এবার আমি মহাভারতের যুগের চিকিৎসা–পদ্ধতি সম্বন্ধে কিছু বলব৷ আয়ুর্বেদের মতে যখনই শরীরে বায়ু কিংবা পিত্ত কিংবা কফের বৃদ্ধি বা স্বল্পতা ঘটে তখনই দেহের সাম্যাবস্থা নষ্ট হয়ে রোগ দেখা দেয়৷ এই সাম্যাবস্থা পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্যেই ওষুধের প্রয়োজন হয়৷ বায়ুর স্বল্পতা ঘটলে ওষুধ দিয়ে তাকে বাড়াতে হয়৷ পিত্তের বেলায়ও একই নিয়ম৷ আয়ুর্বেদের এটাই মত৷ একই পর্যায়ভুক্ত ইউনানি চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী চারটা ধাতুর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়–বায়ু, পিত্ত, কফ, ও রক্ত৷ এই দু’য়ের মধ্যে তফাৎটা হ’ল এই যে ইউনানি পদ্ধতিতে একটা অধিক ধাতুকে (রক্ত) ধরে নেওয়া হয়েছে৷ বাকি তিনটি ধাতু উভয় পদ্ধতিতেই সমভাবে গুরুত্বপূর্ণ৷ উভয় পদ্ধতিতেই স্থূল ওষুধের প্রয়োগ হয়ে থাকে ও শল্য চিকিৎসার (Surgery) গুরুত্ব সেখানে নামমাত্র৷ বিশুদ্ধ আয়ুর্বেদীয় পদ্ধতিতে শল্য চিকিৎসার কোন স্থান নেই৷ কিন্তু ভারতের বৈদ্যকশাস্ত্রে (যাকে আয়ুর্বেদীয় শাস্ত্রের অঙ্গীভূত করা হয়েছে) শল্য চিকিৎসার বিশেষ স্থান ছিল৷
এছাড়াও বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ হ্যানিম্যান কর্ত্তৃক আরেক প্রকারের চিকিৎসা–পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে–হোমিওপ্যাথি৷ আয়ুর্বেদ ও ইউনানি পদ্ধতি অনুযায়ী রোগ নিরাময়ের জন্য ওষুধের প্রয়োগ করা হয় না৷ ওষুধ প্রয়োগের উদ্দেশ্য হ’ল দেহের পূর্বোক্ত ধাতুগুলোর মধ্যে সমতা ফিরিয়ে আনা৷ হোমিওপ্যাথি পদ্ধতিতেও (যার মূল নীতি হ’ল ‘শমঃ শমং শময়তি’ (like cures like)–রোগের চিকিৎসা না করে রোগের লক্ষণের চিকিৎসা করা হয়৷ উদরাময় (Diarrhoea) বা ম্যালেরিয়া রোগ যাই হোক না কেন, আগে রোগ–লক্ষণের চিকিৎসা হবে, রোগের নয়৷
অধিকন্তু ওষুধের প্রয়োগ হয়ে থাকে খুব সূক্ষ্মভাবে৷ বলা হয় যে সূক্ষ্ম জিনিস স্থূল জিনিসকে প্রত্যাঘাত করে, কাজেই স্থূল রোগ সারাবার জন্য সূক্ষ্ম ওষুধ প্রয়োগ করা হয়ে থাকে৷ ওষুধ যত সূক্ষ্ম হবে, স্থূল রোগ সারাবার ক্ষমতা তার তত অধিক হবে৷ এ্যালোপ্যাথি পদ্ধতি সরাসরি রোগ সারাবার উপায়৷ একটা বিশেষ রোগ সারাবার জন্য একটা বিশেষ ওষুধেরই ব্যবহার হয়ে থাকে৷
তৎকালীন ভারতবর্ষে বৈদ্যক শাস্ত্রের সঙ্গে আয়ুর্বেদের একটা মিশ্রণ ঘটেছিল৷ একটা অদ্ভুত ব্যাপার ছিল এই যে হোমিওপ্যাথির সঙ্গে বিষ–চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল ও সেই সঙ্গে লোকেরা ‘শমঃ শমং শময়তি’ বিদ্যার সঙ্গেও অবহিত ছিলেন৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ, কৌরবেরা ভীমের ওপর বিষ প্রয়োগ করল ও জনসাধারণকে ঘোষণা করে