পরমপুরুষের একটি নাম হচ্ছে ‘জগদ্বন্ধু’৷ কেন তাঁকে জগদ্বন্ধু বলা হয়? সংস্কৃত ভাষায় ‘জগৎ’ শব্দ ‘গম’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয়েছে৷ ‘গম্’ মানে যাওয়া৷ ‘জগৎ’ মানে চলা বা যাওয়া যার স্বভাব৷ এখানে চলা বা যাওয়াটাই শব্দটার মুখ্য ভাব৷ এই বিশ্বের সব কিছুই চলছে৷ কোনো কিছুই স্থির নয়৷ এমনকি ধ্রুবতারা পর্যন্ত স্থির নয়৷ সব কিছুই ঘুরছে৷ কাজেই বিশ্বকে বলা হয় জগৎ৷ পরমপুরুষ হচ্ছেন জগতের বন্ধু৷
‘ৰন্ধু’ মানে কী? সংস্কৃত ভাষায় ‘বন্ধ্’ ধাতুর অর্থ হচ্ছে বেঁধে ফেলা৷ ‘ৰন্ধু’ মানে সেই ব্যষ্টি বা সেই সত্তা যে বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না৷ পরমপুরুষ বা সগুণ ব্রহ্ম এই ব্যক্ত জগতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত হয়ে আছেন তিনি প্রতিটি ব্যক্ত সত্তার সঙ্গে ওতপ্রোতযোগে যুক্ত আছেন---তা প্রাণীই হোক আর অপ্রাণীই হোক৷ আবার সামগ্রিকভাবেও তিনি সমগ্র বিশ্বের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত আছেন৷ সুতরাং তিনিই এই জগতের একমাত্র বন্ধু৷ অন্যান্য জাগতিক বন্ধুরা কেউই তোমার চিরদিনের বন্ধু নয়৷ তারা তোমার সঙ্গে আছে বটে কিন্তু একদিন অবশ্যই আসবে যেদিন তোমাদের মধ্যে বিচ্ছেদ হবে৷ যখন তুমি এই পৃথিবী ত্যাগ করে যাবে তখন তোমার সব মর্ত্যবাসী বন্ধুরা তোমার দেহের অনুগামী হবে৷ কতদূর পর্যন্ত? ---না, শ্মশানভূমি পর্যন্ত৷ তারপর তারা নিজের নিজের ঘরে ফিরে যাবে৷ কাজেই তারা তোমার বন্ধু নয়৷
সংস্কৃত ভাষায় একটি শ্লোক আছে---
‘অত্যাগসহনো বন্ধুঃ সদৈবানুমতঃ সুহৃদ্
একক্রিয়ং ভবেন্মিত্রং সমপ্রাণাঃ সখা স্মৃতঃ’৷৷
যার ভালবাসা এত প্রবল যে সে কিছুতেই বিচ্ছেদ সহ্য করতে পারে না, তাকে বন্ধু বলা হয়৷ এই পৃথিবীতে কারও আর কোনো বন্ধু থাকতে পারে না৷ শুধু সেই জগদ্বন্ধু পরমপুরুষই একমাত্র ‘বন্ধু’৷ আর কেউই তোমার বন্ধু নয়৷ তিনিই একমাত্র বন্ধু৷
‘‘সদৈবানুমতঃ সুহৃদ’’৷ এর মানে হচ্ছে, যেখানে মতের কোনো পার্থক্য নেই অর্থাৎ কিনা আদর্শণত মতবিভেদ যার সঙ্গে থাকে না সে-ই হচ্ছে ‘সুহৃদ’ এই পৃথিবীতে তুমি কোনো সুহৃদ পেতে পার না৷ এমনকি এক পরিবারে ভাই-বোন, মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যেও কত মতপার্থক্য ঘটে৷ কাজেই পরিবারে বা সমাজে কেউই তোমার সুহৃদনয়৷
‘একক্রিয়ং ভবেন্মিত্রম্ঃ’৷ একই ধরনের কর্ম করা হয় যার সঙ্গে, সংস্কৃত ভাষায় তাকে বলে ‘মিত্রম্’৷ এর ইংরাজী প্রতিশব্দ হচ্ছে ‘কোলিগ’ colleague)৷ এই পৃথিবীতে সহকর্মী তুমি অনেক দেখতে পাবে৷ দু’জন চিকিৎসক মিত্রম্ অর্থাৎ সহকর্মী৷ দু’জন আইনজীবী মিত্রম অর্থাৎ সহকর্মী৷ কিন্তু এই সহকর্মীরা ততদিনই তোমার সঙ্গে থাকবে যতদিন তুমি সশরীরে এই পৃথিবীতে বর্তমান থাকবে৷ আর, তুমি যখন এই শরীর ত্যাগ করবে, যখন তোমার মানসসত্তা ও দেহের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটবে তখন তোমার সেই সহকর্মীরা কেউই তোমার সঙ্গে থাকবে না৷ যতদিন পর্যন্ত তোমার মনটা দেহের খাঁচার মধ্যে আছে ততদিন পর্যন্ত তারা তোমার সঙ্গে আছে৷ সুতরাং তুমি এই পৃথিবীতে সহকর্মী বা মিত্রম পেতে পারো কিন্তু তারা চিরদিনের ‘মিত্রম্’ নয়৷
সংস্কৃত ভাষায় ‘মিত্র’ শব্দ যেখানে ক্লীবলিঙ্গ অর্থাৎ ‘মিত্রম্’ হয় সেখানে এর অর্থ হয় সহকর্মী, আর যেখানে পুংলিঙ্গ অর্থাৎ ‘মিত্রঃ’ হয় সেখানে এর অর্থ সূর্য৷
‘‘সমপ্রাণাঃ সখা স্মৃতঃ’’৷ যেখানে ভালবাসা এত প্রবল যে দু’টো শরীরে একটাই সত্তা আছে বলে প্রতীত হয়, সেখানে তাদের ‘সখা’ বলা হয়৷ ভক্ত পরমপুরুষের সখা৷ কেন না, সে তার পৃথক অস্তিত্বের কথা ভাবতেই পারে না—একদম ভুলে যায়৷ সেই জন্যেই পরমপুরুষ ভক্তের সখা আর ভক্তও পরমপুরুষের সখা৷ সেই কারণেই গীতায় অর্জুন কৃষ্ণকে সখা বলে সম্বোধন করছেন আর কৃষ্ণ ও অর্জুনকে সখা বলে সম্বোধন করছেন৷
তোমাদের জানা উচিত, তোমাদের মনে রাখা উচিত যে এই বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডে তোমাদের একমাত্র হিতৈষী, একমাত্র মিত্র ও একমাত্র সখা হচ্ছেন সেই পরম সত্তা৷ তোমাদের উচিত জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রে সেই একমাত্র ৰন্ধুর হাত শক্ত করা৷ ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৮, কলিকাতা