পৃথিবী নামক গ্রহ আর কতদিন মানুষের বাসযোগ্য থাকবে!

লেখক
জ্যোতিবিকাশ সিনহা

অতি সম্প্রতি  বিবিসি-২-এর একটি অনুষ্ঠানে বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়ম হকিং জানিয়েছেন , আমাদের নিশ্চিন্ত বাসস্থান এই পৃথিবী গ্রহ একশত বছরের কাছাকাছি সময়ে মানুষের পক্ষে বসবাসযোগ্য থাকবে না৷ জনসংখ্যার মাত্রাধিক বৃদ্ধি, ধূমকেতু ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রহাণুর আঘাত, প্রাকৃতিক পরিবেশের পরিবর্ত্তন ও ফলস্বরূপ নানাধরনের দুরারোগ্য ব্যাধি সংক্রান্ত সমস্যার কারণে পৃথিবীতে মানুষ বসবাস করতে পারবে না৷ অবশ্য তিনি ইতোপূর্বে বেশ কয়েকবার এই ধরনের মন্তব্য করেছেন ও পরামর্শ দিয়েছেন যাতে মানুষ গ্রহান্তরে নূতন ঠিকানা খুঁজে নিয়ে বসবাস করার ব্যবস্থা করে৷ এছাড়াও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কয়েক বছর ধরে একটি সংবাদ পরিবেশিত হয় যে মেরুঞ্চলের বরফ গলে গিয়ে সাগর মহাসাগর গুলির প্রচন্ড জল স্ফাীতি ঘটবে ও সমুদ্রতলের উচ্চতা এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে পৃথিবীর অনেক শহর জলের তলায় চলে যাবে৷ উপর্যুক্ত বিষয়গুলি অনেকটা গাল-গল্প মনে হলেও এটা বাস্তব যে মনুষ্যজাতির জীবনযাত্রা ও পরিবেশগত ভারসাম্য হ্রাসের ফলে মানুষ ক্রমশঃ ওই দিকেই এগিয়ে চলেছে৷ হয়তো সময় কালের কিছু হেরফের হতে পারে কিন্তু মানুষ তার অবিমৃষ্যকারিতার জন্য নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনছে৷

