শাস্ত্রে বলা হয়েছে---
‘‘শ্রবণায়াপি বহুভির্র্যে ন লভ্যঃ শৃন্বন্তোহপি বহবো যং ন বিদূ্যঃ৷
আশ্চর্র্যে বক্তা কুশলোহস্য লব্ধা আশ্চর্র্যে জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্টঃ৷’’
মানুষের সমাজে কত লোকেরই না বাস৷ তাদের মধ্যে মুষ্টিমেয় মানুষই অধ্যাত্মজ্ঞান অর্জনের সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ আবার তাদের মধ্যে খুব কম শতাংশ মানুষই হাতে কলমে আধ্যাত্মিক শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়ে থাকেন৷ এর মূল কারণটা কী? কারণ হ’ল সাধনা বিজ্ঞান জিনিসটাই দুলর্ভ, আবার প্রকৃত অধ্যাত্মজিজ্ঞাসুর সংখ্যা আরও দুর্লভ আবার প্রকৃত গুরুর সংখ্যা আরও বেশী দুর্লভ৷
আমরা চাই আধ্যাত্মিক সাধনা অনুশীলন করার সুযোগ সকলেই পাক৷ আর আধ্যাত্মিক বিদ্যার্জনের, আধ্যাত্মিক সাধনায় আনন্দানুভূতি লাভের জন্যে যে নূ্যনতম যোগ্যতা তা কী?--- না, তা হ’ল একটা মানুষের শরীর৷ কেবল মানুষের শরীর পেলেই নূ্যনতম যোগ্যতা পেয়ে যায়৷ তার কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাক বা না থাক, কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠা থাক বা না থাক, তাকে মানুষের শরীর পেতেই হবে৷ যে মানুষটা মানবাধার পেয়েছে নূ্যনতমপক্ষে তার তিনটে গুণ থাকতে হবে৷ তাকে আধ্যাত্মিক সাধনা ও সাধনাজনিত আনন্দানুভুতি লাভের জন্যে প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ ও সেবার দ্বারা আধ্যাত্মিক বিদ্যালাভের জন্যে উৎসুক থাকতে হবে৷
‘প্রণিপাত’৷ প্র-নি-পত্-ঘঙ্ প্রত্যয় করে ‘প্রণিপাত’ শব্দটা নিষ্পন্ন হয়েছে৷ পরমপুরুষকে জানবার জন্যে একটা ঐকান্তিক ইচ্ছা, একটা ঐকান্তিক এষণা থাকতে হবে৷ আর সেজন্যে তাকে সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত থাকতে হবে৷ ‘প্রণিপাত’ মানে পূর্ণ আত্মসমর্পণ৷ এই পূর্ণ আত্মসমর্পণ ছাড়া কোনকিছুই হতে পারে না৷ মানবমনের যাবতীয় বৃত্তি কিন্তু সব সময়েই জড় বস্তুর দিকে ছুটে চলেছে৷ এই অবস্থায় সে পরমপুরুষের দিকে এগোবে কী করে? তাই জড় জগতের দিকে ধাবমান বৃত্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রিত করে পরমপুরুষের দিকে চালিয়ে দিতে হবে৷ একেই বলে প্রণিপাত৷
‘পরিপ্রশ্ণেন’৷ ‘পরিপ্রশ্ণ’ মানে বিশেষ প্রশ্ণ৷ প্রশ্ণ মানে জিজ্ঞাসা৷ সংস্কৃতে ‘পরি’ একটা উপসর্গ, আর মূল ধাতুটা হচ্ছে ‘প্রচ্ছ’৷ এখন ‘পরিপ্রশ্ণ’ ব্যাপারটা কী? তোমরা দেখে থাকবে, মানুষ কখনো কখনো কোন কিছু জানবার স্পৃহা নিয়েই প্রশ্ণ করে থাকে৷ আবার কখনও কখনও নেহাত অপরকে বোকা বানাবার জন্যেও প্রশ্ণ করে থাকে৷ প্রশ্ণের উত্তরটা হয়তো আগে থেকেই জানা আছে৷ তবু কেবল অন্যকে বোকা বানাবার জন্যে তুমি সেটা আবার জানতে চাইলে৷ অনেক সময় আবার মানুষ কিছু