‘প্রাউট’ প্রতিষ্ঠায় মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের ‘সর্বাধিক উপযোগ’ প্রসঙ্গে

লেখক
সমরেন্দ্রনাথ ভৌমিক

‘প্রাউট’ চায়--- প্রগতিশীল সমাজ তন্ত্রের প্রতিষ্ঠা৷ মহান দার্শনিক  শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ‘প্রাউট’-এর সমাজ দর্শনের  মৌল সিদ্ধান্তগুলিকে ‘আনন্দসূত্রম’-এর পঞ্চম অধ্যায়ের শেষ পাঁচটি সূত্রে লিপিবদ্ধ ক’রে গিয়েছেন৷ এই পাঁচটি মৌল সিদ্ধান্ত হ’ল---

১)‘‘সমাজ দেশেন বিনা ধন সঞ্চয়ঃ অকর্তব্যঃ’’,২) ‘‘স্থূল  সূক্ষ্মকারণেষু চরমোপযোগঃ প্রকর্তব্যঃ বিচারসমর্থিতং বন্টনঞ্চ৷’’ ৩)‘‘ব্যষ্টি সমষ্টি শারীরমানসাধ্যাত্মিক সম্ভাবনায়াং চরমোহপযোগশ্চ৷’’ ৪)‘‘স্থূলসূক্ষ্মকারণোহপ্ সুসন্তুলিতাঃ বিধেয়াঃ৷’’ ৫)‘‘দেশ কাল পাত্রৈঃ উপযোগাঃ পরিবর্ত্তন্তে তে উপযোগাঃ প্রগতিশীলাঃ ভবেয়ুঃ৷’’

আজকের আলোচ্য বিষয় হ’ল--- দ্বিতীয় মৌল সিদ্ধান্তটির ‘সর্বাধিক উপযোগ’ প্রসঙ্গে মহাপ্রাজ্ঞ শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের ‘প্রাউট’ প্রতিষ্ঠা নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অভিমত৷

এখন, দ্বিতীয় মৌল সিদ্ধান্তটির অর্থ হ’ল--- ‘‘বিশ্বের যাবতীয় জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে ও যুক্তিসঙ্গত বন্টন করতে হবে৷’’

অর্থাৎ এই সূত্রটিকে শ্রীসরকার দুটি অংশে বিভক্ত করেছেন৷ এক অংশে বলেছেন---‘সর্বাধিক উপযোগের’ কথা, আর অন্য অংশে বলেছেন -‘যুক্তি সম্পন্ন বন্টনের’ কথা৷

আনন্দ সূত্রমের পঞ্চম অধ্যয়ের এই সিদ্ধান্তটির ভাবার্থে বলা হয়েছে--- স্থূল জগতে, সূক্ষ্ম জগতে ও কারণ জগতে যা কিছু সম্পদ নিহিত আছে তার উৎকর্ষ সাধন করতে হবে জীব কল্যাণে৷ ক্ষিতি-অপ্‌-তেজ-মরুৎ-ব্যোম-পঞ্চতত্ত্বের  যেখানে যা কিছু লুকোনো সম্পদ রয়েছে তা ষোল আনা সদ্ব্যবহারের প্রচেষ্টার মাধ্যমেই এর উৎকর্ষ সাধিত হবে৷ জল-স্থল-অন্তরীক্ষ তোলপাড় করে’ মানুষকে প্রয়োজনের উপাদান খুঁজে বের করে’ নিতে হবে---তৈরী করে’ নিতে হবে৷

মানুষের আহূত সম্পদ বিচার সম্মতভাবে  মানুষের মধ্যে বন্টন করে’ দিতে হবে, অর্থাৎ সর্বনিম্ন প্রয়োজন সবাইকার তো মিটাতে হবেই,অধিকন্তু গুণীর এবং বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ মানুষেরও প্রয়োজনের কথা মনে রাখতে হবে৷

অর্থাৎ এই সুত্রের প্রথমাংশে বলা হয়েছে, জাগতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক এই তিনস্তরেই সর্বাধিক উপযোগ নিতে হবে৷

সর্বাধিক উপযোগ প্রসঙ্গে শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার উপযোগ যাতে সর্বাধিক হয় তার জন্য ‘মাইক্রোবাইটাম তত্ত্ব’ দিয়েছেন---

‘‘মাইক্রোবাইটাম হ’ল জৈব জীবনের গূঢ় রহস্য৷ ভৌতিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক তিনটি স্তরেই ব্যাপক প্রগতির চাবিকাঠি এই মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বেই নিহিত৷ বুদ্ধিমান মানুষ এই মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বকে কোনমতেই উপেক্ষা বা অবহেলা করবেন না৷ যতবেশী ও যথাযথভাবে  এই মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের প্রচার ও প্রসার ঘটানো যায় ততই মানব সমাজের কল্যাণ৷ এর আবিষ্কারের ফলে এযাবৎ প্রচলিত বহু রাসায়নিক রচনাতত্ত্বের formula) যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য৷ বিশ্বের মানুষ এই তত্ত্বকে জানবার জন্যে ও এই তত্ত্বের বৈবহারিক প্রয়োগ দ্বারা বিশ্বে সর্বাত্মক পরিবর্তন আনবার জন্যে সাগ্রহে প্রতীক্ষা করছে৷.....’’