মানব সভ্যতার সৃষ্টি ও বিকাশ হয়েছে বিভিন্ন নদী অববাহিকার পথ ধরে--- নদী উপনদীর তীরে তীরে উর্বর ভূমিকে কেন্দ্র করে৷ পৃথিবীর বুকে মানবশিশু সৃষ্টির আগেই প্রকৃতির বনানীতে সুস্বাদু ফুলে-ফলে মূলে-কন্দে সঞ্চিত হয়েছে মানুষের খাদ্য পানীয়ের ভান্ডার৷ পরবর্ত্তীকালে বিবর্তনের পথ ধরে মেধার ক্রমোন্নয়নে মানুষ তার জীবনযাত্রাকে করেছে সহজ ও সচ্ছন্দ৷ এইভাবে নিজের বুদ্ধি ও মেধাকে কাজে লাগিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষ আজ উন্নতির চরম শিখরে উপনীত৷ মানব সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে অতিদ্রুত হারে৷ বর্ত্তমানে পৃথিবীর বিপুল জনস্ফীতি এক বিরাট সমস্যায় পরিবর্ত্তিত৷ বিশাল জনসংখ্যা বসবাসের স্থান সংকুলানের জন্য অরণ্য সম্পদ ও উর্বর ভূমি ধবংস করে জনবসতি স্থাপিত হয়েছে, দেশে দেশে অতিউচ্চ বহুতল নির্মিত হয়েছে ৷ শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য  বিস্তর জমি নষ্ট হয়েছে৷ বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্যউৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক  ব্যবহারে ধীরে ধীরে জমির স্বাভাবিক উর্বরতা হ্রাস পেয়েছে৷ নদীর তীরে তীরে গড়ে ওঠা জনবসতি, শহর-নগর থেকে নালা-নর্দমার  দূষিত জল, কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্যপদার্থগুলি নদীর জলে মিশে দূষিত করে চলেছে আর এই নদীগুলি সাগরের দিকে প্রবাহিত হওয়ার ফলে দূষণে আক্রান্ত হচ্ছে সাগর-মহাসাগরও৷  পরিণামস্বরূপ ভূপৃষ্টের জল ক্রমশঃ মানুষের ব্যবহারের  অনুপযুক্ত হয়ে চলেছে৷ চাষের কাজে ও পানীয় হিসাবে ব্যবহৃত ভূগর্ভস্থ জল অনিয়ন্ত্রিত ভাবে উত্তোলনের জন্য প্রায় নি:শেষিত৷ খনিজ পদার্থ ও বালি ভূগর্ভ থেকে উত্তোলনের পর সঠিকভাবে তলদেশ ভরাট না করার দরুন মাটির নীচে বিশাল বিশাল অঞ্চল ফাঁকা থাকছে৷ শুধু তাই নয়, বসবাসের প্রয়োজনে নির্মিত বাড়ী-ঘর, অট্টালিকা, বহুতল ইত্যাদির চাপে এইসব স্থানে ধস নামার আশঙ্কা খুবই প্রবল ও ভবিষ্যতে ওই অঞ্চলগুলি মাটির গর্ভে বিলীন হয়ে  বড় বড় হ্রদের সৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে ৷ বসবাস, শিল্প, পরিকাঠামো উন্নয়নকল্পে বনসম্পদ নির্বিচারে ধবংস করার ফলে পরিবেশগত ভারসাম্য লঙ্ঘিত হচ্ছে৷ এছাড়া প্রতিবৎসর প্রাকৃতিক কারণে দাবানলের ফলে বহু অরণ্যানী নষ্ট হচ্ছে৷ বন্যজন্তু, পশু-পাখীর দল খাদ্যের অম্বেষনে বনাঞ্চলের অপ্রতুলতায় মানুষের বসতিতে প্রবেশ করতে বাধ্য হচ্ছে ও প্রভূত ক্ষতিসাধন করছে৷ বনাঞ্চল ধবংস হওয়ার প্রভাব বৃষ্টিপাতের ওপর স্বাভাবিকভাবেই  পরিলক্ষিত হচ্ছে৷ বনানী হল মানুষের ফুসফুস স্বরূপ৷ প্রাণীকুলের শ্বাস-প্রশ্বাস নি:সৃত দূষিত কার্বন-ডাই- অক্সাইড উদ্ভিদজগত গ্রহণ করেপরিবেশে বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করে৷ মানুষের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও  বন্য সম্পদের হ্রসমানতা দূষিত-বিশুদ্ধ বায়ুর অনুপাতকে প্রভাবিত করে৷ যার ফলে জীবকুলে দেখা দেয় বিভিন্ন মারণ রোগ৷ এর সঙ্গে যুক্ত হয় কলকারখানা, যানবাহন  নির্গত ধোঁয়া ও গ্যাস যা পরিবেশকে আরও বিষাক্ত করে দেয়৷ মানুষের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ও উৎসব হুল্লোড়ে ব্যবহৃত  রাসায়নিক পদার্থ বায়ুদূষণ বাড়াতে সাহায্য করে৷ বিভিন্ন সংবাদে প্রকাশমহাকাশও জঞ্জাল  আর নানাবিধ দূষণে আক্রান্ত৷ এছাড়া দেশে দেশে পারমানবিক মারনাস্ত্রের মহড়া, রাসায়নিক ও বিষাক্ত অস্ত্র সম্ভারের ঝনঝনি পারস্পরিক বিদ্বেষ ও রেষারেষি এই সমস্যাকে প্রবলভাবে বৃদ্ধি করেছে৷

ব্যাপক পরিবেশ দূষণ ও পরিবেশগত উষ্ণায়নের ফলে  বর্ত্তমানে বৃষ্টিপাত অনিয়মিত, মেরুপ্রদেশের বরফ ক্রমে ক্রমে বিগলিত, জল স্থল অন্তরীক্ষ মানুষের প্রায় আবাসযোগ্য, পানীয় জলের সম্ভার প্রায় বিলুপ্তির দিকে, প্রাণীকুলের মধ্যে আনুপাতিক সামঞ্জস্য বিঘ্নিত, অতিমাত্রায় দুরারোগ্য মারণ ব্যাধিতে মানুষ আক্রান্ত৷ এই পরিণতির বিষয়ে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদগণ বিভিন্ন  আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সম্মেলনে বারবার সর্তক করে চলেছেন৷ কিন্তু মানুষ সমাজ , সামগ্রিকভাবে এখনো সচেতন হয়েনি, ও যথাযথ ব্যবস্থা অবলম্বন করেনি৷ ব্যপক বনসৃজন, জল-বায়ু-পরিবেশ দূষণরোধে যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ, বর্ষণ প্রাপ্ত  আকাশের জলের বিজ্ঞানসম্মত  সংরক্ষণ, ভূসম্পদ ও বনজসম্পদের যথোচিত সদ্ব্যবহার, প্রাকৃতিক পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় সক্রিয়ভাবে উদ্যোগী না হলে হয়তো বিজ্ঞানী স্টিফেন উইলিয়ম হকিং-এর আশঙ্কাই একদিন সত্যি হয়ে উঠবে৷ তাই মনুষ্যজাতির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় যথোপযুক্ত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণই আজকের যুগের দাবী৷