জানিয়ে দিল যে ভীমের মৃত্যু হয়েছে৷ কিন্তু আয়ুর্বেদাচার্যগণ ভীমের শরীরে বিষমিশ্রিত ইন্জেক্শন দিয়ে তাকে সারিয়ে তুললেন৷ এতেই প্রমাণিত হয় যে সে যুগে বিষ চিকিৎসা সম্বন্ধে লোকের সম্যক্ জ্ঞান ছিল ও ‘শমঃ শমং শময়তি’ বিদ্যা অর্থাৎ হোমিওপ্যাথি সম্বন্ধেও প্রাথমিক জ্ঞান ছিল৷ মহাত্মা হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানের উদ্ভাবক নন বরং বলা যেতে পারে, তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই শাখাটাকে সমৃদ্ধ ও জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন৷
ভারতবর্ষে বিষ–চিকিৎসার প্রচলন বরাবরই ছিল ও মহাভারতেই প্রথম এই বিদ্যার উল্লেখ দেখতে পাওয়া যায়৷ পরবর্ত্তীকালে আর্যরা বিষ চিকিৎসাকে খুব সুনজরে দেখতেন না৷ বরং অনার্যদের (ভারতের স্থানীয় অধিবাসী) মধ্যে আর দক্ষিণ ভারতে, বিশেষ করে মালাবার অঞ্চলে এই বিদ্যার ব্যাপক প্রচলন ছিল৷ এই সমস্ত অঞ্চলে জনশ্রুতি এই যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বিষ চিকিৎসার ও ভগবান সদাশিব বৈদ্যক শাস্ত্রের প্রথম উদ্ভাবক৷ বস্তুতঃ ভগবান সদাশিবের আগে থেকেই আর্যরা আয়ুর্বেদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন৷ সদাশিবই আয়ুর্বেদের সঙ্গে বৈদ্যক শাস্ত্রের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন৷ মহাভারতের যুগে বিষ–চিকিৎসার খুবই সমাদর ছিল৷ জনসাধারণ এই বিষয়ে চর্চা করতেন, নানান্ ধরনের বিষের প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন৷ যেমন সাপের বিষ, মাকড়সার বিষ, বৃশ্চিক বিষ ইত্যাদি৷ কালক্রমে এই বিদ্যার প্রতি উপেক্ষা শুরু হয়ে গেল৷ শেষের দিকে কোচিনের রাজপরিবারে এই বিদ্যার চর্চা কিছুটা হয়েছিল৷ বর্ত্তমানে বিষচিকিৎসা প্রায় উপেক্ষিতই বলা চলে, কিন্তু যদি এই বিদ্যাটির চর্চা শুরু হয়, তবে চিকিৎসা জগতে এক নতুন বিজ্ঞানের সংযোগ হবে৷ যেমন, অর্কপত্র (আকন্দপত্র)৷ সমাধিক্ষেত্রে প্রায়শই অর্কপত্র দেখা যায়৷ অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক যে কোন উপায়েই অর্কপত্রের ব্যবহার হলে চোখ খারাপ হয়ে যাবে৷ কিন্তু মহাভারতের যুগে এমনি একটি পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছিল যে সেই ধরনের বস্তু যদি খুবই সূক্ষ্ম ভাবে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা হয় তাহলে সেই বস্তুই নানাবিধ চক্ষূরোগ সারাতে পারবে৷ বিষে বিষক্ষয় হয়, এই পদ্ধতিও লোকের জানা ছিল৷
