পৃথিবীর জলসম্পদের সংরক্ষণ

Baba's Name
শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকার

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সর্বশ্রেষ্ঠ সেচ পদ্ধতি

সেচের জন্যে সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হ’ল –– পুকুর–খাল–বাঁধ, জলাশয়, আর জলাধারের মাধ্যমে ভূ–পৃষ্ঠের জলকে সংরক্ষণ করা৷

রাা ও ওড়িষ্যার উদাহরণ নেওয়া যাক্৷ এই দুই অঞ্চলের সম্ভাবনাকে ঠিকমত কাজে লাগানো হয়নি বা তার উপযুক্ত বিকাশেরও ব্যবস্থা করা হয়নি৷ এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় সম্পদ হ’ল ভূ–গর্ভস্থ সম্পদ যা ঠিকমত ব্যবহারে আনা উচিত ছিল, কিন্তু বাস্তবে এ সম্পর্কে কিছুই করা হয়নি৷ জমির ক্ষমতাকেও যথোপযুক্ত ভাবে কাজে লাগানো উচিত ছিল, কিন্তু তাও অবহেলার শিকার হয়ে রয়ে গেছে৷

এই অঞ্চলের ভূ–পৃষ্ঠস্থ জলের সম্ভাবনাকে কিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে? এই অঞ্চলের বৃষ্টিপাত খুবই কম, বছরের একটা সময় শুধু বৃষ্টি হয়, বাকী সময় শুকনো থাকে৷ নলকূপেরও ব্যবস্থা নেই বললেই চলে৷ আর তোলা সেচ বা খাল–নালার মাধ্যমে সেচেরও অবস্থা তথৈবচ৷ শতকরা ৬৫ ভাগ জমি পাথুরে ও বালু যুক্ত৷ মোটা দানার কিছু শস্যই এই মাটিতে হতে পারে৷ তাই রােে আমাদের দু’টি জিনিস অবিলম্বে করতে হবে –– ছোট ছোট অনেক পুকুর, বাঁধ, সায়র তৈরী করতে হবে, আর সব নদী–জোড়–নালার দুই পাশে ব্যাপক বনসর্জন করতে হবে৷ রাা হ’ল তরঙ্গায়িত মাটির দেশ৷ তাই বড় বড় জলাধার এখানে সহজে তৈরী করা সম্ভব হবে না, কিন্তু ছোট ছোট অনেক সায়র ও পুকুর তৈরী করা যাবে৷ ছোট ছোট পুকুরের তুলনায় বড়  ও গভীর জলাধার কোনো উপকারে আসবে না৷ তাই এই প্রয়াসকে উৎসাহ দিয়ে লাভ নেই৷ তাছাড়া বড় জলাধার মানেই হ’ল জল অনেক ওপরে তুলে খাল/নালার মাধ্যমে জমিতে পঁৌছনোর ব্যবস্থা করতে হবে৷ রােে এই ব্যবস্থায় জলের চাপ কম হবে কেননা জল জলাধার থেকে খালের মাধ্যমে পৌঁছাবার সময়ে দেখা যাবে উঁচু নিচু পাহাড়ী জমিতে খাল বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে৷ তাই বড় বড় জলাধার তৈরী করতে বিশাল অঙ্কের অর্থ লগ্ণী করলে তা ব্যর্থ হতে বাধ্য৷ অথচ সেই একই অর্থে অনেক ছোট পুকুর ও সায়র তৈরী করা যাবে৷ প্রতিটির জন্যে লাখ টাকা খরচ ধরে যদি অনেক ছোট ছোট বাঁধ ন্তুড়ন্দ্বন্তুন্স স্তুত্রপ্পব্দগ্গ তৈরী করা হয় তা হলে দেখা যাবে যে এগুলি থেকে কোটী কোটী টাকার প্রতিদান পাওয়া যাচ্ছে৷

