ও কী করে এসেছিল

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

‘ইহ’ মানে ‘এই জগতে’৷ মনে রাখা দরকার ‘অত্র’ আর ‘ইহ’ এক জিনিস নয়৷ ‘অত্র’ মানে এখানে–এই স্থানে আর ‘ইহ’ ব্যবহূত হয় অনেক ব্যাপকার্থে......‘এই লোকে’/‘এই জগতে’৷ ‘ইহ’‘ঠক্’ প্রত্যয় করে আমরা পাচ্ছি ‘ঐহিক’ শব্দটি৷ তার বিপরীত শব্দ হচ্ছে ‘পরত্র’ থেকে ‘পারত্রিক’ ‘ইহলৌকিক’–বিপরীত শব্দ ‘পারলৌকিক’৷ ‘ইহলোক’–বিপরীত শব্দ ‘পরলোক’৷ ‘ইহ তিষ্ঠ’ না বলে ‘অত্র তিষ্ঠ’ বলা ৰেশী সঙ্গত হবে৷ ‘ইহ তিষ্ঠ’ মানে ‘এই জগতে থাকো’৷ আর ‘অত্র তিষ্ঠ’ মানে  ‘এইখানটিতে থাকো’৷ সুপ্রাচীনকাল থেকেই ‘ইহ’ শব্দটি অব্যয় রূপে ব্যবহূত হয়ে এসেছে৷

ইহলোক আর পরলোকের মধ্যে অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত থেকে যায় এক সূক্ষ্ম স্বর্ণরেখা৷

সে অনেক দিন হয়ে গেল৷ তখন দিল্লীতে নিজের ৰাড়ী ছিল না৷ থাকতুম কখনো হোটেলে, কখনো ভাড়া ৰাড়ীতে৷ সেবার হোটেলেই ছিলুম৷ সান্ধ্য–ভ্রমণ সেরে হোটেলে ফিরলুম রাত্রি প্রায় সাড়ে আটটায়৷ ৰাথরুমে গিয়ে ৰেসিনে হাত–মুখ ধুচ্ছি, হঠাৎ পেছন দিক থেকে শুনলুম আগেকার সুপরিচিত মিষ্টি আওয়াজ–‘কেমন আছো?’ ভাবলুম–এ কী এ যে আমার ছোটবেলাকার অতিপরিচিত দুলু পালিতের আওয়াজ দুলু একাধারে আমার ঘনিষ্ঠ ৰন্ধু, আবার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ও৷ দুলুর বাড়ী ছিল মগরার কাছে......অভিজাত পরিবারের ছেলে৷ দুলু পালিত, ব্রজগোপাল সান্ন্যাল ও আমার মধ্যে ছিল নিৰিড় ৰন্ধুত্ব৷ দুলু পালিত ও ব্রজ সান্ন্যাল ছিল অত্যন্ত রূপবান৷ ওদের মনের সৌন্দর্য ছিল আরও ৰেশী৷ পরোপকার ছিল তাদের সহজাত সংস্কার৷ কিন্তু এখানে এই হোটেলের ৰাথরুমে সেই দুলুর আওয়াজ কোত্থেকে এল কী করেই বা এল আমি স্বপ্ণও দেখছি না, সুস্থ শরীরে, সুস্থ মস্তিষ্কে ৰেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত–মুখ ধুচ্ছি–এ তো শোনার ভুল হতে পারে না, ভাবার ভুলও হতে পারে না

দুলু এবার একটু অভিমানের সঙ্গে বললে–‘‘তুমি কি আমার ওপর রাগ করেছো? আমার দিকে তাকাচ্ছো না কেন?’’

হ্যাঁ, ৰলে রাখি, দুলু আমায় বড্ড ৰেশী ভালৰাসত৷ সে  আমাকে  ছোটবেলায় কয়েকবারই ৰলেছিল–যেমন কৃষ্ণলীলার সুদামা–কৃষ্ণের সম্ৰন্ধ তেমনই আমাদের সম্ৰন্ধ৷ সুদামা কৃষ্ণকে বড্ড ভালবাসত৷ কৃষ্ণও সুদামাকে খুব ভালবাসত৷ ও আমাকে বলত–‘‘দেখ, আমরা একে অন্যকে এত ৰেশী ভালৰাসব যে কৃষ্ণ–সুদামাকেও হার মানিয়ে দোৰ৷’’

আমি ৰলেছিলুম–‘‘আমি তেমন পারৰ কিন্তু তুমি কি তেমন পারৰে?’’

ও ৰলেছিল–‘‘নিশ্চয় পারৰ, দেখে নিও’’

আজ সেই দুলুর আওয়াজ পেলুম৷ আর সে অভিমানের সুরে ৰলছে–‘‘আমি তার দিকে তাকাচ্ছি না কেন’’

আওয়াজ আসছিল যেন আমার পেছনের দিক থেকে৷ পেছনের দিকে দেওয়ালে তাকিয়ে দেখি, দেওয়ালের গায়ে দুলু আলোকোজ্জ্বল পূর্ণাবয়বে দাঁড়িয়ে রয়েছে, আর আমার দিকে চেয়ে আনন্দে হাসছে৷ আমি তাকাতেই  সে আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠে ৰললে–‘‘কেমন আছো? তোমার জন্যে ক’দিন হ’ল আমার মনটা ছটফট করছিল৷ এখন তোমাকে কাছে পেয়ে ৰাঁচলুম৷’’