‘‘মাইক্রোবাইটামের সংখ্যাগত হ্রাসবৃদ্ধি অনুযায়ী বস্তু উৎপাদনের ফলে আন্তরাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক আদান-প্রদানের ধারাই বদলে যাবে৷’’

‘‘মাইক্রোবাইটাম প্রয়োগের সাহায্যে বস্তুর আভ্যন্তরীণ সংরচনায় পরিবর্তনম ঘটিয়ে প্রয়োজনীয় মৌল element) তৈরী করা সম্ভব হবে৷

অনুরূপভাবে পেট্রোলিয়ামের ক্ষেত্রেও কৃত্রিম সংশ্লেষণ সম্ভব হবে৷ এই পরিবর্তন আসছে বস্তু দেহের আভ্যন্তরীণ সংরচনার পরিবর্তনের ফলে৷ অধাতব পদার্থের non-metal) আর ধাতব metal) পদার্থের ক্ষেত্রে অত্যদ্ভুত পরিবর্তন দেখা যাবে৷’’

‘‘ঔষধ রসায়ন pharmo-chemistry) ও জৈব প্রযুক্তিবিদ্যায়ও Bio-tecnology) অবশ্যই পরিবর্তন আসবে৷------ঔষধ রসায়নের গবেষণার ফলে আমরা জানতে পারব কী পরিমাণ মাইক্রোবাইটাম থাকলে ঔষধে কী  ধরণের গুণ থাকবে৷ তদ্‌নুযায়ী বেশী কার্যকারী ওষুধের ফরমূলা তৈরী করে নিতে পারব৷....’’

‘‘কোন বস্তুর আভ্যন্তরীণ চলমানতা বাinternal movement যেখানে বেশী  সেখানে ফ্রিকোয়েন্সি অনেক বেড়ে যায়, যার ফলে বিস্ফোরণ ক্ষমতা তীব্র হয় ও আবাজও বেশী হয়৷ মাইক্রোবাইটাম আভ্যন্তরীণ চলমানতাকে internal movement) প্রভাবিত করে৷ এর ফলস্বরূপ উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক তৈরী করার ক্ষেত্রেও বিরাট পরিবর্তন আসতে বাধ্য৷ যেহেতু জিনিসটা গতির সঙ্গে সম্পর্কিত তাই এটা রকেটের গতিকেও প্রভাবিত করবে৷’’

‘‘এ যাবৎ জড় বিজ্ঞানের প্রচলিত ধারণা ছিল এই যে, প্রাণের উন্মেষের জন্যে অঙ্গারাণু carban atom) অপরিহার্য্য কিন্তু মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের সঙ্গে পরিচিত হবার পর মানুষ আর তা মেনে নেবে না৷ তখন আভ্যন্তরীণ সংরচনার মৌল উপাদানের ব্যাখ্যার জন্যে মানুষ আজকের প্রচলিত ফরমূলার  চেয়েও সূক্ষ্মতর ফরমূলা পেয়ে যাবে৷---মাইক্রোবাইটাম যুগের বিজ্ঞানী তখন কার্বন-অনুকে প্রাণোৎসর্জনের মৌল উপাদান ব’লে স্বীকার করবেন না৷ তাঁর কাছে অঙ্গারাণু হ’ল কোটি কোটি মাইক্রোবাইটামের এক সমাহৃত ঘণীভূত রূপ ৷--- আর এই জীবপঙ্কীয় কোষের  মাইক্রোবাইটামের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে মানবদেহে বড় রকমের পরিবর্তন ঘটানো যাবে৷ সাধারণ মানুষকেও অসাধারণত্বে উন্নীত করা যাবে৷  মানুষের মানস সামর্থ বা গুণের উল্লেখযোগ্য উৎকর্ষ ঘটানো  যাবে৷ এক কথায় বলা যেতে পারে এই মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের মানব সমাজের বহুমুখী পরিবর্তনের ক্ষেত্রে বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে৷ মাইক্রোবাইটাম তত্ত্বের প্রয়োগ দ্বারা মানুষের চিত্তানবিক পরিবর্তন ঘটিয়ে চিত্তকোষিক পরিবর্তন সাধন করা যাবে আর এইভাবে উন্নত মানবমন অনুন্নত জৈবীসত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে৷ এর ফলস্বরূপ মানুষের  সামগ্রিক ব্যষ্টিত্বেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্ত্তন ঘটবে৷ এই পরিবর্তন যেমন অন্তর্জগতে ঘটবে তেমনি বাহ্যিক কাঠামোতেও ঘটবে৷ দেহের effulgence বা  জ্যোতিঃ বেড়ে যাবে৷ মানুষ আগের  তুলনায় অধিকতর মানস-প্রধান হয়ে উঠবে ও পরবর্ত্তী  ধাপে অধিকতর আধ্যাত্মিক ভাবাপন্ন হবে৷’’

মাইক্রোবাইটামের এই সব গুরুত্ব উপলব্ধি করেই এর সর্বাধিক উপযোগের জন্যে মাইক্রোবাইটাম সংক্রান্ত তত্ত্বের  উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শ্রী সরকার বলেছেন---‘‘এই মাইক্রোবাইটাম নিয়ে ব্যাপক গবেষনা হওয়া দরকার৷ কাজটি অবশ্যই বিরাট৷ তবুও বলব, অবিলম্বে এই বিষয়ে গবেষণার সূত্রপাত হওয়া দরকার--- নইলে আজকের সমাজের  বহুবিধ সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান করা যাবে না৷’’

মাইক্রোবাইটামের রহস্য জেনে ফেলবার উপায় তিনি বলে দিয়েছেন---

‘‘শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক সাধনার দ্বারা আমাদের  মন সর্বতোভাবে সর্বস্তরেই বিকশিত হবে আর সেই বিকশিত মনে ব্যপকতর ও গভীরতর ধারনা ক্ষমতাও জেগে  উঠবে৷ আর সেই অধিকতর উন্নততর ক্ষমতার দ্বারা মানুষ মাইক্রোবাইটাম সম্বন্ধে সর্ববিধ রহস্য জেনে নেবে৷’’