প্রসঙ্গ পোস্ত চাষ ঃ এতদিনে মুখ্যমন্ত্রীর টনক নড়লো

লেখক
অসিত দত্ত

তৎকালীন অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার সদর মেদিনীপুর শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে শাল মহুয়ার অন্যান্য গাছের বিশাল বান৷ তারই একদিকে  জঙ্গল ঘেরা কয়েকটি গ্রাম৷ সেই  গ্রামের অধিবাসীরা খুবই গরীব৷ চাষের জমি যাদের ছিল সেরকম সম্পন্ন গৃহস্থও ছিলো৷ গরীব অধিবাসীদের ঘরের মেয়ে-বৌ-বিধবারা সকালবেলা জঙ্গলে ঢুকে শালপাতা তুলতো৷ কেউ কেউ শুকনো ডালপালা কাঠ সংগ্রহ করতো৷ তারপর পাতার বোঝা বানিয়ে কাঠের পাঁজা বেধে তারা শহরে আসতো৷ ঘুরে ঘুরে  পাতা, কাঠ বিক্রী করতো৷ বিকেলে তারা ঘরে ফিরে আসতো৷ ঘরে ফেরার পথে সবাই দলবেধে মুদি দোকানে যেতো৷ সেখানে এক পয়সায় সর্ষে-পোস্ত এক পয়সা, জিরে ধনে, সরষের তেল, হলুদ মুসুর ডাল, চাল ইত্যাদি বিক্রয়লব্ধ অর্থ থেকে সাধ্যমতো কিনতো, সে তবলা গামছার দুদিকে পুটলী বেঁধে কাঁধে ফেলে বাড়ী ফিরতো৷ তখন নয়া পয়সা যা এখনকার পয়সা তা চালু হয় নাই৷ ফলে পুরানো একপয়সায়  সর্ষেপোস্ত এবং  পুরোনো পয়সাতে সওদা করতো৷ পরে নয়া পয়সা অর্থাৎ এখনকার পয়সা চালু হল৷ এই নয়া পয়সা অর্থাৎ এখনকার পয়সা গরীব মানুষেরা ৫ পয়সা ১০ পয়সার পোস্ত কিনতো৷ সেটা  অনেকটাই হোত৷ সেই পোস্ত দিয়ে আলু পোস্ত, ঝিঙ্গে পোস্ত, কুঁদরী পোস্ত ইত্যাদি যেমন সবজি জুটতো তাই দিয়ে তরকারী রাঁধা হোত ও তৃপ্তির সঙ্গে খেত৷ অনেক বছর আগে থেকে এটা চলে আসছিল৷ গরীব মানুষের খাবারে পোস্ত থাকতো৷ অপেক্ষাকৃত নিম্ন মধ্যবিত্তরা দৈনন্দিন খাবারের তালিকায় পোস্ত ব্যবহার করতো৷ কারন পোস্ত যথেষ্ট সস্তা ছিল,  বড় লোকেরা খুব একটা পোস্ত ব্যবহার করতো না৷ অনেক বৃদ্ধবৃদ্ধাদের দেখেছি তারা পোস্ত ঘোলা কিনে এনে ভিজিয়ে রাখতো সকাল বেলা সেই পোস্তখোলার জল খেতো৷ এতে  নাকি তাদের জ্বরজ্বালা, বাত-ব্যথা বেদনা কর্মে যেত৷ কিছু কিছু মুদি দোকানে বস্তা ভর্ত্তি পোস্ত খোলা থাকতো সেগুলো বিক্রি হতো৷ এটা নাকী আফিংয়ের বিকল্প ছিল৷ তখন আফিংয়ের কন্ট্রোল শুরু হয়েছে৷ ডাক্তারের সার্টিফিকেটে আফিংয়ের জন্য রেশন কার্ড হোত৷ সেই রেশন কার্ড নিয়ে লাইসেন্স প্রাপ্ত আফিংয়ের দোকান থেকে  আফিং কিনতে হতো৷ অবশ্য অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এই আফিং সেবন করতো৷ দরিদ্র মানুষেরা পোস্ত খোলা ভিজিয়ে তার জল খেত৷ এভাবে চলতে চলতে একসময় দেখা গেল পোস্তর দাম ক্রমশ উর্দ্ধমুখী হচ্ছে৷ হতে হতে একসময় তা দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেল৷ গরীবরা আর সহজে পোস্ত কিনতে পারছে না৷ পোস্তর দাম  উর্দ্ধমুখী হওয়ায় তা অবস্থাপন্ন পরিবারের হেঁসেলে ঠাঁই পেল৷ এখন পোস্ত বড়া, আলু পোস্ত, পটল পোস্ত, বাটা মাছের পোস্ত, চিংড়ি পোস্ত ইত্যাদি অনেক রেসিপি পোস্ত দিয়ে  হয় ও বড় লোকেরা রসাস্বাদন করেন৷ গরীব লোকের ঘরে মাঝে মাঝে পোস্ত  ঢোকে৷ অতিথি অভ্যাগত এলে তাদের জন্য পোস্তর কোন তরকারী হোত৷ চাষীদের অনেকে নিজেদের খাবার জন্য  খানিকটা জমিতে পোস্ত চাষ করতো৷ নিজেরা ব্যবহার করে উদ্বৃত্ত পোস্ত বিক্রী করতো৷ শোনা যায় ঐ সব পোস্ত গাছের ফলটা চিরে দিয়ে রেখে দিলে তার গায়ে রস জমে৷ সেই রস চেঁছে নিয়ে  ব্যবসাদাররা নিয়ে যেত৷ তা থেকে নাকী আফিং ড্রাগ ইত্যাদি  হবে৷ এক কথায়  পোস্ত গাছ থেকে নেশার দ্রব্য তৈরী হত পোস্তর দাম উর্দ্ধমুখী হওয়ায় অনেকে পোস্তচাষ  করার উৎসাহী হয়ে কিছু জমিতে পোস্ত চাষ করতে শুরু করলো৷ ব্যবসা করার জন্য৷ সেটা অনেক আগের কথা৷ কিন্তু তারপরই   পোস্ত চাষে এলো সরকারী কোপ৷ আবগারী ডিপার্টমেন্টের লোকে  পুলিশ সঙ্গে নিয়ে পোস্ত চাষের  জমি খুঁজে খুঁজে সেখানে মাঠে নেমে নির্বিচারে পোস্তগাছগুলি কেটে ফেলতে লাগলো৷ এটা মেদিনীপুর, পুরুলিয়ার বাঁকুড়া ও অন্যান্য জেলায় ঘটে চললো৷ পোস্ত চাষীদের গ্রেপ্তার ও করা হত৷ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের জ্ঞাতসারেই এগুলো ঘটে চলতো৷ কিন্তু কেউ কোন প্রতিবাদ করতো না৷ বামফ্রন্ট আমলেও এইভাবে পোস্তচাষীদের উপর  যারা লুকিয়ে পোস্ত চাষ করতো তারে উপর ও এধরণের অত্যাচার চলতো৷ কিন্তু আমরা বাঙালী এর প্রতিবাদ করে বিভিন্ন জেলায় প্রতিবাদ সংঘটিত করেছে৷ বছরের পর বছর ধরে আমরা বাঙালী সরকারী নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে পোস্ত চাষের অধিকার দিতে হবে এই দাবীতে আন্দোলন করে চলেছে৷ অবস্থান কর্মসূচীও করা হতে লাগলো৷ বার বার  রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও কেন্দ্রের সরকারের নিকট প্রতিবাদ সহ স্মারকলিপি পেশ করতো৷ কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা! কোন ফল হত না৷ এমনকি আমরা বাঙালীর আন্দোলনকারীদের স্মারকপত্রের উত্তরে কোন সৌজন্যমূলক প্রাপ্তি স্বীকার করা হয় না৷ আন্দোলন কিন্তু চলতেই থাকে৷