কিছু নিরর্থক প্রশ্ণও করে বসে এগুলো খামখেয়ালিপনা ছাড়া আর কি বলব ! এগুলো পরিপ্রশ্ণ নয়৷ পরিপ্রশ্ণের অর্থ একটাই--- উদ্দেশ্যেও একটাই ৷ আর তা হ’ল তুমি প্রকৃত উত্তরটা জানবার জন্যে প্রশ্ণটা করলে আর সেই উত্তরটা জেনে তুমি বাস্তব জীবনে কাজে লাগালে৷ উত্তরটা জেনে তুমি সেইমত কাজ করবে এটা জেনেই প্রশ্ণটা করলে৷ এটাই পরিপ্রশ্ণ৷ অধ্যাত্মসাধকের তাই সমস্ত প্রশ্ণই হবে পরিপ্রশ্ণ--- সাধারণ প্রশ্ণ নয়৷
‘সেবয়া’৷ ‘সেবয়া’ মানে সেবার দ্বারা৷ যখন তুমি পরমপুরুষের কাছ থেকে অধ্যাত্মবিজ্ঞান জানতে চাইলে (কেবল পরমপুরুষই অধ্যাত্মবিজ্ঞান জানেন) তখন তিনি যে মানবাধারে তোমাকে তা শিখিয়ে দিলেন সেই মানবাধারকে আমরা বলি ‘গুরু’৷ সত্যি বলতে কি, এই অধ্যাত্মবিদ্যা পরমপুরুষ ছাড়া আর কেউই জানেন না৷ তার তুমি যখন তাঁর কাছ থেকে কিছু জানতে চাইছ তখন তোমাকে তো সন্তুষ্ট করতেই হবে৷ আর তিনি সন্তুষ্ট হলেই তবে তোমার সমস্ত পরিপ্রশ্ণের উত্তর দেবেন--- তোমাকে তদনুযায়ী শিক্ষা দেবেন৷ তিনি তো লাভ ক্ষতির ব্যবসা করতে পারেন না! তাই তাকে খুশী করতে হবে, সন্তুষ্ট করতে হবে৷ আর তাঁকে খুশী করার একমাত্র উপায় হ’ল তাঁর সন্তান-সন্ততিদের সন্তুষ্ট করা৷ সমস্ত জীবজগৎই তাঁর সন্তান-সন্ততি৷ তিনি সব কিছুর স্রষ্টা৷ তাই তাঁকে সন্তুষ্ট করতে হ’লে তোমাকে তাঁর সন্তান-সন্ততিদের নিঃস্বার্থভাবে সেবা করতে হবে৷ সমস্ত সৃষ্ট জগৎকে এইভাবে নিঃস্বার্থ সেবা করাই হ’ল প্রকৃত সেবা৷ তোমরা নিশ্চয় জান, আমাদের আদান-প্রদান ব্যাপারটা সাধারণতঃ দু’ধরণের৷ তুমি কাউকে কিছু দিলে আর সেই সঙ্গে কিছু নিলে---এটা হ’ল বৈবসায়িক লেনদেন৷ কিছু ডলার দিলে, বিনিময়ে হয়তো কিছু পণ্যসামগ্রী পেলে৷ এই যে পারস্পরিক লেনদেন--- এটা হ’ল ব্যবসা৷ আর যখন আদান-প্রদানটা একতরফা হয় অর্থাৎ যখন তুমি কিছু দিলে কিন্তু বিনিময়ে কিছু নিলে না, একে বলে সেবা৷ সেবা হ’ল একতরফা৷
এটাকে আমরা আবার অন্যভাবেও ব্যাখা করতে পারি৷ মনে কর, কোন বৈবসায়িক লেনদেন চলছে৷ তোমাকে কিছু পেতে হবে৷ আর তুমি তার কাছ থেকে সবচেয়ে মূল্যবান বস্তুটা পেতে চাও, তাহলে তোমাকে সবচেয়ে বেশী দাম দিতে হবে৷ তা’ তুমি যদি সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু আধ্যাত্মিক বিদ্যা লাভ করতে চাও সেক্ষেত্রে তোমাকে নিজেকেই দিতে হবে--- টাকা পয়সা নয়৷
এই দু’টো জিনিসকেই বলব ‘সেবা’৷ যখন তোমার দেওয়াটা একতরফা, আর যখন তুমি তোমার সব কিছু দিয়ে অধ্যাত্মবিদ্যা বিদ্যা লাভ করছ, উভয়ক্ষেত্রেই এটা সেবা৷ তা তোমাকে অধ্যাত্মবিদ্যা অর্জন করতে হলে, আধ্যাত্মিক আনন্দানুভূতি পেতে হলে অবশ্যই তিনটে জিনিস করতে হবে৷ সেই তিনটে জিনিস হ’ল প্রণিপাত, পরিপ্রশ্ণ আর সেবা৷ এটাই হ’ল আধ্যাত্মিক সাধনায় সিদ্ধির পথ৷
২৪ অক্টোবর ১৯৭৮, পটনা