সার্জারী বা শল্যচিকিৎসাকে এ্যালোপ্যাথির অংশ হিসেবে গণ্য করা হয় কিন্তু এটা ঠিক নয়, কারণ শল্যচিকিৎসা আসলে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রের (বৈদ্যক শাস্ত্রের) অংশ, ভগবান সদাশিবের আমল থেকে এ পর্যন্ত শল্যবিদ্যার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে৷ বৈদ্যক শাস্ত্রে উল্লিখিত আছে, ছাত্ররা কীভাবে মৃতদেহ নিয়ে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করবেন, মানব দেহের বাহ্যিক কাঠামো, শরীরকে কীভাবে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়, দেহের পচনশীলতা কীভাবে শুরু হয় ইত্যাদি ইত্যাদি৷ বৈদ্যক শাস্ত্রে এ সবের উল্লেখ আছে৷ এতে প্রমাণিত হয় যে সে যুগে শল্যচিকিৎসার মান খুব উন্নত ছিল৷ সে যুগে শল্যচিকিৎসা সম্বন্ধে একটা খুবই চিত্তাকর্ষক গল্প প্রচলিত আছে৷ কৃষ্ণের এক পিসতুতো দাদার নাম ছিল জরাসন্ধ৷ জরাসন্ধ ছিলেন মগধের রাজা ও তাঁর রাজধানী ছিল রাজগীর৷ জন্মের সময় জরাসন্ধকে অস্ত্রোপচারের দ্বারা মাতৃগর্ভ থেকে বের করা হয়েছিল৷ লোকেরা সেই ক্ষত–বিক্ষত, কুৎসিত নবজাতককে শ্মশান ভূমিতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল৷ সে যুগে এক প্রখ্যাত অনার্য মহিলা ডাক্তার ছিলেন যাঁর নাম ছিল জরা রাক্ষসী৷ এই মহিলাটি উপযুক্ত শল্যচিকিৎসার দ্বারা ক্ষত–বিক্ষত শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলেছিলেন৷ যেহেতু জরা রাক্ষসী শিশুর অঙ্গ–প্রত্যঙ্গকে সেলাই করে জুড়ে দিয়েছিলেন তাই শিশুটির নাম রাখা হয়েছিল জরাসন্ধ৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে, মহাভারতের যুগের লোকেরা শল্যচিকিৎসা সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন৷ এ ধরনের ভাবনা মোটেই সমীচীন নয় যে এ দেশের সব কিছুই ভারতের বাইরে থেকে এসেছে৷ আমি আগেই বলেছি যে ভাস্করাচার্যই প্রথম আবিষ্কার করেন, পৃথিবীটা গোল৷ কোপারনিকাস এ তত্ত্বের প্রথম উদ্ভাবক নন৷ পৃথিবীটা যে ঘুরছে এই তত্ত্বেরও প্রথম আবিষ্কারক হলেন ভাস্ক্রাচার্য–গ্যালিলিও নন৷ আবার মাধ্যাকর্ষণ সূত্রেরও প্রথম প্রবক্তা হলেন ভাস্করাচার্য–নিউটন নন৷ আমরা এসব বিষয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ভুল শিক্ষা দিয়ে থাকি৷
হোমিওপ্যাথি বিজ্ঞানও ভারতবর্ষেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছিল৷ শল্য চিকিৎসা তো প্রাচীন ভারতেই সর্বপ্রথম উদ্ভাবিত৷
ধরা যাক, দু’জন লোক আছে৷ একজনের মন অন্যের তুলনায় অধিকতর শক্তিশালী, সে ক্ষেত্রে অধিকতর ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন ব্যষ্টি অপর ব্যষ্টির কর্ম ও চিন্তা শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে৷ অধিকতর ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন মানুষ মনস্তাত্ত্বিক উপায়ে অথবা কৃত্রিম উপায়ে দুর্বল মনের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷ শক্তিশালী মনের