পরমপুরুষের কাছে কিছু না চাওয়াই ভাল

Baba's Name
শ্রী শ্রী আনন্দমূর্ত্তিজী

পরমপুরুষের কাছ থেকে কোন কিছু প্রার্থনা করা উচিত কি? লোকে বলে–

‘‘মাঙ্না মরণ সমান হ্যায়

মৎ কোই মাঙো ভিখ্৷

বিন মাঙে মোতি মিলে,

মাঙে মিলে না ভিখ৷৷’’

এত সব জানার পরেও কোন কোন পণ্ডিত চেয়ে বসেন৷ এখন মানুষের মন কোন কিছুতে সন্তুষ্ট নয়৷ তাই মানুষ পরমপুরুষের কাছে কিছু–না–কিছু চেয়ে বসে৷ মানুষ নিজের ভূত–ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে, নিজের সুখ–দুঃখের ব্যাপারে, নিজের নিজের ইতিহাস যতটা জানে পরমপুরুষ তার চেয়ে অনেক বেশী জানেন৷ একজন মানুষ তার একটা জীবনের সমস্ত ঘটনা মনে রাখতে পারে না৷ অতীতের কথা বা পুরোনো ঘটনা সে ভুলে যায়৷ এমন কি শুধু কালকের খাবারের কথাও সে মনে রাখতে পারে না৷ মানুষ তাই নিজের সম্বন্ধেই কতটুকু বা জানে? আর যখন সে নিজের সম্বন্ধে জানে না তখন অপরের সম্বন্ধেই বা কী করে জানবে? এই বিশাল পৃথিবী সম্বন্ধেই বা কী করে জানবে? আর কী চাওয়া উচিত, কী চাওয়া উচিত নয় –– এটা মানুষ তখনই ৰুঝতে পারে যখন প্রত্যেকটা জিনিস সম্বন্ধে, তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সম্বন্ধে, নিজের অতীত ইতিহাস সম্বন্ধে, তার সত্যিকারের প্রয়োজন সম্বন্ধে তার পুরোপুরি জ্ঞান হয়৷ কিন্তু মানুষের এ ধরনের জ্ঞান নেই৷ এজন্যে মানুষ যেটা চেয়ে বসে সেটা সে ভুল করে চায়৷ আর যা সে চায় তা পেয়ে গেলে দেখে তার চাওয়াটা ঠিক হয় নি৷

হয়তো কেউ কোন কিছু চাইছিল সেটা শুণতে শুণতে তার মনেও এ ধরনের একটা ভাবনা এলো যে আমি ওটা চাই৷ একটা ছোট্ট শিশু নিজের সম্বন্ধে কত অল্পই না জানে সে যতটুকু জানে তার মা তার চেয়ে অনেক বেশী জানেন৷ এইজন্যে সেই ছোট্ট শিশুটি কী করে?  –– না, সে তার মায়ের ওপর সব কিছু ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বসে থাকে৷ তাঁর সুখ–দুঃখ তার মা সবই ৰোঝেন ও তার কর্তব্যও ঠিক ঠিক পালন করেন৷ মানুষ সম্বন্ধে ঠিক একথাই প্রযোজ্য৷ কারণ মানুষের ৰুদ্ধি ও জ্ঞান অত্যন্ত অল্প৷ এইজন্যে যা চাওয়া উচিত নয় তাই সে চেয়ে বসে৷ আর যা চাওয়া উচিত তা সে চায় না৷ তাই মানুষের পক্ষে ঠিক কোন জিনিসটা চাওয়া উচিত? শিশু যেমন মায়ের ওপর ষোল আনা নির্ভরশীল, মানুষেরও প্রয়োজন তেমনি পরমপুরুষের শরণাগতি অর্থাৎ পরমপুরুষের ওপর ষোল আনা নির্ভরশীলতা৷ কিন্তু মানুষ করে কী? সে নিজেকে অত্যন্ত ৰুদ্ধিমান ভাবে৷ বড় জোর পনের আনা সে পরমাত্মার ওপর ছেড়ে দেয় আর বাকি এক আনা নিজের হাতে রেখে দেয়৷ ভাবে পরমপুরুষ যদি তার কথা না শোনে তবে কী হবে? এজন্যে এক আনা সে নিজের হাতে রেখে দেয়৷ এখানেই মানুষের সব চেয়ে বড় মূর্খতা৷ তোমার জন্মের পূর্ব থেকেই তিনি তোমার সম্বন্ধে সব কিছু জানেন৷ পূর্ব জীবনে তুমি কে বা কী ছিলে তুমি সেটা ভুলে গিয়েছ, কিন্তু তিনি তা বিলক্ষণ জানেন৷ দশ বার হাজার লোকের মধ্যে হয়তো দু’–এক জন মানুষ পূর্বজন্মের কথা মনে রেখেছেন৷ কিন্তু পরমপুরুষ সকলের সব কথা জানেন৷ তিনি তোমার শুধুমাত্র এক জীবনের কথা নয়, তিনি তোমার জন্ম–জন্মান্তরের সব কথাই জানেন৷ এইজন্যে তোমার জন্যে যা করা উচিত সেটা তোমার চেয়ে পরমপুরুষই বেশী জানেন৷