গত ২৯শে অক্টোবর,২০১৪ তারিখে ব্যষ্টিগতভাবে নার্র্কেটিকস্‌ কমিশনার, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব নার্র্কেটিকস্‌, গোয়ালিয়ার, মধ্যপ্রদেশ এর নিকট একজন সাংবাদিক হিসেবে একটি পত্রে দেই৷ সেই পত্রে বলা হয়েছিল বাঙালী জনগোষ্ঠী বিশেষত দক্ষিণবঙ্গ, মালদার, মুর্শিদাবাদ প্রভৃতি এলাকায় যারা বসবাস করেন পপি সিড, (পোস্ত দানা) তাদের  একটি অন্যতম প্রধান খাদ্য, সুতরাং এই এলাকায় ঐ দপ্তরের তত্ত্বাবধানে পপি সিড্‌ চাষ করার জন্য অনুমোদন দেয়া হোক৷ তার উত্তরে সহকারী নার্র্কেটিকস্‌ কমিশনার পত্র নংXVIO (23) OP Sell /2014-55  তাং ১৩.১১.২০১৪ মারফৎ জানান যে অপিয়াম কাল্টিভেশন লাইলেন্স কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান এবং উত্তর প্রদেশের চাষীদেরই কেবল দেওয়া হয়৷ পশ্চিমবঙ্গ এই বিজ্ঞপ্তির আওতায় নেই তাই পশ্চিমবঙ্গে অপিয়াম চাষের লাইসেন্স দেওয়া হবে না৷ উপরন্তু  যদি কেউ চাষ করেন তবে এন.ডি.পি.এস অ্যাক্ট ১৯৮৫, অনুযায়ী আইন মোতাকে জেল, জরিমানা করা হবে৷

