রাঢ়ের ওপর শ্রীপ্রভাত রঞ্জন সরকারের অবদান

লেখক
অধ্যাপক চণ্ডীচরণ  মুড়া

১৯ নবেম্বর ২০১৭ আনন্দমার্গ প্রচারক সঙ্ঘের  রেনেসাঁ ইউনিভার্র্সল-এর আহ্বানে  পুরুলিয়ার  আনন্দনগরে  গিয়েছিলাম ‘রাঢ়’ নিয়ে বলতে৷ আমার বলবার  বিষয় ছিল ‘‘রাঢ়ের ওপর  শ্রী প্রভাতরঞ্জন সরকারের অবদান ’’৷ সহবক্তা ছিলেন  উত্তরপাড়া স্বামী নিঃসম্বলানন্দ গালর্স কলেজের অধ্যাপক  ও লেখক শুভমানস ঘোষ মহাশয় (বিষয়ঃ ‘‘সাহিত্য ও দায়িত্ব’’), সিধু-কানু-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা বিভাগের অধ্যাপক লক্ষ্মীরাম  গোপ মহাশয় (বিষয়: ‘‘নব্যমানবতাবাদ শিক্ষা’’), সভাপতির ভূমিকায় ছিলেন সঙ্ঘের প্রবীণ সন্ন্যাসী আচার্য মন্ত্রেশ্বরানন্দ অবধূত৷ সুবক্তা ও পাণ্ডিত্যের অধিকারী এই বিদগ্দ আচার্য শ্রী সরকারের অর্থনীতি তথা  ‘প্রাউট’ (প্রোগ্রেসিভ ইউটিলাইজেশন থিওরি) সম্পর্কে আলোকপাত করেন৷  এই অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ ও ধন্যবাদ জ্ঞাপন দুই-এরই দায়িত্বে ছিলেন আনন্দমার্গ প্রচারক সঙ্ঘের রেক্টর মাস্টার আচার্য নারায়ণানন্দ অবধূত৷