একটা পুরোনো গল্প আছে৷ গল্পটা ৰাঙলায়৷ একটা ছোট্ট পরিবারে এক ভদ্রলোক ছিলেন, আর ছিলেন তাঁর স্ত্রী ও এক ছেলে৷ তাদের ছেলেটি দূরে কোন কয়লার খনিতে ম্যানেজারের চাকরি করত৷ একদিন সেই ভদ্রলোকের কাছে একটা ছেলের একটা কাটা হাত এল আর বলল, আপনি এই হাতটার কাছ থেকে তিনটি জিনিস চাইতে পারেন৷ তখন স্বামী–স্ত্রীতে শলা–পরামর্শ করে ঠিক করলেন যে ছেলেটির হাতটার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইবেন৷ সেইভাবে তাঁরা কাটা হাতটার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইলেন৷ কিছুক্ষণ পর তারা শুণলেন কে যেন দরজায় খট্খট্ শব্দ করছে৷ দরজা খুলে বেরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ব্যাপারটা কী? জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে তাদের যে ছেলেটি কয়লার খনিতে চাকরি করত হঠাৎ সে মারা পড়েছে৷ সেই কোম্পানীর কাছ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকার চেক্ এসেছে৷ তখন স্বামী–স্ত্রী উভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন৷ কাঁদতে কাঁদতে বললেন –– খোকার হাত, আমরা পঞ্চাশ হাজার টাকা চাই না৷ ততক্ষণে যে খট্ খট্ আবাজ করছিল সেও চলে গেছে৷ তখন তাঁরা আবার পরামর্শ করতে লাগলেন –– কী করা যায়? অনেক ভেবে–চিন্তে আবার বললেন –– ‘‘হাত, আমাদের ছেলেকে ফিরিয়ে দাও’’৷ রাতের বেলায় তারা দেখলেন যে একটা আস্ত নরকঙ্কাল তাঁদের দিকে এগিয়ে আসছে৷ তাই দেখে তাঁদের মনে বেশ ভয় জাগল৷ তখন তাঁরা আবার বললেন – ‘‘হাত, আমরা ছেলেকে ফেরৎ চাই না, ফেরৎ চাই না’’৷ এইভাবে তিনটি বর তাদের ফুরিয়ে গেল৷

মানুষ জানে না যে সে কী চায়৷ তার একটা জিনিসই চাওয়া উচিত বা বলা উচিত –– ‘হে পরমপুরুষ, বাস্তবে তুমি তো আমারই, তাই তুমি আমাকে এমন ৰুদ্ধি দাও যেন আমি অনুভব করতে পারি যে তুমি আমার’৷ মানুষ যখন এটা অনুভব করে যে পরমপুরুষ কেবল তারই বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি সেই অবস্থায় তার পক্ষে পাওয়ার বাকি আর কিছু থাকে না৷ সবই তখন তার করায়ত্ত৷ কেন পাওয়া হয়ে যায়?  –– না, এই ৰিশ্বৰ্রহ্মাণ্ডে যা কিছু রয়েছে, সবই তো পরমাত্মায় লীন হয়ে রয়েছে, তাঁতে স্থিত হয়ে রয়েছে৷ তিনি তো সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা৷ আর শেষ পর্যন্ত সবকিছু তাঁতেই লীন হয়ে যায়৷ সে পরমাত্মাকে পেয়ে গেল, মানে পরমাত্মা তাঁর হয়ে গেলেন৷ বাস্তবে পরমাত্মা সকলেরই, প্রতিটি জীবের বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি৷ তবুও মানুষ তো এটা ৰোঝে না৷ পরবর্তীকালে ভক্তি ভাবের জাগরণ ঘটলে মানুষ যখন উপলব্ধি করে যে এই পরমাত্মা তার এক অমূল্য বৈয়ষ্টিক সম্পত্তি তখন তারপক্ষে পাওয়ার অবশিষ্ট আর কিছু থাকে না৷ তাই মানুষের যেটা সত্যিকারের প্রয়োজন তা হ’ল –– ‘‘হে পরমাত্মা, তুমি আমাকে এমন ৰুদ্ধি দাও যেন আমি উপলব্ধি করতে পারি যে তুমি আমারই’’৷ মানুষের কেবলমাত্র এইটাই চাওয়া উচিত৷ এছাড়া আর সে যা কিছু চায় সেটা তার নিতান্তই বাজে চাওয়া৷

২৭ জুন ১৯৮০, সহরসা