পুনরায় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, নার্র্কেটিকস্‌ কমিশনার, সেন্ট্রাল ব্যুরো অব নার্র্কেটিক্‌স এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী, অরুণ জেঠলী, তাদের উদ্দেশ্যে ৭.০৩.২০১৫ তারিখে আর একটি পত্র লেখা হল৷ এই পত্রের সঙ্গে ১৩.১১.২০১৪ তারিখে অ্যাসিঃ নার্র্কেটিক্‌স কমিশনারের প্রেরিত পত্রের কপি সকলকে পাঠানো হল৷ ঐ পত্রসমূহে আর একটু বিস্তৃত করে লেখা হল যে নার্র্কেটিকস্‌ কমিশনার অপিয়াম কাল্টিভেশন ও পপী কাল্টিভেশন (পোস্ত দানা) এ দুয়ার পার্থক্য জানেন না বা বোঝেন না৷ পপি কাল্টিভেশনের  কথা বলা হয়েছে৷ ঐ পত্রে আরো লেখা হোল পোস্ত দানা চাষ করার অনুমতি দিলে? হাজার হাজার  চাষী অর্থনৈতিক ভাবে উপকৃত হবে৷

পপী সিড চাষ করার সুযোগ পেলে কর্মসংস্থান বাড়বে৷ অন্যদিকে  বহু সরকারী কর্মচারী এই চাষ পর্যবেক্ষণ ও বে-আইনী অপিয়ান নিষ্কাশন প্রতিরোধের কাজে নিযুক্ত হবে৷ কেমিক্যালস্‌ ও মেডিসিন তৈরীর অনেক শিল্প গড়ে উঠবে যার ফলে কর্মসংস্থান বাড়বে৷ এই এলাকায় পোস্ত চাষ করলে পোস্তর  মূল্য অনেক কমে যাবে এবং সাধারণ মানুষ সস্তায় পোস্ত  খেতে পারবে৷ কেমিক্যাল এবং ওষুধ যদি কঠোর তদারকিতে তৈরী হয় তবে সমাজ খুব উপকৃত হবে৷ লাইসেন্স ফি, কেমিক্যাল উৎপাদন বাবদ যে কর ধার্য্য হবে তাতে সরকারী তহবিল পুষ্ট হবে৷ ঐ পত্রে বলা হয়েছে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশে যদি সরকারী তত্ত্বাবধানে পোস্ত চাষ হতে পারে তবে পশ্চিমবঙ্গে তা সম্ভব নয় কেন? পরিশেষে বলা হয়েছে অপিয়ামের বে-আইনী উৎপাদন থেকে বিভিন্ন ধরণের ড্রাগ উৎপাদন হতে পারে যা আদৌ সমাজের পক্ষে মঙ্গলময় নয় বরং যথেষ্ট ক্ষতিকর৷ এটা কখনোই কারোর কার্য হতে পারে না৷ এজন্য কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার৷ যে ছুরি দিয়ে মানুষ খুন করা যায় সেই ছুরি দিয়েই রোগী অস্ত্রোপচার করা যায়৷ আসলে ছুরির ব্যবহারের উপর সব নির্ভর করে৷ পপী সিড ও এই দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ন্ত্রণ দরকার৷ যে ছুরি দিয়ে মানুষ খুন করা যায় সেই ছুরি দিয়েই রোগীর অস্ত্রোপচার করা যায়৷ আসলে ছুরির ব্যবহারের উপর সব নির্ভর করে৷ পোস্ত দানাও ও এই দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখে মানুষের   কল্যাণের কাজে লাগানো যেতে পারে৷

উপরোক্ত পত্রের উত্তর প্রধানমন্ত্রী, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নিকট থেকে পাওয়া যায়নি৷ কেবলমাত্র রাষ্ট্রপতির  দপ্তর থেকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ঐ পত্র পাঠালে অর্থ দপ্তরের রেভেনিউ দপ্তর  থেকে আণ্ডার সেক্রেটারী, একটি উত্তর পাঠান তাতে নার্কেটিকস্‌ কমিশনারের পূর্বের প্রেরিত ১৩ই নভেম্বর, ২০১৪ তারিখের পত্রের উল্লেখ করে একই কথা অর্থাৎ মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান এই তিনটি রাজ্য ছাড়া আর কোথাও পপী সিড উৎপাদন করার কোন প্রস্তাব নেই বলে জানানো হয়৷ গত লোকসভা নির্বাচনে উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্রমোদী একবার মেদিনীপুর এসেছিলেন৷ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার তৎকালীন আমরা বাঙালীর জেলা সম্পাদক শঙ্কর প্রসাদ কুণ্ডু  প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাজ্যে পোস্ত চাষের উৎপাদন করার অনুমতি প্রার্থনা করে একটি স্মারকলিপি দেন৷ কিন্তু দুর্ভাগ্য তাতে রাজ্যে পপী সিড উৎপাদন করার অনুমোদনের বিষয়টিও কোন গুরুত্ব পায়নি৷ কিন্তু আমরা বাঙালীর আন্দোলন কিন্তু চলতে থাকলো৷

এতদিনে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর  টনক নড়েছে তিনি যখন কেন্দ্রে ছিলেন তখন আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এ সমস্যার সমাধান করতে পারতেন৷ বামফ্রন্ট সরকার বা কংগ্রেসী নেতারা কোন  চেষ্টাই করেননি৷ তবুও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ নিয়ে চিন্তা করছেন সেটা সুখের৷ তবে আমরা বাঙালী যে আন্দোলন করছে তা চালিয়ে  যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে পোস্ত চাষের অধিকার রাজ্য না পায়৷