‘রাঢ়’ নিয়ে শ্রী সরকারের অবদান তো আর একটা বক্তৃতায় বলা সম্ভব নয়, তবুও স্বল্প পরিসরের  বক্তৃতায় অল্পকিছু  আলোকপাত  করবার সুযোগ হয়েছিল৷ বলতে  গেলে তো আর শেষ হয় না, ঊর্ণনাভের সুতোর মতো একের পর এক  তথ্য উঠে  আসে৷ ‘সভ্যতার আদিবিন্দু’ এই  ‘রাঢ়’ কথার  অর্থ রক্তমৃত্তিকার দেশ৷ চীনা ভাষায় বলা হয় ‘লাতি’, গ্রীক ভাষায় ‘গঙ্গা রিডি’, আর অস্ট্রিক ভাষায় ‘রাট্ঠ’ (‘ট’-এ হস্ হবে )৷  রাঢ়কে তিনি যে ভৌগোলিক  সীমারেখা  দিয়ে বেঁধেছেন তার বিস্তার খুব একটা ছোট নয়৷ প্রাচীন রাঢ় বিভাজিত  ছিল বেশ কিছু ভূম-আন্তিক নামে৷ যেমন-বীরভূম, গোপভূম, সামন্তভূম, শিখরভূম, মল্লভূম, সেনভূম, মানভূম, বরাহভূম, সিংহভূম, ধবলভূম বা ধলভূম, শবরভূম, ভঞ্জভূম, সপ্তশতী, ভুরিশ্রেষ্ঠ বা ভুরশুট৷  শেষ দুটিকে বাদ দিলে সবগুলোরই  শেষে  ‘ভূম’ রয়েছে৷ এই ‘রাঢ়’ অবশ্য সভ্যতার চক্রনাভিও বটে৷     আজ থেকে প্রায় তিরিশ কোটি বছর  পূর্বে এই ভূখন্ড গড়ে উঠেছিল৷ চারিদিকে উত্তাল সমুদ্র মাঝখানে  উত্তুঙ্গ শিখর মালায় সজ্জিত  এক দ্বীপ৷  ‘ঊহ’ আর ‘আবোহ’ মিলে নিঃসঙ্গ এক দ্বীপ৷ সে দিন  এই ভূখন্ডের  নাম দেওয়ার মতো কেউই ছিল না,  এমনকি কোন গাছ পালাও ছিল না ৷  তারপর সৃষ্টির নিয়ম মেনে ধাপে ধাপে  গুটি গুটি পায়ে  সকলই  এলো একদিন৷  বিবর্তিত রূপে  প্রাচীন সভ্যতার  প্রতিভূ হিসেবে এলো মানুষ৷ কোনো বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় , প্রাচীন মানুষের আদি নিবাস ছিল এই রাঢ় ৷ হিমযুগের আগে  এখানে ডায়নোসর, ম্যামথ (ঐরাবত)--এর মতো বড়ো বড়ো প্রাণীর বাস ছিল৷ কারণ আনন্দ নগরের সন্নিকটস্থ পাহাড়ে ডায়নোসরের ফসিল উক্ত প্রাণীর আদিম অস্তিত্বকে স্বীকার করে থাকে৷ বাগড়ী, ডবাকের  চেয়ে  এতদ্  অঞ্চলের জলবায়ু স্বাস্থ্যকর  নিঃসন্দেহে, তবুও এখানের  মানুষ নানান ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়৷ তার কারণ, অপুষ্টিজনিত৷  পুষ্টিকর খাদ্যের  এখানে  বড্ড অভাব৷ চরম দারিদ্র্য এর  আর একটা  অন্যতম কারণ তো বটেই ৷ তবু এরা বড্ড  অতিথিপরায়ণ, নিজে খেতে পায় না ঠিকই কিন্তু  অতিথিকে  খাওয়ায়৷ কী খাওয়ায়?  না, সে নিজে যা খায় --গরম ভাত , বিরির ডালে , বড়ি -পোস্ত আর ডিংলা  (কুমড়ো) -র তরকারী ৷ আর সারল্যের প্রতিভূ এই রাঢ়ের মানুষ৷ এই অঞ্চল  একদা ঘন অরণ্যে আচ্ছাদিত ছিল৷ আকাশমুখী বনস্পতি মহীরুহ বৃষ্টিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে নামাতো এই ধরাধামে৷ গাছপালার কারণে প্রবল বৃষ্টিপাতেও ভূমিক্ষয় রোধ পেত৷  এই বনস্পতি  মহীরুহ  বহুবছর  মাটির তলায় চাপা পড়ে  কয়লায় পরিণত  হয়েছে৷ কয়লাকে রাঢ়ের মানুষ  বলে থাকে ‘আংরা’ সংস্কৃতে ‘অঙ্গার’৷ রাঢ়ে বেশ কিছু স্থানের নাম অঙ্গারডিহি থেকে এটা অনুমান  করা অসঙ্গত নয় যে এই অঞ্চলের মাটিরগর্ভে একদা কয়লা ছিল বা আজও আছে৷ একই সূত্র ধরে বলা যায় যে রাঢ়ে হীরাপুর গ্রামের নামটি হীরা প্রাপ্তির বিষয়টিকেই উজ্বল  করে তোলে৷ আর সুবর্ণরেখার বালিতেই তো সোণা মেলে৷ রত্নগর্ভ এই রাঢ় , কেবল সঠিক পথনির্দেশনার  অভাবে রাঢ়ের পশ্চিমংশ  আজও পশ্চাৎপদ৷

বর্ণশ্রম সমাজ ব্যবস্থা ভারতের বিধান  ছিল না কোনওকালেই ৷ তাই রাঢ়ের মাটিতেও ছিল না৷ এই আগাছাটি ভারতে অনুপ্রবেশ করেছিল উত্তর-পশ্চিম দিগন্ত থেকে৷ তারপর সমগ্র  ভারতের প্রাণরস একটু একটু  করে শুষে নিয়েছে৷ তার সুদূর প্রভাবী বিষবায়ু  আজও আমাদের রক্তকে দূষিত করে তুলছে৷  এই বিষবৃক্ষটি  রোপিত  হয়েছিল  শঙ্করাচার্য প্রবর্তিত পৌরাণিক ধর্মের আগমণের পরে পরেই৷  আর্যরাও সেই সময় থেকেই আসতে আরম্ভ করেন৷ উত্তর ভারত থেকে ক্রমশ বিভেদনীতির বিষাক্ত বায়ু  রাঢ়ের আকাশকেও  ছেয়ে ফেলে৷ তারপর এখনও জগদ্দল পাথরের ন্যায়  রাঢ়েরও ঘাড় মটকে  চলেছে প্রায়শই ৷ তবে হ্যাঁ, জাতি বিভাজন  থাকলেও  জাতি বিদ্বেষ কখন ওই  ছিল না ভারতে৷ রাঢ়ে তো ছিলই না৷