ছোট ছোট পুকুর বা বাঁধের ক্ষেত্রে হয় কি? –– না, খালের অতিরিক্ত জল যা ক্ষেতের দিকে চলে যেত তা আবার জলের মূল উৎসের কাছে ফিরিয়ে এনে জলের অপচয়কে এড়ানো যায়৷ ছোট স্তরের সেচখালের জলকে খুব কম দূরত্বে নিয়ে যেতে হয়৷ তাই অধিকাংশ সময় পার্শ্ববর্তী জমিতে খুব ভালভাবে সেচ হয়ে যায়৷ অবশ্য অন্য সময়, যেমন বর্ষাকালে অতিরিক্ত জল থাকবেই যা মূল উৎসে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হয় বা নদীর নিম্নাংশে ব্যবহার করতে হয়৷ এই ব্যবস্থায় বর্ষাকালে বন্যার মত পরিস্থিতি হলে তা প্রতিহত করা যায়৷ এইভাবে নদীর ওপর যে ছোট বাঁধ তৈরী হয়েছে তাকেও ক্ষতির হাত থেকে বাঁচানো যায়৷ কর্ষকদের যত্নবান হতে হবে যেন জমিতে অত্যধিক পরিমাণে অজৈব সার ব্যবহার না করা হয়৷ কেননা সেক্ষেত্রে রাসায়নিক পদার্থ নদীর জলকে দূষিত করে দেবে ফলে মানুষ, জানোয়ার, মাছ, গাছ আর পরিবেশের ক্ষতি হবে৷ তাই অজৈব সারের বদলে জৈব সার ব্যবহার করাই বাঞ্ছনীয়৷

কোনো বৃষ্টিছায়া ব্জ্ত্রনু ব্দড়্ত্রস্তুপ্সভ্রগ্গ অঞ্চলে সেচকার্য কীভাবে করা উচিত? যখন জলভরা মেঘ সমুদ্র থেকে এসে পাহাড়ে ধাক্কা মারে তখনই বৃষ্টিপাত হয়৷ পর্বত শ্রেণীর যে অংশটা সমুদ্রের দিকে থাকে তা প্রচুর বৃষ্টি পায়৷ কিন্তু উল্টোদিকে  অন্তর্ভূমি নুপ্ত্ত্রুস্তুগ্গ কম বৃষ্টি পায়৷ যে অংশটা প্রচুর বৃষ্টিপাত পায় তা হ’ল বৃষ্টি–সম্মুখ অঞ্চল আর যা কম বৃষ্টি পায় তা হ’ল বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল৷ সমগ্র তেলেঙ্গানা এলাকা ও মহারাষ্ট্রের পুণে ও তৎসন্নিহিত অংশ বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল৷

পুণে এলাকায় কীভাবে সেচের ব্যবস্থা করতে হবে? এ জন্যে দু’টি প্রধান উপায় আছে৷ এক হ’ল, পর্বতশ্রেণীর সন্নিহিত উপকূল এলাকায় জল পাম্প করে তুলে এমন জায়গায় ফেলতে হবে যাতে তা অন্তর্ভূমি এলাকায় গড়িয়ে চলে যেতে পারে৷ দ্বিতীয় হ’ল, বৃষ্টি–সম্মুখ অঞ্চলের দিক থেকে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বৃষ্টিচ্ছায়া অঞ্চল পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়া৷ এই দ্বিতীয় পদ্ধতিই সবচেয়ে সস্তা৷ ভালভাবে তৈরী এই ধরনের সুড়ঙ্গ একশ পঞ্চাশ বছরের মত টিকবে৷

নদী

তিন ধরনের নদী হয় –– বরফগলা জলে পুষ্ট নদী, বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী, আর ভূ–গর্ভস্থ জলে পুষ্ট নদী৷ প্রথমটির ক্ষেত্রে যখন তাপমাত্রা বাড়ে তখন নদীতে বন্যা হয়, আর বাকী দু’ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ঋতু অনুযায়ী যখন ভারী বৃষ্টিপাত হয় তখন বন্যা হয়৷ অবশ্য তাপমাত্রা বেশী বাড়লে এই ধরনের নদী শুকিয়েও যায়৷

