প্রতিটি কাজেই তোমাদের জানা উচিত কোন্টা কী ও কীজন্যে, কেন কেন এটা করছ, কেন ওটা করছ না৷ অতীতে আমি অনেকবারই বলেছি যে মানবসমাজ একটা একক সত্তা৷ এটা অবিভাজ্য, এটাকে নানান টুকরোয় বা অংশে ভাগ করা যায় না, কারণ মূলতঃ মানবতা এক৷
শিশু কি জানে যে সে একটা বিশেষ দেশের শিশু? শিশু কি জানে যে সে সাদা, কালো বা হলুদ? সে কি জানে যে সে শিশু, সে ছোট? না, জানে না৷ আমরা বড়রা তাদের মনে নানান ধরনের মতবাদ ঢুকিয়ে দিই৷ আমরা বলি, ‘‘তুমি উঁচু জাতের,’’ ‘‘তুমি নীচু জাতের’’, আমরা বলি, ‘‘তুমি ইহুদী,’’ ‘‘তুমি মুসলমান’’ ও আরও অনেক কিছু৷ আমরা বড়রাই মানব সমাজের এইসব বিভাজনের জন্যে দায়ী৷ মানবসমাজ কিন্তু একটাই৷ আর দোষটা কাদের? দোষটা বড়দের, শ্রদ্ধেয় মানুষদের৷ তাই নয় কি? তোমরাই বল–এটাই ঠিক নয় কি?
শ্রোতারা উত্তর দিলেন ঃ এটাই ঠিক৷
আমাদের সমাজ এক৷ আর এটা আমি আমার শৈশব থেকে বলে আসছি যে মানব সমাজ এক৷
মনে কর ধর্মীয় মতবাদ৷ আমরা বলি নানান ধর্মীয় মতবাদ রয়েছে৷ ‘‘আমরা ধর্মীয় মতবাদ নির্বিশেষে মানবসমাজের সেবা করে থাকি’’–এমনটাই আমরা বলি৷ কিন্তু একটার বেশী ধর্ম থাকতে পারে কি? মানুষের ধর্ম কী? না, পরমসত্তার দিকে এগিয়ে চলা, পরম উৎসের দিকে–আনন্দের চির–উৎসের দিকে এগিয়ে চলা৷ এটাই একমাত্র ধর্ম৷ জেনে–বা–না–জেনে আমরা সবাই এগিয়ে চলেছি–কার দিকে? আমরা সবাই কীসের খোঁজ করি? আমরা কী চাই? আমরা আনন্দ চাই৷ আমরা শান্তি চাই৷ তাই সমস্ত মানবসমাজের ধর্মবিশ্বাস কী? কতকগুলি? না, একটাই৷ জেনে–বা–না জেনে আমরা তাঁর দিকেই এগিয়ে চলেছি৷ তাই মানবসমাজের একের বেশী ধর্মবিশ্বাস থাকতে পারে না৷
একের বেশী ধর্ম থাকতে পারে কি?–না৷ যারা বলে সমাজে নানান ধর্মবিশ্বাস রয়েছে তারা প্রকৃতপক্ষে সত্যের আশ্রয় নিচ্ছে না৷ আমি বলছি না তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয়, কারণ তারাও ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা৷ আমি অবশ্যই বলব যে তারা সর্বদা সত্যতার আশ্রয় নেয় না৷ (কারণ আমিও তো ভদ্রলোক, আমাকে মেপে কথা বলতে হবে৷(হাসি)
দ্বিতীয় জিনিস হ’ল, লোকেরা বলতে পারে, ধর্ম অনেক৷ না, ধর্ম এক, অনেক নয়৷ আর তা হ’ল সনাতন ধর্ম, মানব ধর্ম, ভাগবৎ ধর্ম৷ এটাই ধর্ম৷ লক্ষ্য হচ্ছে ঈশ্বর সম্প্রাপ্তি, পরমপিতার নিকটে আসা, পরম আনন্দ পাওয়া৷ এটাই লক্ষ্য৷
তাই একের বেশী ধর্ম থাকতে পারে কি? না, এ ধরনের কথা যারা বলে তারা ধার্মিক নয়৷ তারা ধর্মীয় মতবাদের ব্যবসায়ী৷ একের বেশী ধর্ম থাকতে পারে কি? মানুষের ধর্ম এক আর সে ধর্ম আমাদের পরমপিতার দিকে এগিয়ে যেতে শেখায়৷
শ্রেণী বিজানন৷ এটা কি পরমপুরষের সৃষ্টি? সমস্ত শ্রেণী, মনে কর অর্থনৈতিক ভাবে দেখলে ধনী, দরিদ্র ইত্যাদি–এগুলো কি ঈশ্বরের দেওয়া না মানুষের তৈরী? এগুলো কী?
