যে কথা আগে বললুম, কুক্কুর বর্গীয় ও মার্জার বর্গীয় জীবেদের সম্বন্ধে যে কথা খাটে কতকটা সেই কথাই খাটে উদ্ভিদ বর্গীয়ের সম্বন্ধেও৷
আমার জানা এক বসু মহাশয় সাত সমুদ্র তের নদী ঘুরে শেষ পর্যন্ত এসে বসলেন পৈত্রিক ভদ্রাসনে৷ বর্ধমান জেলার রায়না থানার পলাশন গ্রামে৷ ভদ্রলোক ও তাঁর স্ত্রী দুজনেই দারুন রকমের বৃক্ষপ্রেমিক৷ এধরণের বৃক্ষপ্রেমিককে তাইলা্যণ্ডে ‘বৃক্ষশ্রী’ উপাধি দেওয়া হয়, ভারতে দেওয়া হয় ‘কৃষিপণ্ডিত’৷ সেবার ভদ্রলোক গ্রামে এসে গাছের ক্যাটালগ দেখে বিভিন্ন দেশ থেকে সেরা সেরা গাছ আনতে লাগলেন ও বর্ধমান জেলার মাটিতে তাদের ফুলোতে ও ফলাতে থাকলেন৷ একবার তিনি শুণলেন এক অদ্ভুত রকমের ফুলের কথা৷ ফুলটির রঙ শ্বেত শুভ্র (Milky white)৷ পাপড়িগুলো সাজানো কতকটা যেন গোলাপের মত৷ গন্ধে আকাশ বাতাস মধুময় হয়ে ওঠে–গাছে দারুণ আঠা৷ আঠার ফলে চোরেরা ফুল তুলতে সাহস করে না৷ অর্থাৎ এই ফুল একদিকে যেমন বাগানের শোভা বর্দ্ধন করে অন্যদিকে তেমনি তস্করের হাত থেকে নিজেই নিজেকে রক্ষা করে৷ দক্ষিণ আমেরিকার একটা বিশেষ গ্রীষ্মপ্রধান আর্দ্র অঞ্চলে এদের বাস৷ এদের বাঁচাতে গেলে শিশুকালে তালপাতা কিংবা কলাপাতার ঠোঙা দিয়ে সকাল দশটা থেকে চারটে পর্যন্ত ঢাকা দিয়ে রাখতে হয়৷ এদের গায়ে সন্ধ্যায় ফুরফুরে হাওয়াও লাগাতে হয়৷ এ্যামোনিয়া সারের সঙ্গে সর্ষের খইল ও তার সঙ্গে কম্পোজ সার সমপরিমাণে মিশিয়ে চালুনিতে ভালভাবে চেলে সমপরিমাণ ক্ষোন–ডাষ্ট মিশিয়ে শতকরা পাঁচ ভাগ গ্যামাক্সিন মিশিয়ে শেকড়ের আশপাশে ছিটিয়ে দিতে হয়৷ তবে শেকড়ের এক ইঞ্চি দূরত্বের মধ্যে ওই সার থাকা চলে না৷
ভদ্রলোক স্ত্রীকে বললেন, ‘‘শুণছ গো, গাছ নিয়ে নোতুন একটা গবেষণা করার সুযোগ এল৷ আমাদের বদ্দমান জেলায় যা কেউ কখনও দেখে নেই এবার তেমনটি হব্যে’’৷ ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকা রবাণা হয়ে গেলেন৷ চার পাঁচদিনের মধ্যে ফিরে এলেন৷ এসে বোসগিন্নীকে বললেন, ‘‘দেখ এবার সাগরসেঁচা মাণিক আননুম্৷ ক্ষদ্দমানের মাটিতে সেই মাণিকের গাছ হব্যে’’৷
ভদ্রলোকের কাজেকর্মে কোনখানটিতে তিলমাত্র খুঁত রইল না৷ প্রাণ ঢেলে বীজগুলোকে তোবাজ করতে লাগলেন৷ অনেক কষ্ট করে সার সংগ্রহ করলেন৷ বোসগিন্নী ওই সারকে চালবার জন্যে বর্ধমান–রাণীগঞ্জ বাজার থেকে বিশেষ ধরণের মিহি চালুনি আনালেন৷ ভদ্রলোক সন্ধ্যের সময় নিয়মিতভাবে বীজতলার পাশে বসে সিঙ্গুর থেকে কিনে আনা তালপাতার পাখায় বাতাস করে যেতে থাকলেন৷ কাঁধের গামছাটা মধ্যে মধ্যে বাঁ হাতে তুলে নিয়ে ঘাড়–মাথা–কপাল–মুখ্ ঘাম মুছে যেতেন৷ মধ্যে মধ্যে চশমাটা খুলে নিয়ে ভাপে ঢাকা কাঁচ দু’টো ধুতিতে মুছে নিতেন৷ এই গলদ্ঘর্ম অবস্থা বোস মশায়ের চলেছিল বেশ কিছুদিন ধরে৷ যখন ভদ্রলোকের মনে হত সিঙ্গুরের ছোট পাখায় আর শাণাচ্ছে না তখন তারকেশ্বরের গাজনের মেলা থেকে কিনে আনা ক্ষিরাট আকারের তালপাতার পাখা দিয়ে দু’হাতে ক’রে হাওয়া করে যেতেন৷
