রাজনীতি ও বিভাজন নীতি

লেখক
আচার্য মন্ত্রসিদ্ধানন্দ অবধূত

পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিন ক্ষণ ঘোসণা হয়েছে. শাসক ও বিরোধী শিবিরেও শুরু হয়েছে বিভাজনের রাজনীতি৷ তিনি একসময়ে কেন্দ্রীয় সরকারের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন--- গত বারে রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি পদের জন্যে মনোনীত করা হয়েছিল, কারণ তিনি দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ বলে৷ বাংলায় যাকে বলে ‘নীচু জাতে’র---সিডিউল কাষ্টের মানুষ৷ উদ্দেশ্য কী? আগামী লোকসভা নির্র্বচনে যাতে এই তথাকথিত ‘দলিত শ্রেণীর মানুষের সমর্থন পাওয়া যায়৷ বিজেপি’র নেতারা তাঁদের এই রণকৌশলের কথা প্রকাশ্যে বলেছিলেন৷

ঠিক একই পথে হেঁটেছিলেন বিরোধী গোষ্ঠী৷ তাই কংগ্রেস, কম্যুনিষ্টসহ অধিকাংশ বিরোধী দল মিলে তথাকথিত দলিত শ্রেণীর মানুষ জগজীবন রামের কন্যা মীরা কুমারকে তাঁদের প্রার্থী হিসাবে দাঁড় করিয়েছিলেন৷

এই হ’ল ভারতের রাজনীতি৷ এ হ’ল যেন তেন প্রকারেণ ক্ষমতার দখল করার  রাজনীতি! তোষণের রাজনীতি! এটা আজকের শিক্ষিত মানুষদের অজানা থাকার  কথা নয় যে , এই জাত-পাতটা সম্পূর্ণ ভূয়া৷ সবাই এক পরমপিতা পরমপুরুষের সন্তান৷ এক পিতার সন্তান হলে মানুষের মধ্যে ভিন্ন জাতি হয় কী করে? বিজ্ঞান বলছে, সমস্ত মানুষ বানর জাতীয় প্রাণী থেকে এসেছে৷ তাহলে বলতে পারি, বানররা মানুষের পূর্বপুরুষ৷ বানরদের মধ্যে, ব্রাহ্মণ বানর, কায়স্থ বানর, মুচি বানর--- এসব আছে নাকি? তা না হলে পূর্বপুরুষের দোহাই দিয়ে জাত-পাতকে স্বীকার করা যায় কীভাবে? ভারতবর্ষের এই তথাকথিত হিন্দুসমাজের  সবচেয়ে বড় কলঙ্ক হ’ল এই জাতিভেদ প্রথা৷ জাতিভেদ প্রথার জন্যে আজকের সমাজ ছিন্ন -ভিন্ন খন্ড-বিখন্ড৷

সমাজে হীনম্মন্যতাৰোধ inferiority complex) একটা খুব বড় ব্যাধি৷ সমাজের অধিকাংশ মানুষ এই হীনম্মন্যতায় ভোগে৷ ভাবে, আমরা নীচু জাতের আর ওরা উঁচু জাতের৷ ওঁরা শ্রেষ্ঠ, আমরা হীন৷ ওঁরা মুখোপাধ্যায়, বন্দ্যোপাধ্যায় মিশ্র প্রভৃতি ব্রাহ্মণ শ্রেণীভুক্ত, আর আমরা নীচু জাতির লোক৷ ওঁরা ঈশ্বরের আশীর্র্বদ ধন্য!

এই মানসিকতা সমাজের বৃহত্তর অংশের উন্নতির পথে বিরাট অন্তরায়৷ আজও তথাকথিত উঁচুজাতের মানুষেরা  প্রকাশ্যে  বা গোপনে নিজেদের উঁচু জাতির জন্যে গর্ব-অনুভব করে৷ অনেকেই উঁচুজাতের তথাকথিত চিহ্ণটাও (সাইনবোর্ড) গলায় ঝুলিয়ে রাখে বা মাথার ওপর  যত্ন করে রেখে দেয়৷--- যাতে  সবাই চিনতে পারে--- সমীহ করে৷

আমাদের দেশের যাঁরা শিক্ষিত মানুষ , ইতিহাস , সমাজ, বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে যাঁরা সচেতন তাঁরা স্বাধীনতার পরেও ইচ্ছে করলে ভারতের সমাজব্যবস্থার এই কলঙ্কটাকে মুছে ফেলতে পারতেন৷ কিন্তু হয়নি৷ তার প্রথম কারণ, মুখে শিক্ষিত বললেও পুস্তকীয় বিদ্যা থাকলেও মন কিন্তু কুসংস্কারে ভরা৷ বিশেষ করে বা বিনা আয়াসে যদি বিশেষ সম্মান,সমীহ তথা বিশেষ সামাজিক  সুবিধা পাওয়া যায়--- তা ছাড়ি কেন! এই মানসিকতা!

আর দ্বিতীয় কারণ হ’ল ক্ষমতা দখলের রাজনীতি৷ এই রাজনীতির প্রয়োজনে নেতা-নেত্রীরা এই জাতিভেদটা জিইয়ে রেখেছেন৷ প্রথমতঃ সংরক্ষণের নামে৷ বিশেষ জাতির জন্যে, সিডিউলড্‌ কষ্টের  জন্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে’ তাদের বোট (ভোট) সংগ্রহ করা৷ এইভাবে সংখ্যালঘু তোষণও চলছে সমানে৷ দ্বিতীয়তঃ, নির্র্বচনে প্রার্থী দেওয়ার সময়, সরাসরি বিশেষ জাতির মানুষের বোট পেতে তাদের জাতির লোককে প্রার্থী করা হচেছ৷ তার চেয়ে যোগ্য অন্যপ্রার্থী থাকলেও তাঁকে প্রার্থী না করে বোট সংগ্রহের স্বার্থে প্রয়োজনে অযোগ্য প্রার্থীকে দাঁড় করানো হচ্ছে ও জাত-পাতের সেন্টিমেন্টকে  উস্কানি দিয়ে তাকে জিতিয়ে আনা হচ্ছে৷

এমনকি ডাক্তারি,শিক্ষকতা সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে যেখানে যোগ্যতাটা প্রধান বিচার্য হওয়া উচিত---তা না হলে সমাজের ক্ষতি হয়ে যাবে, সেক্ষেত্রেও যোগ্যতাকে পেছনে ফেলে জাত-পাতের বিচারটাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে৷ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সাধারণ মানুষ বোট দেন না, যাঁরা বোট দেন তাঁরা সকলেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি৷ সেখানেও বোটে জেতার জন্যে জাত-পাত, সম্প্রদায় প্রাদেশিকতার তাস খেলতে হয়৷

তাই বলছি, আজকে যে সমাজ থেকে জাত-পাত সম্প্রদায়ের বিভেদ এখনও জাঁকিয়ে বসে আছে, এর প্রধান কারণ রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের পৃষ্ঠপোষকতা৷ আজকের ক্ষমতা দখলের রাজনীতি সমাজের  নানান সমস্যার জনক৷