প্রভাবের দরুণ নিয়ন্ত্রিত মন রোগের বিরুদ্ধে তার সমস্ত মানস শক্তিকে কাজে লাগায় ও নিজেকে রোগমুক্ত করে৷ সম্মোহনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে রোগ সারানোর এই পদ্ধতি প্রথম আবিষ্কার করেন ফ্রান্সের প্রখ্যাত ডঃ মেসমার আর তাঁরই নামানুসারে এই পদ্ধতির নামকরণ হয় ‘মেসমেরিজম্’৷ কিন্তু ডাঃ মেসমারের বহু আগে থেকেই ভারতীয়রা এই পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন৷ প্রাচীন ভারতে এই পদ্ধতি রাক্ষসীবিদ্যা নামে পরিচিত ছিল৷ ‘প্রাচীন ভারত’ বলতে বোঝাচ্ছি সে যুগের অনার্য ভারতবর্ষকে, ভারতের আদিম অধিবাসীদের ভারতবর্ষকে৷ প্রাচীন ভারতবর্ষে এক অনার্য মহিলা ডাক্তার ছিলেন–তাঁর নাম ছিল কর্কটী রাক্ষসী৷ এই রাক্ষসী মেসমেরিক পদ্ধতির জন্য বিশেষ পরিচিত ছিলেন৷ অবশ্য এই পদ্ধতিটা অন্য নামে পরিচিত হওয়া উচিত৷
তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, মহাভারতের যুগে প্রচলিত ছিল শল্য বিদ্যা, আয়ুর্বেদ, বৈদ্যকশাস্ত্র, বিষ–চিকিৎসা, হোমিওপ্যাথি এছাড়া জনসাধারণ রাক্ষসী বিদ্যা সম্বন্ধেও ওয়াকিবহাল ছিল৷ এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে সে যুগে চিকিৎসা বিদ্যা যথেষ্ট উন্নত মানের ছিল৷ এখন প্রশ্ণ উঠতে পারে, সে যুগের চিকিৎসাবিদ্যা যদি এতই উন্নত ছিল তাহলে পরবর্ত্তীকালে সেগুলো নষ্ট হ’ল কেন? তার উত্তরে বলব, পরবর্ত্তী যুগে অর্থাৎ বৌদ্ধ যুগের প্রথম ভাগে মৃতদেহ স্পর্শ করা, মৃতকের কঙ্কালের পরীক্ষা করা ততটা হীন কর্ম ক্ষলে গণ্য করা হত না৷ কিন্তু ক্ষুদ্ধের পর জনগণ ওই সব কর্মকে হেয় জ্ঞান করতে লাগল৷ মৃতদেহ স্পর্শ করাটা নীচ কাজ বলে গণ্য হতে থাকল৷ এতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত ক্ষতি হয়েছিল–বিশেষ করে শল্যবিদ্যার ক্ষেত্রে৷ ফলস্বরূপ, সমগ্র চিকিৎসা জগতেই একটা ব্যাপক বিপর্যয় দেখা দিল৷ ক্ষুদ্ধের মৃত্যুর ছ’/সাত শ’ বছর পর বৌদ্ধরা আবার এই চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গভীর ভাবে আলোচনা করতে শুরু করল ও চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি বিধান করতে চেষ্টা করল৷ কিন্তু বুদ্ধের পর এই চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতির জন্য আর যথোচিত প্রেরণা ও উৎসাহ মেলেনি বলে ধীরে ধীরে চিকিৎসাবিদ্যার দারুণ অধঃপতন ঘটল৷ অধিকন্তু বুদ্ধোত্তর যুগে ঠিক যে সময়টায় চিকিৎসাবিদ্যার উন্নতি সবেমাত্র শুরু হচ্ছে ঠিক তখনই ভারতের ওপর বৈদেশিক আক্রমণ শুরু হয়৷ ফলস্বরূপ, আয়ুর্বেদ, বৈদ্যকশাস্ত্র, বিষ–চিকিৎসা, শল্যবিদ্যা সব কিছুই অবহেলিত হয় ও ইউনানি (হেকিমী) পদ্ধতি ভারতীয় সমাজের বুকে শেকড় গাড়তে থাকে৷ হেকিমী পদ্ধতির বিশেষ