ধর্মচেতনা অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি ব্যষ্টি মানুষের জীবনকে শুভপথে পরিচালিত করে৷ মানুষের মধ্যে সততা আনে৷ নৈতিকতার ভিত শক্ত করে, বিবেককে সদা জাগ্রত রাখে৷ তখনই সমাজের যথার্থ কল্যাণ ও শান্তি আসে৷
বর্তমান সমাজের নেতা-নেত্রীরা, বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা সমাজের মাথা বলে জনসাধারণ মনে করে’ তারা কিন্তু এই ধর্ম সম্পর্কে অনীহা পোষণ করেন৷ তাঁরা নিজেদেরও সমাজের চালক হিসেবে মনে করেন৷ বলা বাহুল্য এদের এই ধর্ম সম্পর্কে অনীহাই বর্তমান সমাজের সমস্ত সমস্যারই মূলে৷ কারণ মানুষ যদি যথার্থ মানুষ না হ’ল, তারা যদি সততা নৈতিকতা, ন্যায়-সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত না হ’ল তারা তো স্বীয় ক্ষুদ্র স্বার্থসিদ্ধির জন্যে সমাজে নানান কুকর্ম করবেই৷ পারিবারিক ও সামাজিক হিংসা দ্বেষ, দুর্নীতি, শোষণ----এ সবকিছুর মূল তো এটাই৷
মানুষের এগিয়ে চলার জন্যে দরকার শক্তি-সামর্থ্য, আর তার সঙ্গে চাই ভেতরের প্রেরণা৷ সাধারণতঃ মানুষ নিজের সুখের চিন্তা করে’ কাজ করে৷ বৃহত্তর সমাজের কথা না ভেবে নিজের বা নিজের পরিবার বা নিজের সম্প্রদায়ের স্বার্থে কথা ভেবে কাজ করে৷ একে বলা হয় আত্মসুখতত্ত্ব৷
আর এক ধরণের প্রেরণা(Inspiration) হ’ল সম-সমাজতত্ত্ব৷ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলার ভাব, বিশ্বের সমস্ত জীব পরমপুরুষের সৃষ্টি---তাঁর সন্তান৷ আমরা সবাই এক বিশ্ব পরিবারের সদস্য৷ এই সামূহিক ভাবনা নিয়ে বিশ্বের সবাইকে পরমপুরুষের অভিপ্রকাশ হিসেবে ভেবে---সেবার ভাবনা নিয়ে---সবাইকে সঙ্গে করে নিয়ে কাজ করাই সম-সমাজতত্ত্বের মূল সুর৷ এই প্রেরণার উৎসভূমি আবার ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি৷ এটাই প্রকৃত ধর্মের মূল কথা৷
আজ যে তথাকথিত ধর্মের নামে হানাহানি, বিদ্বেষ, অপর ধর্মমতের মানুষকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করে নিজ ধর্মমতে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার ভাবনা, যা বিশ্বজুড়ে বর্তমানে এক ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করেছে, এ সবের সঙ্গে প্রকৃতপক্ষে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই৷ এগুলো ডগ্মা বা ভাবজড়তা৷
এই ভাবজড়তা নিছক ভাবাবেগের বা সেণ্টিমেণ্টের দ্বারা পরিচালিত হয়৷ এখানে কোনও যুক্তি মানা হয় না৷ এই ভাব জড়তা কখনও কোন বিশেষ এক স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে৷ যাকে বলা হয় জিও সেণ্টিমেণ্ট৷ বা ভৌম ভাবাবেগ৷ কখনও বা এক গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়কে নিয়ে বিশেষ এক সেণ্টিমেণ্ট গড়ে ওঠে যাকে বলা হয় সোসিও ‘সেণ্টিমেণ্ট৷’ এই সেণ্টিমেণ্ট যখন প্রবল হয়, অন্য জায়গায় মানুষের ওপর বা অন্য গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর অন্যায় শোষণ বা অত্যাচার করতে পিছপা হয় না, এক জনগোষ্ঠী অপর জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার কেড়ে নিয়ে তাদের ক্রীতদাসের মত বানাতে চায়৷
কখনও বা মানুষ তথাকথিত উদারতা নিয়ে বলে আমরা সমস্ত মানুষের জন্য কাজ করব, তারা নিজেদের মানবতাবাদী বলে গর্ব করে কিন্তু একটু গভীর বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায় তাদের এই চিন্তার গোড়াতেও গলদ আছে৷ কারর মুখে মানবতার কথা বললেও ভেতরে ভেতরে নিজের বা নিজ জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা ভেবে কাজ করে৷ মুখে বিশ্বশান্তির কথা বললেও নিজের কাছে গোলাবারুদ মজুদ রাখে৷ আজকে হয়তো যে সেবা করছে কিন্তু এর পেছনে বড় স্বার্থভাবনা কাজ করছে৷ তাঁকে আমার অধীনে রাখা, যেমন রাজনৈতিক নেতা কোনও এলাকায় সেবা কার্য করছে৷ ভেতরে বাসনা---আগামী নির্বাচনে ওরা আমাকে যেন ভোট দেয়৷ এ ধরণের স্বার্থ ভাবনার দ্বারা এরা তাড়িত৷
আর দ্বিতীয় কথা হ’ল যেহেতু বিশ্বের সবাই পরমপুরুষের সৃষ্টি তাই এই বিশ্বে মানুষের যেমন বাঁচার অধিকার আছে, পশুপক্ষী, তরুলতারও বাঁচার অধিকার আছে৷ পশুপক্ষী, গাছপালা ধবংস করে তাদের বাঁচার অধিকারকে অমান্য করা যুক্তিহীন৷ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচতে হবে৷‘Live and let live’ ---নিজে বাঁচো আর অন্যকে বাঁচতে দাও৷
সমস্ত মানুষকে যেমন ভালবাসব, তেমনি পশুপক্ষী, তরুলতাকেও ভালবাসব৷ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে তাঁদের জীবনের সুরক্ষার ব্যবস্থা করাও মানুষের কর্তব্য৷ এটাই নব্যমানবতাবাদ৷ এই নব্যমানবতাবাদে প্রতিষ্ঠিত হবার একটাই পথ --- মানব ধর্মের সাধনা৷
আজ যেখানে ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী, নিত্য নিঠুর দ্বন্দ্ব’ সেখানে এই নব্যমানবতাবাদই শতধাবিচ্ছিন্ন হিংসার দেশে মানুষের শেষ আশ্রয়৷
- Log in to post comments