পরমপুরুষের স্বগতোক্তিটি কী? –না, সেই স্বগতোক্তি হচ্ছে ঃ
‘ময্যৈব সকলং জাতং ময়ি সর্বং প্রতিষ্ঠিতম্৷
ময়ি সর্বং লয়ং জাতি তদ্ ৰ্রহ্মাদ্বয়মস্ম্যহম্৷’
সব কিছু আমার থেকে উদ্ভূত হয়েছে, সব কিছু আমাতেই স্থিত রয়েছে, সব কিছু আমাতেই লীন হচ্ছে৷
‘ময্যৈব সকলং জাতং’৷ সব কিছু আমার থেকে সৃষ্ট হচ্ছে৷ অর্থাৎ তিনি চেয়েছিলেন যে তাঁর মনের মধ্যেই কিছু সৃষ্ট হোক, তাঁর মনের ভেতরেই একটা ভাবজগৎ তৈরী হোক, অর্থাৎ তিন তাঁর মানস কল্পনায় একটা বিশ্বসৃষ্টি রচনা করুন৷ আর তার ফলেই তৈরী হ’ল এই পরিদৃশ্যমান বিশ্ব৷
পরমপুরুষ এমনটাই চেয়েছিলেন৷ কেন চেয়েছিলেন দার্শনিকরা সে সম্পর্কে কোন যুক্তি খুঁজে পান না৷
এখন প্রশ্ণ হ’ল, কেন তিনি মনে মনে এমনটা ভাবলেন যে তিনি জগৎ সৃষ্টি করবেন? এখন, কেন পরমপুরুষ সৃষ্টি রচনা করলেন, তার সেই উদ্দেশ্য, সেই এষণা তিনি ছাড়া আর কে জানতে পারে? যাই হোক, তিনি সৃষ্টি রচনা করলেন৷ এখন দার্শনিকরা জানেন না পরমপুরুষের মনে এই ধরনের ভাবনার উদয় হ’ল কেন?
এই দিন কয়েক আগে তোমাদের একবার বলেছিলুম, দার্শনিকরা যেখানে বিফল হন, ভক্তরা সেখানে সফল হন৷ এক্ষেত্রে দার্শনিকরা অন্যকে সৃষ্টি রহস্যের সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দিতে একান্ত অপারগ৷ শুধু তাই নয় এমনকি নিজেরাও নিজেদের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট নন৷ কিন্তু ভক্তরা ব্যাখ্যা দিতে পারেন৷ কারণ, পরমপুরুষের প্রতি তাঁদের হূদয়ের অন্তঃস্তলে একটা সুগভীর অভ্যন্তরীণ ভালবাসা রয়েছে, এক অজানা গোপন প্রেম প্রীতি রয়েছে৷ তারা বলে সৃষ্টি রচনার হেতুটা কী আমরা বিলক্ষণ জানি৷ আমাদের পরম প্রভু, পরমপুরুষ ছিলেন সম্পূর্ণ একলা৷ দেখনা, একটা বাড়ীতে তোমাকে যদি সম্পূর্ণ একলা থাকতে হয়, তুমি পাগল হয়ে যাবে৷ এখন, কাউকে যদি অনন্তকাল বিশ্বে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ থাকতে হয় তাহলে ভাব তো তার অবস্থাটা কী দাঁড়াবে
‘স বা এষ তদা দ্রষ্টা ন পশ্যদ্দৃশ্যমেকরাট্৷
মে নে সন্তমিবাত্মানং সুপ্তশক্তিরসুপ্তদৃক্৷৷’
পরমপুরুষ একলাই ছিলেন৷ তাঁর দেখবার, শুণবার, আঘ্রাণ নেবার, কথা বলবার, সব কিছু করবার শক্তি–সামর্থ্য ছিল কিন্তু বিশ্বে দ্বিতীয় আর কোন সত্তাই যে ছিল না৷ কার সঙ্গে তিনি কথা বলবেন? কাকেই বা ভালবাসবেন? কাকেই বা বকাঝকা করবেন? বলবেন, /খোকা, তুমি এমনটা করলে কেন? তোমার শাস্তি পাওয়া উচিত নয় কি? তোমার অবশ্যই শাস্তি হওয়া উচিত৷’
কিন্তু সে সময় তিনি কাউকেই শাস্তি দিতে পারেন নি কেননা কেউ ছিল না যে৷ তিনি ছাড়া কিছুই ছিল না, কেউই ছিল না, তাই ভালবাসবেন বা শাস্তি দেবেন কাকে? আমি ‘ঘৃণা করা’–র ড়্ত্রব্ধন্দ্বগ্গ কথা বলিনি কারণ পরমপুরুষ কাউকে ঘৃণা করতে জানেন না৷
পরমপুরুষ দু’টো কাজ করতে পারেন না৷ প্রথমতঃ তিনি কাউকে ঘৃণা করতে পারেন না, আর দ্বিতীয়তঃ তিনি তারই মত আর একটি পরমপুরুষ সৃষ্টি করতে পারেন না৷ অনন্তকাল ধরে তিনি একক ও অদ্বিতীয় সত্তাই থেকে যান৷
