গত ২৬শে নভেম্বর সংসদের সেন্ট্রাল হলে সংবিধান দিবস পালিত হয়৷ ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নবেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ভারতের সংবিধান পরিষদ কর্তৃক আমাদের এই সংবিধান গৃহীত হয়েছিল৷ আর ১৯৫০ সালের ২৬শে জানুয়ারী এই সংবিধানকে কার্যকরী করা হয়েছিল৷ তাই প্রতিবছর ২৬ শে নভেম্বর দিনটিকে আমাদের দেশে সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়৷ এদিন সংসদের সেন্ট্রাল হলে সংবিধান দিবস পালন উপলক্ষ্যে প্রদত্ত ভাষণে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ বলেন, আমাদের সকলের উচিত, বিশেষ করে বিভিন্ন সাংবিধানিক পদে যারা রয়েছেন, জনপ্রতিনিধি ও সাধারণ নাগরিক সকলেরই উচিত সংবিধানের নৈতিকতার দিকটা মেনে চলা৷
বস্তুত ঃ নৈতিকতাই একটা সমাজের, দেশের রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি৷ দেশের একজন নাগরিকেরও চরিত্রের মূল ভিত্তি হল নৈতিকতা৷ একথা দেশের প্রতিটি নেতা-নেত্রী ও বিশিষ্ট জন স্বীকারও করেন৷
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বিশেষ করে রাষ্ট্রের সংবিধানের হর্তাকর্তারাও প্রায়শই কার্যক্ষেত্রে এই নৈতিকতাকে পদদলিত করেন৷ প্রধানমন্ত্রীও কথায় কথায় স্বচ্ছতার কথা বলেন, কিন্তু তাঁর সরকর এই নীতি মেনে চলেন কি?
বহুদূরে যাবনা, এই যে মহারাষ্ট্রের সরকার গড়া নিয়ে জমজমাট নাটক হয়ে গেল, এতে নৈতিকতাকে বিন্দুমাত্র মূল্য দেওয়া হয়েছিল কি?
প্রায় একমাস আগে মহারাষ্ট্রে বিধানসভার নির্বাচন হ’ল৷ তাতে বিজেপি ও শিবসেনা জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল৷ কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর গদী দখল করবেন--- বিজেপির দেবেন্দ্র ফডনবীশ না শিবসেনার উদ্ধব ঠাকরে---সেই দ্বন্দ্বের নিরসন হ’ল না৷ পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, এতে আন্তরিকভাবে জনসেবার চেয়ে গদী দখলকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্তে না পৌঁছানোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ দল বিজেপি’র থেকে এককভাবে সরকার গড়তে অপারগ বলে রাজ্যপালকে জানিয়ে দেওয়া হ’ল৷ সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যপালের সুপারিশক্রমে মহারাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি হ’ল৷
এইবার শুরু হ’ল নূতন নাটক৷ জোট চিত্র উল্টে গেল৷ শিবাসেনা বিজেপি’র হাত ছেড়ে এন.আর.সি (ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টি) ও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করল৷ অনেক আলাপ আলোচনার পর ২২শে নবেম্বর রাত ৮টায় কংগ্রেস -শিবসেনা-এন.সি’র বৈঠকের শেষে এন.সি.পি (ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির নেতা শরদ পাওয়ার সাংবাদিকদের জানালেন তারা একজোটে সরকার গড়তে প্রস্তুত৷ পরদিন (২৩শে) সাংবাদিক বৈঠক করে’ তিন পক্ষ তাঁদের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানাবে৷ রাত ১০ টায় শিবসেনার পক্ষ থেকে জানানো হয়, নোতুন সরকারে উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন৷ সবাই রাজী৷ কিন্তু ২২ তারিখে রাত ৮টায় তিন পার্টির বিধায়কের মিলিত বৈঠকের (যে বৈঠকে এন.সি.পি প্রধানের ভ্রাতুষ্পুত্র অজিত পাওয়ারও ছিলেন) কয়েকঘন্টা পরে ওই রাতেই এন.সি.পি’র নেতা অজিত পাওয়ারের সঙ্গে গোপনে বিজেপি নেতার সঙ্গে জোটের চূড়ান্ত চুক্তি হয়ে যায়৷ অজিত পাওয়ার জানান, এন.সি.পির অধিকাংশ বিধায়ক তাঁর সঙ্গে আছেন, তাই সংখ্যাগরিষ্ঠততা পেতে মোটেই অসুবিধা হবে না৷ ‘বিজেপি’র দেবেন্দ্র ফড়নবীশ তাঁর দলের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন, শিবসেনা , কংগ্রেস ও এন.সিপি’ সরকার গড়ার দাবী জানানোর আগেই অজিত পাওয়ারকে সঙ্গে নিয়ে তাঁরা সরকার গড়ে ফেলবেন৷ রাতের মধ্যেই কাজ সেরে ফেলতে হবে৷ তাই গভীর রাতেই বিজেপি’র পক্ষ থেকে রাজ্যপালের কাছে তারা সরকার গড়ার সিদ্ধান্তের কথা জানায়৷ গভীর রাতেই প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহারের ব্যবস্থা পাকা করেন৷ তারপর ভোর ৫.