে একে বলে ‘পুরশ্চরণ’৷ এখন মহাকৌল যে মন্ত্রের সাহায্যে সাধকের এই পুরশ্চরণ করান তাকে বলে চৈতন্যযুক্ত মন্ত্র৷ আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে কেবল এই মন্ত্রেরই প্রয়োগ করতে হয়, আর একেই বলে সিদ্ধমন্ত্র৷ তাই আধ্যাত্মিকতার বিচারে সাধারণ মন্ত্র যথেষ্ট নয়৷ তোমার চাই সিদ্ধ মন্ত্র আর একমাত্র মহাকৌল সিদ্ধ মন্ত্রের উদ্গাতা হতে পারেন৷ কোনো সাধারণ গুরু বা কৌলের দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়৷ কৌল হলেন তিনি যিনি মহাকৌলকৃত সিদ্ধমন্ত্রের সাহায্যে নিজের কুণ্ডলিনী শক্তিকে শম্ভূলিঙ্গের স্তর পর্যন্ত ওঠাতে পেরেছেন৷ আর সেই মহত্তম সত্তা যিনি মন্ত্র রচনা করে তাকে সিদ্ধ করেন তিনি মহাকৌল (সদগুরু)৷ ভগবান সদাশিব ছিলেন মহাকৌল৷ মহাকৌল ছাড়া অন্য কোনো ব্যষ্টির দ্বারা সিদ্ধমন্ত্র তৈরী করা সম্ভব নয় তথা ওই মন্ত্রের ধ্বন্যাত্মক অভিব্যক্তিতে বা ৰীজমন্ত্রে আধ্যাত্মিক শক্তি বা চৈতন্যৰোধ সংযুক্ত করে তাকে প্রাণবন্ত করা সম্ভব নয়৷ জপক্রিয়া, ধ্যানক্রিয়া তথা সর্বপ্রকার আধ্যাত্মিক সাধনার জন্যে সিদ্ধমন্ত্র অত্যাবশ্যক অর্থাৎ চৈতন্যযুক্ত মন্ত্র অত্যাবশ্যক৷ যে মন্ত্রের পুরশ্চরণ হয়নি অর্থাৎ যাকে সিদ্ধ করা হয়নি তা কেবলমাত্র শব্দসমষ্টি ছাড়া কিছুই নয়৷ তুুমি সেই মন্ত্র হাজার, লক্ষ, কোটি কোটি বার জপ কর না কেন বিন্দুমাত্র ফল পাবে না, কেননা তা সিদ্ধ মন্ত্রই নয়৷* তাহলে ৰুঝে গেলে আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে সাধারণ শব্দ বা অক্ষর বা ধ্বনির কোনো মূল্যই নেই৷