বর্তমান করোনা মহামারী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষের রাজনীতির উন্মুক্ত আকাশে একটি সুন্দর শব্দবন্ধ " পরিযায়ী পাখী"দের মত বাধাবন্ধহীন ভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে---তা হলো "পরিযায়ী শ্রমিক "। আমরা এতদিন স্থানীয় শ্রমিক ও বহিরাগত শ্রমিক দের নাম শুনেছি। কিন্তু করোনা-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘ দুই মাসাধিককাল সারাদেশে লকডাউনের ফলে রুজি-রোজগার হারিয়ে নিজেদের গ্রামে, রাজ্যে ও স্থায়ী ঠিকানায় ফিরে যেতে ব্যাকুল ভিনরাজ্যের হাজার হাজার শ্রমিক ট্রেন বাস ইত্যাদি গণপরিবহন না পেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শত শত মাইল পথ পায়ে হেঁটে বা সাইকেলে পাড়ি দেওয়ার অসমসাহসিক অভিযানে নাবতে বাধ্য হয়েছেন। হাজার হাজার পথচলা শ্রমিকদের সারি দেখেই হয়তো এই নতুন নামকরণ--"পরিযায়ী শ্রমিক’।
বর্তমানে মন্ত্রী, সান্ত্রী, রাজনীতবিদ, সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম সর্বত্রই পরিযায়ী শ্রমিক সম্পর্কিত চর্চা ও আলোচনা চলছে। মূলত স্থানীয় স্তরে কর্মসংস্থানের অভাব, দূরবর্তী স্থানে অধিক মজুরি পাওয়ার আশা ও অন্যান্য বহুবিধ কারণে মানুষ এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতে বাধ্য হয়। এ ছাড়াও মালিকপক্ষ ও শিল্পপতিরা স্থানীয় শ্রমিকদের চেয়ে বহিরাগত শ্রমিক বেশি পছন্দ করে। স্থানীয় শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে অধিক মজুরি ও সুযোগ সুবিধা আদায়ের জন্য জোরদার আন্দোলন করতে সমর্থ হন, কারণ স্থানীয় অধিবাসী হবার ফলে তারা অনেক বেশি সুবিধা জনক অবস্থায় থাকেন।
কিন্তু বহিরাগত শ্রমিকদের মানসিক ও আর্থিক দিক দিয়ে শোষণ করা সহজ। মালিকপক্ষ বহিরাগত শ্রমিকদের ভীতি প্রদর্শন করে অথবা সামান্য কিছু আর্থিক সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে বশীভূত করে অধিকাধিক পরিশ্রম করিয়ে নিতে পারে। ফলে তাদের মুনাফা বৃদ্ধি পায়।
প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বহিরাগতদের কর্মচ্যূ ত হবার সম্ভাবনাও বেশী। এই কারণেই স্থানীয় স্তরে সমস্ত মানুষের একশত শতাংশ কর্মসংস্থান একান্ত আবশ্যক। তাহলে তাদের আর পরিযায়ী শ্রমিকে পরিনত হতে হবে না ও অসময়ে ঘরের টানে শত শত মাইল পথও চলতে হবে না।
গত১২/৫/২০২০ তারিখে প্রধানমন্ত্রী শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদী মহাশয় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার সময় কয়েকটি শব্দবন্ধ উচ্চারণ করেন। সেগুলি হলো-- "আত্মনির্ভর ভারত, Local Product, Local সে Global,’--ইত্যাদি ইত্যাদি। এছাড়াও পরবর্তী সময়ে শ্রীযুক্ত মোদীর "জনগণের প্রতি খোলা চিঠি, "মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে ও তেনার পার্শ্বচর, অনুচরদের বিভিন্ন বক্তব্যের মধ্যে তথা সংবাদ মাধ্যমে, সামাজিক মাধ্যমে আলোচনার সময় ওই শব্দবন্ধগুলি বার বার চর্চিত হয়েছে। এই সব বক্তব্যের নির্যাস হচ্ছে--স্থানীয় স্তরে সমস্ত কিছু উৎপাদন করে সেই উৎপাদিত সম্পদের দ্বারা দেশের মানুষের প্রয়োজন মিটিয়ে বহির্বিশ্বে (Global) রপ্তানি করে দেশকে শক্তিশালী ও আত্মনির্ভর করে তুলতে হবে। এর ফলে ভারতবর্ষকে আর অন্য কোনো দেশের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না ও "আত্মনির্ভর ভারত’ নির্মাণ সম্ভব হবে। ভারতের১৩০ কোটি মানুষ জোটবদ্ধ হয়ে নিজের শক্তিতেই এই কাজ করে দেখাতে পারবেন। এই কথাগুলো কি খুব অচেনা মনে হচ্ছে? শ্রীযুক্ত মোদী ও অন্যান্য মন্ত্রী সান্ত্রীগণ ২০২০ সালের মে-জুন মাসে যা বললেন, যেটুকু বলতে চেষ্টা