আমি ৰললুম–‘‘আমি ৰেশ ভালই আছি৷ এৰার কলকাতায় গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করৰ৷’’

ও ৰললে–‘‘নিশ্চয়, নিশ্চয়৷’’ তারপর একটুখানি পরে ৰললে–‘‘আমাকে তোমার পছন্দমত কোনো কাজে লাগিয়ে নাও৷ এতে আমার  সুৰিধে হৰে এই যে, সৰ সময় তোমার কাছে থাকা যাৰে৷ যদি কখনো কাছে না–ও থাকা যায় অর্থাৎ কাজ নিয়ে বাইরে কোথাও যেতেও হয় তাহলেও মনে এই পরিতৃপ্তি থাকৰে যে তোমার কাজ করতেই বাইরে যাচ্ছি৷’’

আমি ৰললুম–‘‘তেমনটিই হৰে৷ আমি ক’দিনের মধ্যেই কলকাতায় ফিরছি৷’’

এমন সময় টেলিফোনের আহ্বান আসায় শোবার ঘরে চলে এলুম৷ ফোন ধরতেই ওদিক থেকে আওয়াজ এল–‘‘আমি ব্রজগোপাল সান্ন্যাল কলকাতা থেকে ৰলছি৷’’

ব্রজগোপাল আমার ছোটৰেলাকার ৰন্ধু৷ ও ভালভাবেই জানত, দুলু পালিত আমাকে ছাড়া থাকতেই পারে না....কতকটা যেন ত্ব–এর পাশে হু–এর মত৷

আমি ব্রজকে ৰললুম–‘‘কী ৰলছো?’’

ব্রজ ৰললে–‘‘আমাদের ছোটৰেলাকার ৰন্ধু দুলু পালিত ক’দিন ধরেই বড্ড ৰেশী অসুস্থ৷ আমি এখন ওর ৰাড়ী থেকেই ফোন করছি৷’’

আমি ৰললুম–‘‘কী হয়েছে?’’

ব্রজ ৰললে–‘‘কী হয়েছে ৰোঝা যাচ্ছে না৷ নাড়ীর গতি স্বাভাবিক, কোনো রোগ–ভোগ নেই, জ্বর–জ্বালাও নেই৷ ডাক্তার ৰলছে, কোনো রোগই ধরা পড়ছে না’’৷

আমি ৰললুম–‘‘তৰে কী হয়েছে?’’

ব্রজ ৰললে–‘‘ও কেবল শুয়ে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে আর তোমার কথা ৰলছে৷ ৰলছে কতদিন দেখা হয়নি, আবার কৰে দেখা হৰে কে জানে পরিচিত কাউকে দেখলেই তাকে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছে, আর ৰলছে, কৰে দেখা হবে কে জানে’’

আমি ব্রজকে জানালুম যে, সব কাজকর্ম ফেলে রেখে আমি কালকের প্লেনেই  দিল্লী থেকে কলকাতা পৌঁছোচ্ছি৷ আর বিমান বন্দর থেকে সোজা ওর বাড়ীতেই যাৰ৷

ব্রজ আশ্বস্ত হয়ে ফোন ছেড়ে দিল৷ আমি আবার ৰাথরুমে গেলুম দেওয়ালের দুলুর সঙ্গে আরও কথা ৰলতে–সেই কোটপ্যান্টপরা আলোকোজ্জ্বল দুলু৷ ৰললুম–‘‘তারপরে ৰলো কী খৰর৷ এখন তাহলে ভালই আছো৷’’

ও বললে–‘‘ভাল ৰলে ভাল, খুব ভাল৷ তোমাকে কাছে পেয়ে কত যে ভাল লাগছে কী ৰলৰ৷ মনে হচ্ছে এমন ভালর মধ্যে মরাও ভাল৷’’ সেই যে কবি ৰলেছেন না–

‘‘এমন চাঁদের আলো মরি যদি সেও ভালো

 সে মরণ স্বর্গসমান৷’’

আমি ৰললুম–‘‘মরণের কথা–টথা ৰলবে না,

তাহলে আমি ভীষণ রেগে যাৰ৷ তোমাকে ৰকাঝকা করৰ৷ আমার মেজাজটা তো তুমি ভালভাৰেই জানো৷’’

ও ৰললে–‘‘তোমাকে আমি রাগতে দোৰ না, মরণের কথা ৰলৰ না৷’’

আমি ৰাথরুম থেকে হাত–মুখ ধুয়ে ফিরছি৷ ঘড়িতে তখন ন’টার ঢ়ং ঢ়ং আওয়াজ শুনলুম৷ আর দুলুর দিকে তাকাতেই দেখি, দুলুর চিত্র শাদা দেওয়ালে মিশে গেল৷ আমার খাবার সময় হয়েছে দেখেই ৰোধ হয় ও চলে গেল৷

শোবার ঘরে এলুম৷ কয়েক মিনিট পরে কলকাতা থেকে ফোন এল৷ আবার সেই ব্রজগোপাল সান্ন্যালের কন্ঠস্বর৷ ও ৰললে–‘‘তোমাকে অত্যন্ত দুঃসংবাদ জানাচ্ছি, আমাদের দুলু এইমাত্র ঠিক ন’টার সময় আমাদের ছেড়ে অন্যলোকে চলে গেল৷ ৰুঝলে, আমার সৰ কিছুই গোলমেলে ঠেকছে৷ ৰুঝতে পারছি না কোন্টা ইহলোক, কোন্টা পরলোক৷