রােের নদীগুলি বারমাস জলে ভর্ত্তি থাকে, না সেগুলি ঋতু নির্ভর? তারা আসলে কী বরফ গলা জলে পুষ্ট বা বৃষ্টির জলে পুষ্ট বা আর্তেশীয় জলস্তরের নিকটবর্ত্তী হওয়ার কারণে তারা কী ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে জল পায়? অনেক বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী জল–সরবরাহ পায় বর্ষাকালে, অন্য ঋতুতে নয়৷ মধ্য রােের নদীগুলিও বৃষ্টির জলে পুষ্ট কিন্তু আর্তেশীয় উৎস থেকেও তারা কিছু জল পায়৷ আমাদের শুধুমাত্র বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদীর ওপর নির্ভর করা উচিত নয়৷ কেননা বর্ষাকালে প্রচুর জল জমা হলেও অন্য ঋতুতে তাদের শুকিয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে৷ কিছু বৃষ্টির জলে পুষ্ট নদী ভূ–গর্ভস্থ জলে (আর্তেশীয় উৎস) সারা বছর ধরে পুষ্ট হওয়ার যদি সুযোগ পায়ও, তবুও সেক্ষেত্রে ভূ–পৃষ্ঠস্থ জল সঞ্চয় করে রাখার সব রকম প্রয়াস করা উচিত৷

চার শ্রেণীর নদী হয় –– খুব ক্ষুদ্র নদী (জোড়), ক্ষুদ্র নদী, মাঝারি নদী ও বড় নদী৷ নদীরও আবার তিন’টে স্তর –– পার্বত্য স্তর, সমতল স্তর ও ব–দ্বীপীয় স্তর৷ কিছু নদীর ব–দ্বীপীয় স্তর থাকে না৷ কেননা সমুদ্রে পৌঁছানোর আগেই মাঝপথে নদী হারিয়ে যায়৷ মিথিলা ও মগধের ভূ–সংস্থানকে এ ব্যাপারে উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক্৷ মিথিলায় বর্ষাকালে প্রচুর জল বাগমতী, গণ্ডক, কোশী দিয়ে প্রবাহিত হয়৷ এই নদীগুলির পার্বত্য স্তর নেপালে, সমতল স্তর মিথিলায় আর ব–দ্বীপীয় স্তর ক্ষাঙলায়৷ মিথিলায় সমতলের মাটি নরম মাটি৷ তাই এ নদীগুলি বার বার গতিপথ পরিবর্তন করে৷ এদের কোনোটারই ব–দ্বীপীয় স্তর মিথিলায় নেই৷ এই নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে মিথিলা ও ক্ষাঙলার যৌথ সহযোগিতা চাই৷

মগধে কিন্তু নদীগুলির পার্বত্য ও ব–দ্বীপীয় স্তর মগধেই –– ব্যতিক্রম শুধু সুবর্ণরেখা যা দক্ষিণ মগধ ও উত্তর ছত্রিশগড়ের সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে৷ মগধ ও কোশলের পারস্পরিক সহযোগিতায় কোয়েল নদীকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়৷ বস্তুতঃ মগধ ও কোশলের অনেক সমস্যা একই ধরনের৷

কোনো নদীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে বা তাকে বশে আনার জন্যে বিশেষজ্ঞদের দিয়ে শক্তিশালী বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা দরকার যাতে নদীর তিনটি স্তর সম্পর্কে অভিজ্ঞ লোকেরা থাকবেন৷ এর ফলে নদী পরিকল্পনা সফলভাবে রূপায়িত হতে পারবে৷ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কোনো দেশই নিজের ইচ্ছামত নদীর জল ব্যবহার করতে পারে না৷ পার্বত্য স্তর, সমতল স্তরের সঙ্গে ও সমতল স্তর ব–দ্বীপীয় স্তরের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনা করে নেবে৷ উদাহরণস্বরূপ, নেপালের যেসব নদী ভারতের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়, কিছু করতে গেলে নেপালকে তাদের সমতল স্তর ও ব–দ্বীপীয় স্তরের কর্ত্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নিতে হবে৷ যদি এই তিনের মধ্যে সহযোগিতা না থাকে, যেসব নদী পার্বত্য স্তর থেকে আসছে বা ব–দ্বীপীয় স্তরে অবরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, তারা এক বিশাল এলাকাকে প্লাবিত করবে৷ মগধ সেক্ষেত্রে এক সুবিধাজনক অবস্থায় আছে কেননা তাদের নদীগুলির পার্বত্য ও সমতল স্তর মগধের মধ্যেই৷    (ক্রমশঃ)