শ্রোতাদের উত্তর, - মানুষের তৈরী৷
মানুষেরই তৈরী৷ এগুলো আমাদের ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি৷ আর এই ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থাই বা কে তৈরী করেছে?–মানুষ৷ আর জাত৷ সবাই যখন একই পরমপিতার সন্তান, একই পরমসত্তার সৃষ্টি, সব সন্তানই একই পিতা থেকে জাত, তখন তারা কি একের ৰেশী জাতের হতে পারে? পিতা যদি ব্রাহ্মণ হ’ল তাঁর ছেলেমেয়েরা নিশ্চয় তাহলে ব্রাহ্মণ হবে৷ ছেলেমেয়েরা পিতারই জাতের অধিকারী হয়৷ সমস্ত পৃথিবীর পরমপিতা যখন এক তখন মানবসমাজে একের বেশী জাত থাকতে পারে কি? তোমরাই বল না, আমি তোমাদের জিজ্ঞেস করছি৷ না, একের বেশী জাত থাকতেই পারে না৷ ব্রাহ্মণ নয়, শূদ্র নয়, সবাই এক৷ সবার যখন একই পিতা, একই স্রষ্টা তখন তারা সবাই একই জাতের৷ তাই এ ব্যাপারে আমার সিদ্ধান্তই চরম ও চূড়ান্ত৷ মানবসমাজ একটা একক সত্তা মানবসমাজ এক ও অবিভাজ্য৷ কাউকে শ্রদ্ধা করার সময় আমাদের এই তথ্যগুলো মনে রাখা দরকার যে ঃ আমরা সবাই একই শ্রেণীর, একই ধর্মবিশ্বাসের, একই সমাজের, একই ধর্মের, একই পরিবারের৷ আমাদের এই ৰৃহৎ পরিবার, আমরা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্কিত৷ তোমার চেয়ে বড় কেউ নয়, তোমার চেয়ে ছোটও কেউ নয়৷ তুমি যে–কোনো লোককে ও প্রত্যেককেই শ্রদ্ধা করতে পার কারণ যে–কোনো মানুষ ও প্রত্যেক মানুষই পরমপুরুষেরই এক একটা অভিব্যক্তি৷
শুভেচ্ছা জানানোর জন্যে আমাদের পদ্ধতিটা কী? আমরা ৰলি, ‘নমস্কার৷’ অর্থাৎ ‘‘তোমার মধ্যে যে পরমপুরুষ রয়েছেন, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাই’’৷ তোমাদের এটা মনে রাখা দরকার৷ ঙ্মনমস্কারের সময়ৰ ‘‘আমি আমার মনের সমস্ত শুভ ভাবনাকে ত্রিকুটিতে একাগ্র করি৷’’ তোমাদের মনে নানান আভোগ রয়েছে৷ আভোগকে সংস্কৃতে ‘বৃত্তি’ বলে৷ তাই বৃত্তি অনেক, মনের আভোগও অনেক৷ তোমার মনের একাংশ বলছে, ‘‘আজ আমি গরমভাত খাব’’৷ অন্য অংশ বলছে, ‘‘নিকট ভবিষ্যতে আমি কোলকাতা যাব৷’’ আবার অন্য অংশ বলছে, ‘‘এখন আমাকে মানুষের জন্যে কিছু ত্রাণের কাজ করতে হবে৷’’ আবার অপর অংশ বলছে ‘‘রিফিউজিদের জন্যে আমার পাকা কিছু করা দরকার৷’’ তোমার মনে বিভিন্ন চিন্তা৷ আবার একটা অংশ বলছে, ‘‘আমি একজন সর্বক্ষণের কর্মী হব, আমি আমার ঘর ছেড়ে যাব৷’’ অন্য অংশ ৰলছে, ‘‘কিন্তু আমার মা তো কাঁদবে৷’’ আবার আর এক অংশ বলছে ‘‘না, না, আমাকে ৰৃহৎ সংসারের জন্যে কিছু করতেই হবে৷’’
তোমার মনে নানান চিন্তা৷ কিন্তু তুমি তোমার সমস্ত চিন্তাকে একটা বিন্দুতে অর্থাৎ ত্রিকুটিতে একাগ্র কর৷ এর অর্থ তুমি তোমার মনের সমস্ত শক্তি ও শুভভাবনা দিয়ে এটা করছ–তুমি এই দু’টো বুড়ো আঙুলকে এখানে ঙ্মত্রিকুটিতেৰ স্পর্শ কর৷ অর্থাৎ তুমি এখানে তোমার সমস্ত শুভভাবনাকে একাগ্র করছ–অর্থাৎ তুমি এই শরীরের মধ্যে, অন্য আর এক জন, অপর একটি শরীরের মধ্যে ঙ্মবিভিন্ন জনকে দেখিয়েৰ যে পরমপুরুষ রয়েছেন, তাঁকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছ৷ ঙ্মনমস্কারের সময়ৰ প্রথমে এটা কর৷
আর কেবল মানসিক একাগ্রতাই নয়৷ তুমি মানুষ, তোমার মধ্যে নানান আবেগ রয়েছে৷ জান তো, মানবীয় আবেগ বলে একটি কথা হয়৷ যখন তুমি খুব আনন্দ পাও, চোখের জলে ভেসে যাও যখন অনেক দুঃখ পাও তখনও চোখের জলে ভেসে যাও৷ এগুলোকে আবেগ বলে৷ আর মানুষ আবেগ–তাড়িত হয়ে চলে, যুক্তির দ্বারা নয়, আবেগের তাড়নায় বেশী চলে৷ তাই তোমার আবেগও সেখানে রয়েছে৷ তা, মনের সমস্ত একাগ্রতা নিয়ে, আবেগের সমস্ত মধুরতা নিয়ে, তোমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে তুমি মানবাধারে স্থিত পরমপুরুষকে শ্রদ্ধা জানাচ্ছ৷ তাই তুমি এভাবে কর ঙ্মহাত দু’টো জুড়ে বুকের মাঝখানে রেখেৰ, আর বল, ‘‘নমস্কার’’৷
আমার মনে হয়, তোমরা এটা ৰুঝেছ৷ খুব সুন্দর ধারণা৷ তাই আমার মত, আমার ইচ্ছা যে মানবসমাজ এক ও অবিভাজ্য ঙ্মহোকৰ এটা পরমপুরুষের একটা অভিব্যক্ত রূপ, একটা মধুর অভিব্যক্তি, যাকে সব সময়ই তোমাদের ‘‘নমস্কার’’ করে শ্রদ্ধা জানানো উচিত৷
সকাল, ৯ আগষ্ট ১৯৭৯, ব্যাংকক