৪৭ এই রাষ্ট্রপতি শাসন প্রত্যাহার করা হয়৷ আর ৭.৫০ রাজ্যপাল বি.এস কোশিয়ারি মহারাষ্ট্রের নূতন মন্ত্রিসভার শপথ পাঠ অনুষ্ঠান শুরু করেন৷ সকাল ৮-১০ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিজেপি’র দেবেন্দ্র ফড়নবীশ ও উপমুখ্যমন্ত্রীরূপে এন.সি.পি’র অজিত পাওয়ারের শপথ গ্রহণ সম্পন্ন করেন৷ ৮-৪০ দিল্লি থেকে প্রধান মন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মহারাষ্ট্রে নূতন মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে দেবেন্দ্র ফড়নবীশকে ও উপমূখ্যমন্ত্রীরূপে অজিত পাওয়ারকে শুভেচ্ছা বার্র্ত প্রেরণ করেন৷ মহারাষ্ট্রে নূতন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়ে গেল শিবসেনা, কংগ্রেস বা এন.আর.সি.পি’ প্রধান শরদ পাওয়ার কেউ ঘুর্ণাক্ষরেও জানতেই পারল না৷ সাংবাদিকরাও জানতে পারল না৷ নূতন সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে কোনো বিশিষ্ট জনেরাও উপস্থিত ছিলেন না৷ সবকিছু একান্ত গোপনে সম্পন্ন হ’ল৷
পরদিন শিবসেনা ও কংগ্রেসের নেতারা বা এন সিপির শরদ পাওয়ারও যখন সব খবর পেলেন তখন নূতন সরকার তৈরী হয়ে গেছে৷ শরদ পাওয়ার দাবী করলেন অজিত পাওয়ারের সঙ্গে বড় জোর ১০-১২ জন বিধায়ক থাকতে পাবে, কিন্তু বাকি সবাই শরদ পাওয়ারের সঙ্গে আছেন৷ অজিতের সিদ্ধান্ত তার ব্যষ্টিগত সিদ্ধান্ত, এন.সি.পির সিদ্ধান্ত নয়৷ এর পর শিবসেনা, কংগ্রেস ও এন.সি.পি’র শরদ পাওয়ারের পক্ষ থেকে রাজ্যপালের ভূমিকা ও অসাংবিধানিকভাবে নূতন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে নালিশ করেন৷
সুপ্রিম কোর্ট ২৬ তারিখে রায় দেন, বেশিদিন সময় দেওয়া যাবে না, ২৭ তারিখ (বুধবার) বিকেল ৫টার মধ্যেই ফড়ণবীশকে বিধানসভায় তাঁর সরকারে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণ করতে হবে৷ অজিত পাওয়ার তাঁর সঙ্গে এন.সিপি’র প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিধায়কদের না পেয়ে ও শরদ পাওয়ারের চাপের কাছে মাথা নত করে অবশেষে উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করলেন ৷ তখন বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র ফড়ণবীশ আস্থা বোটে পরাজয় অবশ্যম্ভাবী জেনে অবিলম্বে পদত্যাগ করলেন৷ ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরে এল৷ ভাইপো অজিত পাওয়ার আবার শরদ পাওয়ারের ছত্রছায়ায় ফিরে গেলেন৷ বিজেপি সরকার উল্টে গেল ৩দিনের মধ্যেই৷ এরপর যথাবিধি শিবসেনা , কংগ্রেস ও এন.সি.পি. নূতন জোট সরকার গঠনে অগ্রণী হয় ও শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের নেতৃত্বে নূতন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে৷ এখানে লক্ষণীয়, আমাদের দেশের জনপ্রতিনিধিরা কীভাবে সংবিধানের দোহাই দিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করছেন , কীভাবে নৈতিকতাকে পদদলিত করে চলেছেন, তা এখানে পরিষ্কারভাবে প্রকট হয়ে উঠেছে৷ এর মাঝখানে আবার একটা নাটক হয়ে গেল৷ এন.সি.পি’র অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে ৭০ হাজার কোটি টাকার মোট ২০ টি দুর্নীতির মামলা ছিল৷ সেই অজিত পাওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী করে বিজেপি’র দেবেন্দ্র ফড়নবীশ দ্বিতীয় দফায় ৩দিনের জন্যে মুখ্যমন্ত্রীর গদি দখলের সুযোগ পেলেন৷ আর তার পুরষ্কাররূপে মুখ্যমন্ত্রী অজিত পাওয়ারের বিরুদ্ধে সেচ দফতরের ৯টি মামলা বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন৷ এটা কি স্বচ্ছ রাজনীতির দৃষ্টান্ত? একটু ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বর্তমানে রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের সর্বত্রই এইভাবে দুর্নীতির রাজত্ব চলছে৷ এই নীতিহীন রাজনীতির আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন৷
- Log in to post comments