করলেন---তার থেকে অনেক বেশি সুনির্দিষ্ট ভাবে, বিস্তৃত আকারে, বিজ্ঞান সম্মত ও অর্থনীতি তথা সমাজ তত্ত্বের প্রয়োগভৌমিক ক্ষেত্রে বাস্তব সম্মত হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন বিংশ শতাব্দীর মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকার ১৯৫৯ সালে প্রবর্ত্তিত "প্রাউট’ দর্শন বা "প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব’ -এর প্রতি ছত্রে ছত্রে। প্রাউট (PROUT--Progressive Utilization Theory) বা প্রগতিশীল উপযোগ তত্ত্ব অনুসারে-- হরর্মে পিতা, গৌরী মাতা, স্বদেশ ভুবন ত্রয়ম। এর মূল নীতি হচ্ছে বিশ্বৈকতাবাদ ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব--যার শুরুটা হবে "স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল’ ঘটনের দ্বারা অর্থাৎ আঞ্চলিক শ্রীবৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বৈকতাবাদের প্রতিষ্ঠা।
‘প্রাউট’ এর নীতি অনুসারে বিশ্বের সমস্ত সম্পদের মালিক বিশ্বপিতা পরমব্রহ্ম ও সমগ্ৰ সৃষ্টির প্রতিটি সত্বার এই সম্পদে রয়েছে সমান অধিকার। প্রত্যে্কের এই সম্পদকে মিলে মিশে ভাগ করে নিজের প্রয়োজনে ব্যকবহার করার অধিকার আছে। কিন্তু মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ যদি এই সম্পদের অধিকাংশ কুক্ষিগত করে রাখে, তবে সমাজের বৃহদংশ বঞ্চিত ও শোষিত হতে বাধ্য। সেই কারণে বর্তমান পৃথিবীতে কতিপয় পুঁজিবাদীর হাতে সম্পদের সিংহভাগ কেন্দ্রীভূত ও তাদেরই স্বার্থে রাষ্ট্রগুলি কেন্দ্রিত অর্থনীতির মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে শোষণের জাতাকলে পিষ্ট করে চলেছে। তথাকথিত রাজনৈতিক গণতন্ত্রের আড়ালে ছলে বলে কৌশলে এই শোষণকে নিরঙ্কুশ ও দীর্ঘায়িত করার এক সুগভীর চক্রান্ত রচনা করেছে।
মানুষের প্রতি এই অন্যায়,অবিচার ও সার্বিক শোষণের বেড়াজাল ছিন্ন করতে "প্রাউট"এর প্রতিষেধক হচ্ছে "বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি" ও "অর্থনৈতিক গণতন্ত্র’। মানুষকে "রাজনৈতিক স্বাধীনতা’ নয়, দিতে হবে "অর্থনৈতিক স্বাধীনতা’ --এই উদ্দেশ্যেই গড়ে তুলতে হবে "স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল "। এই অঞ্চলগুলির অর্থনৈতিক পরিকল্পনা রচিত হবে একেবারে তৃণমূল স্তরে। "ব্লকভিত্তিক পরিকল্পনা"র মাধ্যমে স্থানীয় সমস্ত কৃষিজ, বনজ,খনিজ, জলজ ও মানব সম্পদের সর্বাধিক উপযোগ গ্রহণ করতে হবে। বিকেন্দ্রিত অর্থনীতির মাধ্যমে স্থানীয় অঞ্চলে জীবন ধারণের যথাসম্ভব বেশি উপকরণ উৎপাদন করে অঞ্চলগুলিকে স্বনির্ভর করে তুলতে হবে।
পরবর্তীকালে এই অঞ্চলগুলি মিলে মিশে বৃহত্তর অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠবে যা ক্রমশ: বিস্তৃত হয়ে রাজ্যত, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক স্তরে প্রসারিত হবে। কৃষি, শিল্প, ব্যেবসা-বানিজ্য সবই মূলত: সমবায় পদ্ধতিতে চলবে। অতি ক্ষুদ্র প্রকল্প গুলি ব্যরষ্টিগত মালিকানাধীন ও অতি বৃহৎ প্রকল্প যেগুলো সমবায় পদ্ধতিতে পরিচালিত হবার ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে সেগুলি স্থানীয় সরকার দ্বারা না-লাভ-না-ক্ষতি নীতিতে পরিচালিত হবে।
