মানুষ যদি সব সময় এই কথাটা মনে রাখে যে, আমাকে যে যাই বলুক না কেন, যত গালিই দিক না কেন, লোকের চোখে আমি যত ছোট, যত মূর্খ, যত গরীবই হই না কেন, আমি তো পরমপুরুষের বিস্তারিত দেহের একটা টুকরো মাত্র, তখন তার মধ্যে আর কোন গ্লানিই থাকে না, থাকতে পারে না৷ মানুষ হ’ল অসম্পূর্ণ, পরমপুরুষ সম্পূর্ণ৷ তাই মানুষের মধ্যে ত্রুটি থাকবেই৷ সে যত পরমপুরুষের বিরাট ভাবের দিকে এগিয়ে যাবে ততই সে ত্রুটিমুক্ত হতে থাকবে, আর যখন সে সম্পূর্ণ ত্রুটিমুক্ত হবে, তখন দেখা যাবে, সে পরমপুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে, আর সে আলাদা নেই৷
স্বাভাবিক অবস্থায় মানুষ যতদিন সাধক অর্থাৎ সে এগিয়ে চলেছে পরমপুরুষের দিকে, মিলেমিশে এক হয়ে যায়নি, ততদিন তার মধ্যে ছোট–বড় ত্রুটি তো থাকবেই৷ সেই ত্রুটিগুলোর কোনটাকে আমরা বলি পাপ, কোনটাকে পাতক, কোনটাকে প্রত্যবায়৷ সমাজ তার নিন্দা করে, ঘৃণা করে৷ সমাজের তো ঠিক সেই ধরণের লোককে ঘৃণা করা, নিন্দা করা স্বাভাবিক কারণ তাতে সে লজ্জায়, অপমানে পাপ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করবে৷ সুতরাং তার একটা ভাল দিকও রয়েছে৷ কিন্তু সকলের একথাও মনে রাখা উচিত যে সমাজের চোখে যদি সে হেয়, যদি সে ঘৃণ্য প্রমাণিতও হয়, পরমপুরুষের কাছে সে হেয় নয়, ঘৃণ্য নয়, কারণ সেও তো পরমপুরুষের সন্তান৷ আর এই কথাটি মনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সে পাপ থেকে দূরে সরে যাবে৷
মানুষের পাপ থেকে বাঁচবার সর্বশ্রেষ্ঠ পথ হ’ল সব সময় এটা মনে রাখা যে আমি পরমপুরুষের সন্তান৷ পৃথিবীর সবাই যদি আমাকে হতভাগ্য বলে তাড়িয়েও দেয়, তবু পরমপুরুষের কোলে আমার স্থান হবেই৷ এটা আমার জন্মগত অধিকার৷ সেই জন্যে কোন অবস্থাতেই কোন মানুষেরই কোন রকমেই পরমপুরুষের সঙ্গে তার যে সম্পর্ক, তাতে কোন রকম গ্লানি রাখা উচিত নয় অর্থাৎ ভাবা উচিত নয় যে ভগবান আমাকে ঘৃণা করেন৷ তিনি কখনও কাউকেই ঘৃণা করতে পারেন না, কারণ সবাই যে তাঁর স্নেহের সন্তান৷ সন্তান অন্যায় করলে পিতামাতা শাসন করেন, ঘৃণা করেন না৷ সুতরাং পরমপুরুষ শাসন করতে পারেন, ঘৃণা করতে পারেন না৷ পিতামাতা রেগে গিয়ে ছেলেকে অনেক সময় বলেন ‘‘মর্, মর্, যমের বাড়ী যা’’ কিন্তু মনের থেকে তিনি কিছুতেই তা চান না৷ ওটা মুখের কথা, মনের কথা নয়৷ কারণ, যে সন্তানকে তিনি পাঁচ মিনিট আগেও বলেছেন ওই কথা, সেই সন্তানেরই একটু অসুখ–বিসুখ হলে মা চিন্তায় পড়েন, ‘‘কী হবে গো ছেলের আমার কি হবে গো’’ এই হ’ল আসল ব্যাপার৷
সব সময় মনে রেখে দিও, পরমপুরুষ দু’টো কাজ করতে পারেন না৷ এক, তাঁর মত আরেকটি পরমপুরুষ তৈরী করতে পারেন না অর্থাৎ যে মানুষটি বড় হয়ে, বৃহৎ হয়ে পরমপুরুষের মত হয়, সে পরমপুরুষই হয়ে যায়, পরমপুরুষের সঙ্গে মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ সুতরাং পরমপুরুষ একটি থেকে যাচ্ছেন, দুটো থাকছেন না৷ আর দ্বিতীয় জিনিষটা হ’ল–তিনি কাউকেই ঘৃণা করতে পারেন না৷ তিনি যদি চান যে অমুক লোকটা পাপ করেছে, ওকে ঘৃণা করব, তবুও তিনি ঘৃণা করতে পারবেন না৷ কিছুতেই না৷
একটা শিক্ষামূলক গল্প আছে৷ দু’টো শিয়ালে ভাবছে–রাস্তা দিয়ে এত মানুষ কোথায় যায়? তারা খোঁজ নিয়ে জানল, তারা সব কোর্টে যায় মোকদ্দমা লড়তে৷ তখন ওরা বললে–দেখো, আমরা মানুষের চেয়ে পেছিয়ে থাকব কেন? আমরাও মোকদ্দমা লড়ব, লড়াই করব৷ তাহলে মানুষের সমান হয়ে যাব৷ এখন, লড়াইটা কেমন হবে? ধরা যাক, গাছ থেকে একটা ফল পড়েছে৷ এক নম্বর শেয়াল বললে– দেখ্, এই ফলটা আমি খাবার চেষ্টা করব, আর তুই বলবি–না, এই ফলটা আমার, তোকে খেতে দেব না৷ তারপরই আমাদের ঝগড়া হবে৷ আমরা কোর্টে যাব, মোকদ্দমা লড়ব৷ ঠিক হ’ল এইভাবে একটা কৃত্রিম ঝগড়া বাধানো হবে৷ এমন সময় একটা ফল পড়ল৷ এক নম্বর শেয়ালটা যেই মুখ দিতে গেল, দু’নম্বর শেয়ালটা কিছুই বলছে না৷ তখন এক নম্বর শেয়ালটা বললে–তোকে যেমন শিখিয়েছিলুম, তেমনই বল না– ‘‘এটা তোর নয়, এ ফলটা আমার’’৷ তখন দুই নম্বর শেয়ালটা বললে, ‘‘তুমিই না হয় ফলটা খেলে, তাতে আর হয়েছেটা কী? ’’ ঝগড়া করা হ’ল না৷ তাই শেয়ালরা আর মানুষের সমান বড় হ’তে পারল না, কারণ কোর্টে মোকদ্দমা করা গেল না৷
বন্য পশু–পক্ষী কেউই ঘৃণা করতে পারে না৷ওরা চাইলেও পারে না৷ আর তেমনই পরমপুরুষ যদি চান ওই লোকটা ভারী বদমাস, ওকে ঘৃণা করি, তবুও তিনি পারেন না৷ ঘৃণা করতে গেলে তাঁর মনে হয়–আমারই তো সন্তান৷ তাই তিনি ঘৃণার বদলে বলেন, ‘‘আয় বাবা, আমার কোলে আয়, আর কক্ষণো এ রকম করিস না৷’’
(৩ নবেম্বর ১৯৭৮, কলিকাতা, সন্ধ্যাবেলা)