এই রাঢ়কে আর্যরা  নাম দিয়েছিলেন ‘বর্জ্যভূমি’৷ একদা বাঘ , সিংহ, নেকড়ের হুমদুমি ছিল বটে এই অঞ্চলে৷ অনার্য রাঢ়বাসী আর্যদের অনুপ্রবেশে তাহলে  কি পথ আটকে ছিল? না নেকড়ের ভয় দেখিয়েছিল ? নাকি, এই পাণ্ডববর্জিত  ভূ-ভাগ আর্যরা নিজেরাই ত্যাগ করেছিলেন?  এইসব প্রশ্ণ উঁকি দেয় মনে৷ হ্যাঁ, তবে  এখানে নারীর অবাধ স্বাধীনতা ছিল ৷ কর্মে, যুদ্ধে, সুখে-দুঃখে নারী-পুরুষ এক সঙ্গে  পায়ে পা মিলিয়ে  চলতো৷ সেই তুলনায় সমতট বা বাগড়ী ও ডবাক  অঞ্চলে  নারী স্বাধীনতা ছিল না একেবারেই ৷ এই অঞ্চলের মধ্যে পশ্চিম-রাঢ়ের  নিম্নস্থ ভূ-ভাগ  খনিজ পদার্থে ঠাসা আমরা জানি, তবে  উপরিভাগকেও কম গুরুত্ব দেওয়া চলে  না৷ কারণ,একটু পরিশ্রম করলেই ভূমিভাগের  উপরস্থকেও  ফুলে-ফলে-পল্লবে ভরিয়ে তোলা অসম্ভব কিছুই নয়৷ তেমনি পূর্বরাঢ়ের উপরিভাগের মাটি উর্বরতায়  সমগ্র পৃথিবীর চেয়ে  এগিয়ে৷ তবে যেখানে  সারাগোসা সমুদ্র ছিল সেখানে  খনিজ তৈলের  সম্ভাবনার কথাকেও উড়িয়ে দেওয়া  যায় না৷  তাঁর আর একটি কথা বলে এই লেখা শেষ করতে চাই  তা হলো পৃথিবীতে যত ধরণের মন্দ দিক আছে তার মধ্যে  সবচেয়ে ভয়ঙ্কর  দিক হলো  মানুষের প্রতি মানুষের৷ এই রাঢ়ে একটা সময় বৈশ্যযুগ এসেছিল আর তার ফলশ্রুতি  চরম শোষণে  পৌঁছেছিল৷ আজও রাঢ় সেই শোষণ থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়৷ শ্রী সরকার সমগ্র বিশ্ববাসীর  কাছে আহ্বান জানিয়েছেন  তাঁর স্বপ্ণের  রাঢ়, ভালোবাসার রাঢ়কে সাহায্যের  হাত বাড়িয়ে দিতে৷ যে চরমত্যাগ তিতিক্ষা স্বীকার করে রাঢ়ের  কাঁকুরে মাটিকে আঁকড়ে  রেখেছিলেন  তিনি, তাকে  বাঁচানোর সুতীব্র প্রয়াস  চালিয়ে গিয়েছেন  তা প্রতিনিয়ত আমাদের ভাবায়৷ রাঢ়ের লাল মাটি ধরে তাঁর পথচলা অনেক কিছুর সন্ধান দেয়, আমরাও সেই মাটি খুঁড়ে  খুঁড়ে  কিছু খুঁজবার চেষ্টা করি মাত্র৷ তাঁর দেওয়া ৫০১৮টি সংগীত (কথা ও সুর) - এর মধ্যে একটির কথা উল্লেখ করলেই  রাঢ়ের  প্রতি তাঁর ভালোবাসার  পরিচয় প্রস্ফুটিত  হয়ে ওঠে৷

যেমন---

রাঢ়ের এ লাল মাটি, লাল মাটি গো লাল মাটি

সোণার খনির মুক্তা-মণির চেয়েও জানি  খাঁটি৷

মধুর  মানুষ মধুর ভাষা মধুরতায় ভরা বাসা৷

পূর্ণ করে সকল আশা রূপে পরিপাটি৷৷

রাঢ়ের সকলকিছুই ভালো,

                কালোর  মাঝে ভরা আলো৷

প্রাণের প্রদীপ হেথায় জ্বালো,

                মাটি নয়, এ মা---টি৷৷     (প্রভাত সঙ্গীত ৪২৪৫)