"স্বয়ংসম্পূর্ণ সামাজিক অর্থনৈতিক অঞ্চল"গড়ে তোলার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সর্বাত্মক শোষণ মুক্ত সমাজব্যবস্থার স্থাপনা। এই অঞ্চলের অধিকাংশ কর্মকান্ড সমবায়ের মাধ্যমে পরিচালিত হবার ফলে উৎপাদক ও উপভোক্তার মধ্যে কোন কায়েমী স্বার্থবাদী মধ্যলস্বত্বভোগী না থাকায় ভোগ্যুপণ্যেজর মূল্যীমান নিয়ন্ত্রণে থাকবে ও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। প্রাউট-এর নীতি অনুসারে কৃষিকে শিল্পের মর্যাদা দান করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থানীয় মানুষের এক শত শতাংশ কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত করা হবে ও প্রত্যেয়কের ন্যূ নতম প্রয়োজন পূর্তির(অন্ন,বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা) নিশ্চিততা থাকবে। সকলের স্থানীয় অঞ্চলে কর্মসংস্থান সুনিশ্চিত হবার ফলে বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ব্যমতীত জনগণের রুজি রোজগারের জন্যে অন্য কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। এর ফলে পরিযায়ী শ্রমিকদের হয়রানিও চিরতরে দূরীভূত হবে যা শুধুমাত্র ভারতের নয়, বিশ্বের বহু দেশেরই জ্বলন্ত সমস্যা।
প্রাউট অর্থনীতির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো "সমবায়" (কৃষি, শিল্প, বানিজ্য সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য) যা সফল করতে হলে একান্ত প্রয়োজন নৈতিকতা, সততা ও সচেতনতা। এর জন্যে মানুষকে আধ্যাটত্মিকতার পথে চলে প্রকৃত অর্থে নৈতিকতায় প্রতিষ্ঠিত হতে হবে---একমাত্র তখনই মানুষ সার্বিক শোষণের অবসান ঘটিয়ে সত্যিকারের "মানুষের সমাজ" রচনা করতে পারবে। "প্রাউট" দর্শন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা এই ক্ষুদ্র পরিসরে সম্ভব নয়, তাই আগ্রহী সুধীজনকে প্রাউট-সিরিজের বিভিন্ন পুস্তক ও কণিকায় প্রাউট, ইত্যাদি গ্রন্থ পাঠ করতে অনুরোধ জানাই।
পরিশেষে বলি,ভোগবাদী মানসিকতা, পুঁজিবাদী শোষণ ও দেশের সম্পদ দেশী-বিদেশী পুঁজিপতি তথা মুনাফালোভী অর্থগৃধ্নুদের সামনে অবারিত করে দিলে "আত্মনির্ভর ভারত" নির্মাণ কখনোই সম্ভব নয়,---তা করতে হলে প্রতিটি মানুষকে তথা প্রতিটি অঞ্চলকে স্বনির্ভর করতে হবে, সমস্ত সম্পদকে নব্যফমানবতাবাদ- ভিত্তিক উপযোগের মাধ্যমে জগতের সর্বাত্মক কল্যাাণে ব্যেবহার করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে প্রাউটের নির্দেশনা অনুযায়ী বিকেন্দ্রিত অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। একমাত্র তখনই ভারতবর্ষের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য সংস্কৃতির আলোকে "আত্মনির্ভর ভারত" স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত হবে আর সেই বর্ণচ্ছটায় সমগ্ৰ বিশ্বও ঝলমল করে উঠবে।
এই মর্মে স্মরণ করি প্রাউট-প্রবক্তা মহান দার্শনিক শ্রীপ্রভাতরঞ্জন সরকারের উক্তি:-- " একটা মানুষ অন্যেরর মুখের গ্রাস কেড়ে নেবে, এটা তো উচিত নয়। সুতরাং মানুষ যাতে একটা বিধিসম্মত ভাবে তার সমস্ত সম্পদ নিজেদের মধ্যে মিলে মিশে ভাগ করে কাজে লাগাতে পারে তার একটা ব্যমবস্থার দরকার ছিল যা এর আগে কোনো মহান পুরুষ করে নি। ----এই না করার জন্যে সমাজ জীবনে যে অনুপপত্তি থেকে গিয়েছিল, সেই অনুপপত্তির জন্যেুই মানুষের যত দু:খ কষ্ট ভোগ চলছিল। ----যাতে এটা না হয়--যাতে মানুষ তার মহত্তর লক্ষ্যকে চোখের সামনে রেখে জাগতিক দুঃখ-ক্লেশগুলোকেও দূর করার চেষ্টা করে, সেইজন্যেই প্রাউট দর্শনের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাউট দর্শনকে সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোন পথ ছিল না। তা যদি না করা হত, আরো হয়তো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের দুঃখ কষ্ট ক্লেশ চলতেই থাকত, ও সুবিধাবাদী নীচাশয় ব্যষষ্টিরা সহজ সরল মানুষের বৌদ্ধিক সরলতার অথবা বৌদ্ধিক অভাবের সুযোগ নিয়ে তাদের শোষণ করত। ---এখন পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে এই নিপীড়ন, এই দমন ও শোষণ থেকে বাঁচাতেই হবে--- যেন তেন প্রকারেণ।
- Log in to post comments