যথাকালে বীজ থেকে অঙ্কুরোদগম হ’ল৷ ভদ্রলোক বড় করে একটা সত্যনারায়ণ দিলেন৷ গাঁ শুদ্ধ লোক পেসাদ পেয়ে গেল........শুভেচ্ছা জানাল, ওই দক্ষিণ আমেরিকার ফুলের গাছের অঙ্কুর যেন তাড়াতাড়ি বের হয়৷ গাছের পাতা এলে যেন তাদের অবশ্যই ডাকা হয়৷ ফুল দেখবার নেমতন্ন যেদিন করা হবে সেদিন যেন আরো একবার একটা বড় করে সত্যনারায়ণ দেওয়া হয়৷
বোসবাবু বললেন, সে আর বলতে যেদিন বীজ থেকে অঙ্কুর বেরুবে বুঝতে হবে আমার মানব জীবন সার্থক হয়েছে৷ যেদিন পাতা বেরুবে সেদিন আমার নয়, গোটা বদ্দমান জেলার সকলের মানব জীবন সার্থক হয়েছে, আর যেদিন ফুল আসবে সেদিন আমাদের অক্ষয় স্বর্গবাস৷
যথাকালে পাতা বেরুল৷ বোসমহাশয় স্বগতভাবে বললেন এমন পাতা কোন স্বপ্ণলোকে কখনও কোথাও দেখেছি দেখেছি ক্ষলে মনে হচ্ছে৷ বসুগৃহিণী মনে মনে বললেন–এই ধরণের পাতা আমার বাপের বাড়ীতে কোন্নগরের মিত্তির বাড়ীর পেছনের দিকে আস্তাকুঁড়ের পাশে যেন দেখেছি একথা মনে হচ্ছে৷ তবে আস্তাকুঁড়ের পাশে দেখেছি একথা তো কত্তাকে বলতে পারি না৷ যাই হোক কত্তাকে চেপেই যাই৷
গাছটি আরও বড় হ’ল৷ বসু মহাশয় পাড়ার লোকদের কোন খক্ষর দিলেন না, কারণ তার মনে যেন কেমন কেমন ঠেকছে৷
বসুমহাশয় বললেন, ‘‘গিন্নী, আমারও যেন কেমন কেমন লাগছে৷ তবে এখন কথাটি না বলাই ভালো৷ কিছুদিন আর মুখ খুলো না, ফুল আসুক তখন দেখা যাবে৷’’
দেখতে দেখতে গাছে কুঁড়ি এল৷ ভদ্রলোকের বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে গেল৷ বসু গিণ্ণী বললেন, ‘‘কত্তা আমারও শরীরটা যেন তেমন ভাল লাগছে না৷ রগ টনটন করছে .....কেমন গা বমি বমি করছে........অম্লশূলের ব্যথাটা যেন কেমন চেগে উঠেছে৷ আমি কপালে গামছা বেঁধে একটু শুয়ে পড়ি৷
পরদিন সকালের কথা৷ রোজ ভোরে বসুমশায় গিণ্ণীকে ডাকেন–এসো গো, চল গাছ দেখি গে৷ আজ আর গিণ্ণীকে ডাকলেন না৷ নিজেই ধীর পায়ে বাগানে গাছটির কাছে বসলেন৷ গাছটির কাছে আসার সময় তার আর পা সরছিল না–হাঁটু নড়ছিল না৷ গাছের পাশে এসে তিনি আস্তে আস্তে বসে পড়লেন৷
ফুল এসেছে৷ শুধু একা আসেনি৷ সঙ্গে নিয়ে এসেছে বসু পরিবারের জন্যে হতাশার হিমালয়৷ ভদ্রলোক না ডাকলে কি হবে, বসুগিণ্ণী নিজের থেকেই এলেন৷ রগে তখন গামছা বাঁধা৷ গাছটির কাছে এসে তিনি ধপাস করে পড়ে গেলেন ৷ ভাগ্যিস বসুমশায় পাশেই ছিলেন, তাই তিনি গিণ্ণীর হাত ধরে ফেললেন৷ নইলে গিণ্ণী তো মুখথুবড়ে গাছটির ওপরেই পড়ে যেতেন৷
কর্ত্তার চোখে জল......গিণ্ণীর জীর্ণ মুখে হতাশার কাজল চিহ্ণ৷ এত কষ্ট করে, এত সার দিয়ে, এত পাখার বাতাস করে ঘটা করে সত্যনারায়ণ দিয়ে যে গাছটিকে আজানুম,সে যে আমাদেরই আস্তাকুড়ের পাশে অযত্নে গজিয়ে ওঠা ঘেঁটু ফুল৷
গিণ্ণী বললেন, ‘‘ঘেঁটুফুল গো ঘেঁটুফুল৷’’
কর্ত্তা বললে, ‘‘ঘেঁটুফুল গো ঘেঁটুফুল৷’’
কর্ত্তা বললে, ‘‘ভাল বাংলায় যাকে বলি ঘণ্ঢাকর্ণ’’৷
যাই হোক যে কথা জীবজগতের বেত্রে প্রযোজ্য উদ্ভিদ জগতের বেত্রেও তাই প্রযোজ্য.......বুঝলে
(শব্দ চয়নিকা, ১১/১৯১)