তাই তাঁকে মনের ভেতরেই বিশ্ব রচনা করতে হয়েছিল, মানস কল্পনায় জগৎ সৃষ্টি করতে হয়েছিল৷ এই জন্যেই তাঁর এই স্বগতোক্তি–‘ময্যৈব সকলং জাতং৷’
‘ময়ি সর্বং প্রতিষ্ঠিতম*৷ সৃষ্টির পর তাঁর সেই স্ব–সৃষ্ট সংরচনাকে পালন–পোষণ করতে হবে, সংরক্ষণ–সম্ভরণ করতে হবে৷ তিনি ছাড়া আর কে এ কাজ করবেন, কে এই গুরুদায়িত্ব নেবে? এই বিশ্বসৃষ্টির দেখাশোণার জন্যে যেহেতু আর কোন দ্বিতীয় অভিভাবক নেই, স্বভাবতই তাঁর সৃষ্ট সংসার তাঁকেই দেখাশোনা করতে হবে৷ পালন–পোষণের এই বিরাট দায়িত্বভার, সংরক্ষণ–সম্ভরণে এই মহান দায়দায়িত্ব তাঁকেই বহন করতে হবে৷
‘ময়ি সর্বং লয়ং যাতি*৷ তোমরা জান, বিশ্বের সব কিছু চলে চলেছে৷ এই বিশ্বৰ্রহ্মাণ্ড এক পরিবর্ত্তনশীল দৃশ্যপট, এক চলমান বাস্তবিকতা, এক দ্রুত বিবর্ত্তনশীল আলেখ্য মাত্র৷ যেহেতু পরমপুরুষের মানসকল্পনাতরঙ্গ এগিয়ে চলেছে, এই বিশ্বসৃষ্টিও পরিবর্তিত হয়ে চলেছে, সব কিছুই সতত অস্থিরভাবে চলে চলেছে৷ সংস্কৃতে এই জগৎকে ভ্রপ্সব্জপ্তস্তুগ্গ বলা হয় ‘সংসার’ (সম–সৃ ঘঞ) যার মানে যা স্বভাবগত ভাবে সরে চলেছে৷ আবার এর আর এক নাম ‘জগৎ’ (গম্ ক্কিপ্) যার মানে যা চলৎ, গতিশীল, জঙ্গম৷ তাই এখানে সব কিছু এগিয়ে চলেছে কারণ ভূমামনের কল্পনাপ্রবাহ বয়ে চলেছে৷ এই যে কল্পনাতরঙ্গ, এরা এগিয়ে চলে সঙ্কোচ–বিকাশী ব্দম্ভব্দব্ধ্ত্রপ্তব্ধ, হ্মব্ভপ্তব্দ্ত্রব্ধন্ল ধারায়৷ এই যে চলমানতার গতিপথে সৃষ্ট সত্তারা, এরা শেষ পর্যন্ত পৌঁছবে কোথায়? –না, গতিপথের শেষ প্রান্ত সেই সৃষ্টিকর্ত্তা পরমপুরুষে পৌঁছে তাতেই তারা মিশে যাবে৷ যেখান থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল সেখানেই তারা ফিরে যাবে৷ সকল জীবের, সকল সত্তার চলার পথের আদি বিন্দুও সেই পরমপুরুষ, অন্তিম বিন্দুও সেই একই পরমপুরুষ৷ তাই তাঁর স্বগতোক্তি হচ্ছে /ময়ি সর্বং লয়ং যাতি*৷ সব কিছু আমাতেই ফিরে আসে৷ আমি ছাড়া কোন বিকল্প গন্তব্যস্থল নেই৷ /নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেয়নায়*৷ এটাই একমাত্র পথ–এই বৃত্তাকার মার্গ যার নাম ৰ্রহ্মচক্র(Cosmological order)৷
‘তদ্ ৰ্রহ্মাদ্বয়মস্ম্যহম্’৷ এইটাই আমার স্বভাব৷ এরা সবাই আমার সৃষ্টি৷ আমি সৃষ্টি, সংরক্ষণ–সম্ভরণ, পালন–পোষণ ও অবশেষে নিজেতেই সব কিছুকে সংহরণ কর্মে লিপ্ত আছি৷ এই আমার কর্ত্তব্য–কর্ম আর এই কর্ত্তব্য–কর্মের জন্যেই আমি ‘ৰ্রহ্ম’ নামে আখ্যাত৷ আমি এক ও অদ্বিতীয় সত্তা৷ দুই ৰ্রহ্মের কল্পনা অবান্তর–দুই পরমপুরুষের ভাবনা অভাবনীয়৷
আমার দু’টি অপূর্ণতা রয়েছে–এক ঃ আমি আমারই মত আর একটি পরমপুরুষ সৃষ্টি করতে পারি না, যে আমাকে ভালবাসে, যে আমার ভজনা করে সে আমাতেই লীন হয়ে যায়, আমাতেই মিলেমিশে এক হয়ে যায়৷ তার পৃথক অস্তিত্ব সে আর বজায় রাখতে পারে না৷ তাই সত্তাগত বিচারে আমি এক ও অদ্বিতীয় থেকেই যাই৷ দ্বিতীয়তঃ, যেহেতু সবাই, সব কিছুই আমার দ্বারা সৃষ্ট, কাজেই সকলেই আমার সন্তান৷ তাই আমি কাউকেই ঘৃণা করতে পারি না৷
আমি সদা সর্বদাই সৃষ্টি, স্থিতি ও সংহার কর্মে ব্যাপৃত থাকি, বিশ্রাম নেবার আমার অবকাশ নেই৷
(পটনা, ১২ই সেপ্ঢেম্বর, ১৯৭৮)